৬২. সঙ্কুলযুদ্ধ—কৌরবপরাজয়

৬২তম অধ্যায়

সঙ্কুলযুদ্ধ—কৌরবপরাজয়

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়। ভীমসেন ও যুধিষ্ঠির সমরে প্রবৃত্ত এবং আমাদের সৈন্যগণ পাণ্ডব ও সৃঞ্জয়গণকর্ত্তৃক বারংবার নিপীড়িত হইয়া নিরানন্দ ও পলায়নপরায়ণ হইলে কৌরবগণ কি করিল, তাহা কীৰ্ত্তন কর।”

সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজা প্রতাপান্বিত সূতনন্দন মহাবাহু বৃকোদরকে নিরীক্ষণ করিয়া রোষকষায়িতনয়নে তাঁহার প্রতি ধাবমান হইলেন এবং দুর্যোধনসৈন্যগণকে ভীমসেনের শরে পরাঙ্মুখ দেখিয়া যথোচিত যত্নসহকারে তাহাদিগকে সন্নিবেশিত করিয়া পাণ্ডবগণের অভিমুখে যাত্রা করিলেন। তখন পাণ্ডবপক্ষীয় মহারথগণ স্ব স্ব শরাসন কম্পিত ও বিশিখজালবর্ষণপূর্ব্বক কর্ণের প্রতি ধাবমান হইলেন। মহাবলপরাক্রান্ত ভীমসেন, সাত্যকি, শিখণ্ডী, জনমেজয়, ধৃষ্টদ্যুম্ন ও. প্রভদ্রকগণ কোপাবিষ্ট হইয়া বিজয়লাভার্থ চতুর্দ্দিক হইতে কৌরবপক্ষীয় সেনাগণের অভিমুখে আগমন করিতে লাগিলেন; কৌরবপক্ষীয় মহারথগণও জিঘাংসা-পরতন্ত্র হইয়া সত্বর পাণ্ডবসৈন্যের প্রতি ধাবমান হইলেন। তখন সেই অসংখ্য ধ্বজসমাকীর্ণ চতুরঙ্গবল অদ্ভুতরূপে লক্ষিত হইতে লাগিল।

“অনন্তর মহাবীর শিখণ্ডী কর্ণের, ধৃষ্টদ্যুম্ন সৈন্যপরিবৃত দুঃশাসনের, নকুল বৃষসেনের, যুধিষ্ঠির চিত্রসেনের, সহদেব উলূকের, সাত্যকি শকুনির, মহারথ দ্রোণপুত্র অর্জ্জুনের, কৃপাচার্য্য মহাধনুর্দ্ধর যুধামন্যুর, কৃতবর্ম্মা উত্তমৌজার এবং দ্ৰৌপদীতনয়গুণ অন্যান্য কৌরবগণের প্রতি ধাবমান হইলেন। মহাবাহু ভীমসেন একাকীই অসংখ্য সৈন্যপরিবৃত আপনার পুত্রগণকে নিবারণ করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন ভীষ্মহন্তা মহাবীর শিখণ্ডী সমরচারী নির্ভয়চিত্ত কর্ণকে শরনিকরে নিবারণ করিতে লাগিলেন। সূতপুত্র শিখণ্ডীর শরে সমাহত ও ক্রোধস্ফুরিতাধর হইয়া তিনবাণে তাঁহার ললাট বিদ্ধ করিলেন। শিখণ্ডী সেই বাণ ললাটদেশে ধারণপূর্ব্বক ত্রিশৃঙ্গ রজতপর্ব্বতের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। তখন তিনি ক্রোধভরে নিশিত-নবতিশরে কর্ণকে নিপীড়িত করিলে মহারথ সুতপুত্র তাহার অশ্ব বিনাশ ও তিনবাণে সারথিকে সংহারপূর্ব্বক ক্ষুরপ্ৰদ্বারা তাঁহার ধ্বজ ছেদন করিয়া ফেলিলেন। শত্রুতাপন মহারথ শিখণ্ডী সেই হতাশ্বরথ হইতে আরোহণপূর্ব্বক ক্রোধভরে কর্ণের প্রতি শক্তি নিক্ষেপ করিলেন। মহাবীর কর্ণ শরনিকরে সেই শক্তি ছেদন করিয়া নিশিতনয়বাণে তাঁহাকে বিদ্ধ করিলেন। শিখণ্ডী কর্ণশরে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া তাঁহার শরপতনপথ পরিত্যাগপূর্ব্বক ভয়বিহ্বলচিত্তে পলায়নে প্রবৃত্ত হইলেন। তখন মহাবীর কর্ণ বলবান্ বায়ু যেমন তুলারাশি পাতিত করে, তদ্রূপ পাণ্ডবসৈন্য নিপাতিত করিতে লাগিলেন।

“ঐ সময়ে মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন দুঃশাসনকর্ত্তৃক নিপীড়িত হইয়া তিনবাণে তাঁহার বক্ষঃস্থল বিদ্ধ করিলে দুঃশাসন সুবর্ণপুঙ্খ আনতপর্ব্ব ভল্লদ্বারা তাহার দক্ষিণ বাহু বিদ্ধ করিলেন। ধৃষ্টদ্যুম দুঃশাসনের শরে বিদ্ধ হইয়া ক্রোধভরে তাঁহার প্রতি এক ঘোরতর শর পরিত্যাগ করিলেন। দুঃশাসন সেই ভীষণ শর মহাবেগে সমাগত হইতেছে দেখিয়া তিনবাণে উহা ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তৎপরে তিনি কনকভূষণ সপ্তদশভল্পে ধৃষ্টদ্যুম্নের বাহুদ্বয় ও বক্ষঃস্থল বিদ্ধ করিলে দ্রুপদনন্দন ক্রুদ্ধ হইয়া সুতীক্ষ্ণ ক্ষুরপ্ৰদ্বারা তাঁহার শরাসন ছেদন করিলেন। তদ্দর্শনে সৈন্যগণ চীৎকার করিয়া উঠিল। অনন্তর মহাবীর দুঃশাসন হাস্যমুখে সত্বর অন্য শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক শরনিকরে ধৃষ্টদ্যুম্নের চতুর্দ্দিক সমাচ্ছন্ন করিলেন। তখন যাবতীয় বীরপুরুষ এবং অপ্সরা ও সিদ্ধগণ আপনার পুত্র মহাত্মা দুঃশাসনের পরাক্রম দেখিয়া নিতান্ত বিস্ময়াপন্ন হইলেন। এইরূপে মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন সিংহসংরুদ্ধ মাতঙ্গের ন্যায় দুঃশাসনকর্ত্তৃক অবরুদ্ধ হইলে আমরা আর তাঁহাকে দেখিতে পাইলাম না। পাঞ্চালগণ আপনাদিগের সেনাপতিকে অবরুদ্ধ অবলোকন করিয়া তাঁহার উদ্ধারার্থে হস্তী, অশ্ব ও রথসমুদয়ে সমবেত হইয়া দুঃশাসনকে অবরোধ করিলেন। তখন উভয়পক্ষে সর্ব্বজনভীষণ তুমুল সংগ্রাম উপস্থিত হইল।

‘এদিকে বৃষসেন পিতৃসমীপে অবস্থানপূর্ব্বক নকুলকে প্রথমতঃ লৌহনির্ম্মিত পাঁচবাণে নিপীড়িত করিয়া পুনরায় তিনবাণে বিদ্ধ করিলেন; মহাবীর নকুলও হাস্যমুখে সুতীক্ষ্ণ নারাচে বৃষসেনের হৃদয় বিদ্ধ করিলেন। শরনিসূদন বৃষসেন এইরূপে নকুলশরে সমাহত হইয়া তাঁহাকে বিংশতিবাণে পীড়িত করিলে মাদ্ৰীতনয়ও তাঁহাকে পাঁচবাণে বিদ্ধ করিলেন। অনন্তর সেই বীরদ্বয় সহস্র সহস্র শর পরিত্যাগপূর্ব্বক পরস্পরকে সমাচ্ছন্ন করিতে লাগিলেন। ঐ সময় অন্যান্য সৈন্যগণ সমর পরিত্যাগপূর্ব্বক পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল। মহাবীর কর্ণ দুৰ্য্যোধনসৈন্যগণকে পলায়নপরায়ণ অবলোকন করিয়া তাহাদিগকে অনুসরণ করিয়া বলপূর্ব্বক নিবারণ করিতে লাগিলেন। তদ্দর্শনে মহাবীর নকুল কৌরবগণের অভিমুখে ধাবমান হইলেন; বৃষসেনও নকুলকে পরিত্যাগপূর্ব্বক কর্ণের চক্ররক্ষা করিতে লাগিলেন।

“ঐ সময় প্রতাপশালী সহদেব রোষাবিষ্ট উলূককে নিবারণ করিয়া তাঁহার চারি অশ্ব ও সারথিকে নিপাতিত করিলেন। তখন উলূক অবিলম্বে রথ হইতে অবরোহণপূর্ব্বক ত্রিগর্ত্তগণের সৈন্যমধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন।

“মহাবীর সাত্যকি নিশিত-বিংশতিশরে শকুনিকে বিদ্ধ করিয়া হাস্যমুখে ভল্লদ্বারা তাঁহার ধ্বজ ছেদন করিলেন; মহাবলপরাক্রান্ত সুবলনন্দনও ক্রোধাবিষ্ট হইয়া সাত্যকির কবচ বিদারণপূর্ব্বক তাঁহার সুবর্ণময় ধ্বজ ছেদন করিয়া ফেলিলেন। মহাবীর যুযুধান তদ্দর্শনে ক্রুদ্ধ হইয়া নিশিতশরনিকরে শকুনিকে বিদ্ধ করিয়া তিনবাণে তাঁহার সারথিকে নিপীড়িত ও শরনিকরে অশ্বগণকে নিপাতিত করিলেন। তখন শকুনি সহসা রথ হইতে অবরোহণপূর্ব্বক মহাত্মা উলূকের রথে আরোহণ করিয়া সাত্যকিসমীপ হইতে পলায়ন করিলেন। তখন সাত্যকি মহাবেগে কৌরবসৈন্যগণের প্রতি ধাবমান হইলেন। কৌরবপক্ষীয় সৈনিকগণ যুযুধানশরে সমাচ্ছন্ন হইয়া সমর পরিত্যাগপূর্ব্বক দশদিকে পলায়িত ও নির্জীবের ন্যায় নিপতিত হইতে লাগিল।

“ঐ সময় কুরুরাজ দুৰ্য্যোধন সমরে ভীমসেনকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। তখন বৃকোদর ক্রোধান্বিত হইয়া মুহূৰ্তমধ্যে তাঁহার রথ, ধ্বজ, অশ্ব ও সারথিকে ধ্বংস করিলেন। তদ্দর্শনে পাণ্ডবসৈন্যগণ পরম পরিতুষ্ট হইয়া ভীমসেনের নিকট হইতে পলায়ন করিলেন। তখন কৌরবপক্ষীয় সৈন্যগণ ভীমসেনের বিনাশকামনায় তাঁহার অভিমুখে ধাবমান হইয়া ঘোরতর সিংহনাদ করিতে লাগিল।

“এদিকে মহাবীর যুধামন্যু কৃপকে বিদ্ধ করিয়া তাঁহার শরাসন ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তখন শস্ত্রধরাগ্রগণ্য কৃপাচার্য্য অন্য শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক যুধামন্যুর ধ্বজ, ছত্র ও সারথিকে ভূতলে পাতিত করিলেন। মহারথ যুধামন্যু তদ্দর্শনে ভীত হইয়া স্বয়ং রথচালনপূর্ব্বক পলায়নে প্রবৃত্ত হইলেন।

“ঐ সময় মহাবীর উত্তমৌজা জলধর যেমন জলধারায় ভূধরকে সমাচ্ছন্ন করে, তদ্রূপ ভীমপরাক্রম কৃতবর্ম্মাকে সহসা শরনিকরে আচ্ছাদিত করিলেন। তখন সেই বীরদ্বয়ের অতি ভীষণ অপূর্ব্ব তুমুল সংগ্রাম আরম্ভ হইল। অনন্তর কৃতবর্ম্মা সহসা উত্তমৌজার হৃদয় বিদ্ধ করিলে তিনি নিতান্ত ব্যথিত হইয়া রথে উপবেশন করিলেন। সারথি তদ্দর্শনে রথ লইয়া পলায়ন করিল।

‘অনন্তর সমুদয় কৌরবসৈন্য ভীমসেনের প্রতি ধাবমান হইল। দুঃশাসন ও শকুনি গজসৈন্যদ্বারা বৃকোদরকে পরিবেষ্টিত করিয়া ক্ষুদ্রক-অস্ত্ৰদ্বারা নিপীড়িত করিতে লাগিলেন। তখন ভীমসেন শরনিকরে রোষান্বিত দুৰ্য্যোধনকে বিমুখ করিয়া মহাবেগে গজসৈন্যের প্রতি ধাবমান হইলেন এবং তাহাদিগকে সহসা সমাগত সন্দর্শনে যৎপরোনাস্তি ক্রুদ্ধ হইয়া দিব্য-অস্ত্র পরিত্যাগপূর্ব্বক দেবরাজ যেমন বজ্ৰদ্বারা অসুরগণকে নিপীড়িত করিয়াছিলেন, তদ্রূপ সেই করিসৈন্য নিপীড়িত করিলেন। ঐ সময় নভোমণ্ডল শলভসমাচ্ছন্ন [পতঙ্গগণে আচ্ছাদিত] পাবকের ন্যায় ভীমশরে পরিবৃত হইল। অনিল যেরূপ জলদজাল সঞ্চালিত করে, তদ্রূপ ভীমসেন এক সমবেত সহস্র সহস্র মাতঙ্গযুথবিদ্রাবিত করিতে লাগিলেন। সুবর্ণজালজড়িত মণিমণ্ডিত সৌদামিনীসম্বলিত অম্বুদসদৃশ মাতঙ্গগণ ভীমসেনের শরে নিপীড়িত হইয়া চতুর্দ্দিকে পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল; কোন কোনটা বিদীর্ণহৃদয় হইয়া ভূতলে নিপতিত হওয়াতে পৃথিবীমণ্ডল বিশীর্ণপর্ব্বতসমাচ্ছন্ন বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। রত্নখচিত গজারোহিগণ ইতস্ততঃ নিপতিত থাকাতে বোধ হইতে লাগিল যেন, ক্ষীণপুণ্য গ্রহসমুদয় ভূতলে নিপতিত হইয়াছে।

“হে মহারাজ! এইরূপে নাগগণ ভীমসেনের শরনিকরে গতশুণ্ড ও কুম্ভসকল বিদীর্ণ হওয়াতে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া পলায়ন করিতে লাগিল; কোন কোনটা শরবিদ্ধ ও ভয়ার্ত্ত হইয়া রুধিরবমনপুৰ্ব্বক পলায়নপর হইয়া ধাতুধারা ধরাধরের ন্যায় শোভা ধারণ করিল। ঐ সময় আমরা দেখিলাম, মহাবীর ভীমসেন ভীষণ ভুজঙ্গসদৃশ অগুরুচন্দনাক্ত ভুজদ্বয়দ্বারা শরাসন আকর্ষণ করিতেছেন এবং মাতঙ্গগণ তাঁহার অশনিনিঃস্বনসদৃশ জ্যানির্ঘোষ ও তলধ্বনি শ্রবণে মলমূত্র পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করিতেছে। হে মহারাজ! তৎকালে ভীমসেন একাকী সেই অদ্ভুত কাৰ্য্য সম্পাদন করিয়া সৰ্ব্বভূতনিহন্তা রুদ্রের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন।”