৬৭. অর্জ্জুন-যুধিষ্ঠিরসাক্ষাৎকার—স্বপ্নদৃষ্টবৎ প্রশ্ন

৬৭তম অধ্যায়

অর্জ্জুন-যুধিষ্ঠিরসাক্ষাৎকার—স্বপ্নদৃষ্টবৎ প্রশ্ন

“যুধিষ্ঠির কহিলেন, ‘হে দেবকীপুত্র! হে ধনঞ্জয়! তোমাদের মঙ্গল ত’? আজ আমি তোমাদের দর্শনে সাতিশয় প্রীত হইলাম। তোমরা অক্ষতশরীরে নিরুপদ্রবে কর্ণকে নিহত করিয়াছ। প্রধান মহারথ লোকবিখ্যাত মহাবীর সূতপুত্র সমরাঙ্গনে আশীবিষসদৃশ ও সমস্ত শস্ত্ৰপারদর্শী কৌরবগণের অগ্রগামী এবং বর্ম্মের ন্যায় উহাদিগের রক্ষক ছিল। বৃষসেন ও সুষেণ তাঁহাকে রক্ষা করিতেছিল। ঐ মহাবীর পরশুরামের নিকট দুর্জয় অস্ত্র প্রাপ্ত হইয়াছিল। সে সৈন্যমুখে গমন করিয়া কৌরবগণকে রক্ষা ও শত্ৰুদিগকে মর্দ্দন করিত এবং সতত দুর্য্যোধনের হিতসাধনে তৎপর থাকিয়া আমাদের নিতান্ত ক্লেশকর হইয়াছিল। পুরন্দরের সহিত দেবগণও উহাকে পরাভূত করিতে পারিতেন না। তোমরা ভাগ্যক্রমে আজ সেই অনলের ন্যায় তেজস্বী, অনিলের ন্যায় বেগশালী, পাতালসদৃশ গম্ভীর, সুহৃদগণের আহ্লাদবর্দ্ধন ও আমার মিত্রগণের অন্তস্বরূপ মহাবীরকে বিনষ্ট করিয়া অসুরনিহন্তা অমরদ্বয়ের ন্যায় আমার নিকটে উপস্থিত হইয়াছ। অদ্য সেই সর্ব্বলোকজিঘাংসু কৃতান্তসদৃশ মহাবীর সূতপুত্রের সহিত আমার ঘোরতর যুদ্ধ হইয়াছিল। সে সাত্যকি, ধৃষ্টদ্যুম, নকুল, সহদেব, শিখণ্ডী, দ্রৌপদীর পাঁচপুত্র ও পাঞ্চালগণকে পরাজয়পূর্ব্বক তাঁহাদের সমক্ষেই আমার রথধ্বজ ছিন্ন, পার্ষ্ণি সারথিদ্বয় ও অশ্বগণকে নিহত এবং আমাকে পরাজিত করিয়া সমরাঙ্গনে আমার অনুসরণ করিয়া আমার প্রতি অনেক পরুষবাক্য প্রয়োগ করিয়াছে। অধিক কি বলিব, আমি কেবল ভীমসেনের প্রভাবেই অদ্য জীবিত আছি। কর্ণকৃত অপমান আমার নিতান্ত অসহ্য বোধ হইতেছে। আমি যাহার ভয়ে ত্রয়োদশ বৎসর দিবারাত্রিমধ্যে কখনই নিদ্রিত বা সুখী হই নাই, এক্ষণে তাহার প্রতি বিদ্বেষবুদ্ধি হওয়াতে নিতান্ত সন্তপ্ত হইতেছি। আমি বাধ্রীণস [বাণসপক্ষীর গণ্ড কৃষ্ণবর্ণ, মস্তক রক্তবর্ণ, পক্ষ শ্বেতবর্ণ; সুতরাং লোভনীয়। উহাকে ধরিতে কাহার না ইচ্ছা হয়? বাধ্রীণসপক্ষী ধরিবার জন্য ব্যাধেরা যেরূপ আগ্রহান্বিত হইয়া থাকে, রাজা যুধিষ্ঠিরকে বন্দী করিবার জন্য কৌরবেরাও তদ্রূপ যত্নশীল] বিহঙ্গমের ন্যায় আপনার মরণসময় উপস্থিত হইয়াছে জানিয়া কর্ণের নিকট হইতে পলায়ন করিয়াছি। কিরূপে কর্ণকে বিনাশ করিব, এই চিন্তাতেই আমার বহুকাল অতিবাহিত হইয়াছে। আমি বিনিদ্র অবস্থায়ও সতত কর্ণকে স্বপ্ন দেখিতাম। আমি কর্ণের ভয়ে ভীত হইয়া যে স্থানে গমন করিতাম, সেই স্থানেই তাহাকে অগ্রবর্তী অবলোকন করিতাম। সেই সমরে অপরাঙ্মুখ মহাবীর আজ আমার অশ্ব ও রথ ধ্বংস করিয়া আমাকে পরাজয়পূর্ব্বক জীবিত-অবস্থায় পরিত্যাগ করিয়াছে। আজ কর্ণ যখন আমাকে পরাভূত করিল, তখন আমার জীবনে বা রাজ্যে প্রয়োজন কি? পূর্ব্বে ভীষ্ম, কৃপ বা দ্রোণাচাৰ্য্য হইতে আমার যে অবস্থা হয় নাই, আজ মহারথ সূতপুত্র হইতে তাহা হইয়াছে। এই নিমিত্তই আমি বিশেষরূপে তাহার মৃত্যুবৃত্তান্ত জিজ্ঞাসা করিতেছি।

‘হে কৌন্তেয়! মহারথ সূতপুত্র যুদ্ধে ইন্দ্রতুল্য, পরাক্রমে যমতুল্য ও অস্ত্রপ্রয়োগে পরশুরামতুল্য। ঐ মহাবীর সর্ব্বযুদ্ধবিশারদ ও ধনুর্দ্ধরদিগের অগ্রগণ্য; ধৃতরাষ্ট্র তোমার নিধনার্থেই পুত্রগণের সহিত কর্ণের অভিবাদন করিতেন এবং সমস্ত যোধগণমধ্যে কর্ণকেই তোমার মৃত্যু বলিয়া স্থির করিয়াছিলেন। হে পুরুষপ্রবীর! তুমি কিরূপে সুহৃদ্‌গণসমক্ষে রুরু[কৃষ্ণসারমৃগ]মস্তকচ্ছেদী সিংহের ন্যায় সেই যুদ্ধে প্রবৃত্ত সূতনন্দনের মস্তকচ্ছেদন করিলে, তাহা এক্ষণে আমার নিকট কীৰ্ত্তন কর। হে মহাত্মন্‌! যে দুরাত্মা তোমার সহিত সংগ্রাম করিবার অভিলাষে চতুর্দ্দিকে তোমার অনুসন্ধান করিয়া কহিয়াছিল, যে ব্যক্তি আমাকে অর্জ্জুনকে দেখাইয়া দিবে, আমি তাহাকে ছয়টি হস্তিযুক্ত রথ প্রদান করিব, সেই সূতপুত্র কি তোমার কঙ্কপত্রসমলঙ্কৃত সুনিশিত শরনিকরে সমাহত হইয়া ভূতলে শয়ান রহিয়াছে? দুরাত্মা দুর্য্যোধনের প্রশ্রয়ে নিতান্ত গর্ব্বিত সূতপুত্র তোমার অন্বেষণপূর্ব্বক চতুর্দ্দিকে ভ্রমণ করিয়াছিল, তুমি তাহাকে সংহার করিয়া আমার অতিশয় প্রিয়কার্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াছ। যে বীরাভিমানী দুরাত্মা তোমার দর্শনলাভার্থ প্রদর্শক ব্যক্তিকে হস্তী, গো, অশ্ব ও সুবর্ণময় রথ প্রদান করিতে উদ্যত হইয়াছিল, যে তোমার সহিত যুদ্ধ করিবার নিমিত্ত সততই স্পর্ধা করিত, যে কৌরবসভায় আত্মশ্লাঘা করিয়াছিল এবং যে দুর্য্যোধনের অতিশয় প্রিয়প্রাত্র ছিল, অদ্য তুমি কি সেই বলমদমত্ত সূতপুত্রকে সংহার করিয়াছ? সে কি তোমার সহিত সমরে সমাগত ও তোমার শরাসনচ্যুত রুধিরপায়ী শরে বিদীর্ণকলেবর হইয়া সমরাঙ্গনে শয়ন করিয়াছে? দুর্য্যোধনের ভুজযুগল কি ভগ্ন হইয়াছে? যে দুরাত্মা সভামধ্যে দুৰ্য্যোধনকে পুলকিত করিয়া ‘আমি ধনঞ্জয়কে বিনাশ করিব’ এই দর্পপূর্ণ বাক্যে আত্মশ্লাঘা করিয়াছিল, তাহার সেই বাক্য ত’ সত্য হইল না? যে নির্ব্বোধ ‘অর্জ্জুন জীবিত থাকিতে আমি কখনই পদপ্রক্ষালন করিব না’ বলিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল, আজ তুমি কি সেই কর্ণকে সংহার করিয়াছ? যে দুষ্ট সভামধ্যে কৌরবগণসমক্ষে কৃষ্ণকে কহিয়াছিল, ‘হে কৃষ্ণে! তুমি নিতান্ত দুর্ব্বল পতিত পাণ্ডবগণকে কেন পরিত্যাগ করিতেছ না? অর্জ্জুন! তুমি কি তাহার দর্প চূর্ণ করিয়াছ? যে হতভাগ্য আমি বাসুদেবের সহিত ধনঞ্জয়কে সংহার না করিয়া কদাচ প্রতিনিবৃত্ত হইব না বলিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল, সেই পাপাত্মা কি তোমার শরনিকরে বিদীর্ণকলেবর হইয়া সমরাঙ্গনে শয়ন করিয়াছে? হে ধনঞ্জয়! সৃঞ্জয় ও কৌরবগণের সমাগমকালে যেরূপ যুদ্ধ হইয়াছিল, তাহা বোধ হয়, তোমার অবিদিত নাই। ঐ যুদ্ধে দুরাত্মা কর্ণ আমাকে এইরূপ দুর্দ্দশাপন্ন করিয়াছে; তুমি কি গাণ্ডীবনির্ম্মুক্ত প্রজ্বলিত বিশিখসমূহদ্বারা সেই মন্দবুদ্ধি কুণ্ডলালঙ্কৃত মস্তক ছেদন করিয়াছ? আমি কর্ণের শরে একান্ত নিপীড়িত হইয়া চিন্তা করিয়াছিলাম যে, তুমি অদ্য নিঃসন্দেহ সূতপুত্রকে সংহার করিবে। আমার সেই চিন্তা ত’ নিষ্ফল হয় নাই? দুৰ্য্যোধন যে সূতপুত্রের বলবীর্য্যের উপর নির্ভর করিয়া গৰ্ব প্ৰকাশপূর্ব্বক আমাদিগের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করিত, তুমি কি অদ্য পরাক্রম প্রকাশপূর্ব্বক দুর্য্যোধনের আশ্রয়স্বরূপ সেই কর্ণকে বিনষ্ট করিয়াছ? যে দুরাত্মা পূৰ্বে সভামধ্যে কৌরবগণসমক্ষে আমাদিগকে ষণ্ডতিল বলিয়াছিল, যে হাস্যমুখে দুঃশাসনকে দ্যূতনির্জ্জিত দ্রৌপদীকে বলপূর্ব্বক আনয়ন করিতে কহিয়াছিল এবং যে ক্ষুদ্রাশয় রথাতিরথ সংখ্যাকালে অর্দ্ধরথরূপে নির্দ্দিষ্ট হইয়া শস্ত্রধরাগ্রগণ্য পিতামহকে তিরস্কার করিয়াছিল, সেই দুর্ম্মতিপরতন্ত্র সূতপুত্র কি তোমার শরে বিনষ্ট হইয়াছে? হে ধনঞ্জয়! আমার হৃদয়ে অপমান সমীরণসন্ধুক্ষিত [বায়ুদ্বারা সমধিক উদ্দীপিত] রোষানল নিরন্তর প্রজ্বলিত হইতেছে, আজ তুমি “কর্ণ আমার শরে বিনষ্ট হইয়াছে” এই কথা বলিয়া উহা নির্ব্বাণ কর। সূতপুত্রের বিনাশসংবাদ আমার প্রার্থনীয়; অতএব তুমি বল, কিরূপে তাহাকে সংহার করিলে? হে বীর! বৃত্রাসুর নিহত হইলে ভগবান্ বিষ্ণু যেমন পুরন্দরের আগমন প্রতীক্ষা করিয়াছিলেন, তদ্রূপ আমিও এতাবৎকাল তোমার আগমনপ্রতীক্ষায় অবস্থান করিতেছিলাম।’ ”