৮১. যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জ্জুনসহ ভীমের মিলন

৮১তম অধ্যায়

যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জ্জুনসহ ভীমের মিলন

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! অনন্তর প্রধান প্রধান কৌরবসৈন্যগণ ভীমসেনকে আক্রমণ করিলে তদ্দর্শনে মহাবীর ধনঞ্জয় তাঁহার উদ্ধারবাসনায়, সূতপুত্রের সৈন্যগণকে বিমর্দ্দিত করিয়া যমরাজের রাজধানীতে প্রেরণ করিতে লাগিলেন। ঐ সময় মহাবীর ধনঞ্জয়ের শরজাল বিহঙ্গমকুলের ন্যায় নভোমণ্ডল সমাচ্ছন্ন করিল। মহাবীর কুন্তীনন্দন কৌরবগণের অন্তকস্বরূপ হইয়া ভল্ল, ক্ষুরপ্র ও বিমল নারাচদ্বারা তাঁহাদের গাত্র ও মস্তকচ্ছেদন করিতে লাগিলেন। ঐ সময় সমরভূমি ছিন্নগাত্র, ছিন্নমস্তক, কবচশূন্য যোধগণের কলেবরে সমাবৃত এবং ছিন্নভিন্ন, বিকলাঙ্গ হস্তী, অশ্ব ও রথসমূহের নিপাতে ভীষণাকার বৈতরণীনদীর ন্যায় অতিশয় দুর্গম ও দুর্নিরীক্ষ্য হইয়া উঠিল। অসংখ্য ঈষা, চক্র, অক্ষ ও ভল্ল ইতস্ততঃ নিপতিত হইতে লাগিল; ঐ সময় কোন কোন রথ অশ্বসারথিবিহীন, কোন কোন রথ কেবল অশ্বযুক্ত ও কোন কোন রথ কেবল সারথিযুক্ত দৃষ্টিগোচর হইল। সুবর্ণবর্ণবৰ্মধারী, কনকভূষণালঙ্কৃত, যোধগণসমারূঢ়, ক্রুর মহামাত্রগণকর্ত্তৃক পার্ঞ্চি ও অঙ্গুষ্ঠদ্বারা পরিচালিত, মদমত্ত, কবচভূষিত চারিশত মাতঙ্গ অর্জ্জুনের শরনিকরে সমাহত হইয়া সমরাঙ্গনে নিপতিত হইলে বোধ হইল যেন, মহাপর্ব্বতের সমৃদ্ধিশালী শৃঙ্গসকল বিশীর্ণ ও ধরাতলে সমাকীর্ণ হইয়াছে। মহাবীর অর্জ্জুন সেই জলদসন্নিভ মদবর্ষী বারণগণকেনিপাতিত করিয়া মেঘ বিনির্গত মার্কণ্ডের ন্যায় শোভা ধারণ করিলেন। এইরূপে অস্ত্র, যন্ত্র ও কবচশূন্য চতুরঙ্গবল সমরাঙ্গনে নিপতিত হওয়াতে পথসকল আচ্ছন্ন হইল। তখন মহাবীর অর্জ্জুনের ঘোরতর বজ্রনির্ঘোষসদৃশ গাণ্ডীবশরাসনের ভীষণ শব্দ সমুত্থিত হইতে লাগিল। সাগরমধ্যে নৌকা যেমন প্রবল সমীরণে সমাহত হইয়া বিদীর্ণ হয়, তদ্রূপ সেই কৌরবসৈন্যগণ ধনঞ্জয়ের শরে সমাহত হইয়া ছিন্নভিন্ন হইল। অঙ্গার, উল্কা ও অশনির ন্যায় প্রাণবিনাশক গাণ্ডীবনিঃসৃত বিবিধ বাণ তাহাদিগকে দগ্ধ করিতে আরম্ভ করিলে তাহারা রজনীযোগে পৰ্বতস্থিত প্রজ্বলিত বেণুবনের ন্যায় শোভা ধারণ করিল। অটবীমধ্যে মৃগগণ যেমন দাবদহনভীত হইয়া ইতস্ততঃ পৰ্যটন করে, তদ্রূপ কৌরবগণ অর্জ্জুনের শরানলে দগ্ধ ও ভীত হইয়া চতুর্দ্দিকে ধাবমান হইল। ঐ সময় যাহারা ভীমসেনকে আক্রমণ করিয়াছিল, তাহারাও ভীতচিত্তে তাঁহাকে পরিত্যাগপূর্ব্বক রণপরাঙ্মখ হইয়া চতুর্দ্দিকে পলায়ন করিতে লাগিল।

“হে মহারাজ! এইরূপে কৌরবগণ ছিন্নভিন্ন হইলে সমরবিজয়ী ধনঞ্জয় ভীমসেনের নিকট সমুপস্থিত হইয়া ক্ষণকাল তাঁহার সহিত মন্ত্রণা করিয়া তাঁহাকে যুধিষ্ঠিরের নিরাপদবার্ত্তা বিজ্ঞাপিত করিলেন এবং তাঁহার অনুমতি গ্রহণপূর্ব্বক পুনরায় রথনির্ঘোষে ভূমণ্ডল ও নভোমণ্ডল প্রতিধ্বনিত করিয়া সমস্থলে সমাগত হইলেন। ঐ সময় দুঃশাসনের অনুজ দশজন মহাবীর ধনঞ্জয়কে পরিবেষ্টন করিয়া সুতীক্ষ্ণশনিকরে নিপীড়িত করিতে লাগিলেন। তৎকালে বোধ হইল যেন, তাঁহারা জ্যারোপিত, শরাসন আয়ত করিয়া নৃত্য করিতেছেন। মহাত্মা বাসুদেব ধনঞ্জয়কে উষ্কানিপীড়িত কুঞ্জরের ন্যায় আপনার পুত্রগণের শরে সমাহত দেখিয়া অর্জ্জুন অচিরাৎ তাঁহাদিগকে শমনসদনে প্রেরণ করিবেন স্থির করিয়া তাঁহাদিগের বামপার্শ্বে রথসঞ্চালন করিতে লাগিলেন। তাঁহারা অর্জ্জুনের রথ অন্যদিকে ধাবমান দেখিয়া সত্বর তাঁহার অভিমুখীন হইলেন। তখন মহাবীর ধনঞ্জয় নারাচ ও অর্দ্ধচন্দ্ৰশরে সেই বীরগণের রথকেতু, অশ্ব, চাপ ও সায়কসকল খণ্ড খণ্ড করিয়া সুবর্ণপুঙ্খ দশভল্লে তাঁহাদিগের লোহিতনেত্রযুক্ত, দাষ্টাধর মস্তকসকল ছেদনপূর্ব্বক পুনরায় গমন করিতে লাগিলেন। আপনার আত্মজগণের বদনসমুদয় ভূতলে নিপতিত হইয়া পঙ্কজের ন্যায় শোভিত হইল।”