১২২. দণ্ডোৎপত্তি—বসুহোম-মান্ধাতার বৃত্তান্ত

১২২তম অধ্যায়

দণ্ডোৎপত্তি—বসুহোম-মান্ধাতার বৃত্তান্ত

ভীষ্ম কহিলেন, “হে ধৰ্ম্মরাজ! আমি এই উপলক্ষে একটি পুরাতন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। পূৰ্ব্বে অঙ্গদেশে বসুহোমনামে এক তপানুষ্ঠাননিরত ধর্ম্মপরায়ণ নরপতি ছিলেন। তিনি স্বীয় ধৰ্ম্মপত্নীসমভিব্যাহারে দেবতা, পিতৃ ও ঋষিগণের পূজিত মুঞ্জপৃষ্ঠনামক হিমাচলের শৃঙ্গে বাস করিতেন। মহাত্মা পরশুরাম ঐ শৃঙ্গে মুঞ্জবটের মূলে অবস্থানপূর্ব্বক মস্তকে জটাবন্ধন করিয়াছিলেন বলিয়া সংশিতব্রত [কঠোর ব্রতধারী] মহর্ষিগণ ঐ প্রদেশকে মুঞ্জপৃষ্ঠ বলিয়া কীৰ্ত্তন করেন। মহারাজ বসুহোম ঐ স্থানে অবস্থানপূৰ্ব্বক তপানুষ্ঠান করিয়া ক্রমে বিবিধ গুণে সমলঙ্কৃত ব্রাহ্মণগণের সম্মানিত ও দেবর্ষিতুল্য হইয়া উঠিলেন।

“কিয়দ্দিন পরে একদা দেবরাজের সখা শত্ৰুসূদন মহারাজ মান্ধাতা অঙ্গরাজের নিকট আগমনপূৰ্ব্বক তাঁহাকে তপস্যায় অনুরক্ত দেখিয়া বিনীতভাবে তাঁহার সম্মুখে দণ্ডায়মান হইলেন। তখন মহারাজ বিসুহোম মান্ধাতাকে অবলোকন করিয়া পাদ্য-অর্ঘ্য প্রদানপূর্ব্বক তাঁহার রাজ্যের সর্ব্বাঙ্গীণ কুশলবার্ত্তা” জিজ্ঞাসা করিলেন এবং কহিলেন, ‘মহারাজ! আজ্ঞা করুন, আমাকে আপনার কি কাৰ্য্য সাধন করিতে হইবে?’

“তখন মহীপতি মান্ধাতা যারপরনাই প্রীত হইয়া মহাপ্রাজ্ঞ বসুহোমকে কহিলেন, নরনাথ! আপনি বৃহস্পতির সমুদয় মত ও শুক্রাচার্য্যবিবেচিত সমুদয় শাস্ত্র অবগত আছেন, অতএব কিরূপে দণ্ড উৎপন্ন হইল, উহার উৎপত্তির কারণ কি আর কি নিমিত্তই বা উহার ভার ক্ষত্রিয়ের প্রতি অর্পিত হইল, তৎসমুদয় আমার নিকটে কীৰ্ত্তন করুন, আমি আপনাকে গুরুদক্ষিণা প্রদান করিতেছি।।

ব্রহ্মার যজ্ঞে প্রাদুর্ভূত দণ্ডের প্রয়োগ-প্রক্রিয়া

“বসুহোম কহিলেন, `মহারাজ! যেরূপে প্রজাগণের নিয়মরক্ষার্থ ধৰ্ম্মের আত্মস্বরূপ সনাতন দণ্ড সমুদ্ভূত হইল, তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। পূর্বে সৰ্ব্বলোকপিতামহ ভগবান ব্রহ্মা যজ্ঞ করিতে বাসনা করিয়া কুত্রাপি আপনার তুল্য পুরোহিত প্রাপ্ত হইলেন না। তখন তিনি আপনার মস্তকে এক গর্ভ ধারণ করিলেন। ঐ গর্ভ বহুকাল ব্রহ্মার মস্তকে রহিল। ক্রমে সহস্র বর্ষ পরিপূর্ণ হইলে একদা ভগবান কমলযোনি ক্ষুৎ [হাঁচি] পরিত্যাগ করিলেন। ঐ অবসরে সেই গর্ভ তাঁহার মস্তক হইতে নিঃসৃত হইয়া করতলে নিপতিত হইল। ঐ গর্ভসম্ভূত প্রজাপতি ক্ষুপনামে প্রসিদ্ধ হইয়াছিলেন। তনন্তর ভগবান্ ব্রহ্মা সেই মহাত্মা ক্ষুপকে পৌরোহিত্য প্রদানপূৰ্ব্বক যজ্ঞ আরম্ভ করিলেন। পিতামহের যজ্ঞ আরম্ভ হইলে দণ্ড অচিরাৎ অন্তর্হিত হইল। তখন প্রজাগণ সকলেই উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। কার্য্যাকার্য্য, ভক্ষাভক্ষ্য, পেয়াপেয় ও গম্যাগম্যের [বিবাহের যোগ্য-অযোগ্যের] কিছুমাত্র বিচার রহিল না। সকলেই পরস্পরের প্রতি হিংসা প্রকাশ করিতে লাগিল; নিজস্ব ও পরস্বের[পরধনের] কিছুমাত্র ইতরবিশেষ রহিল না। প্রজাগণ আমিষগধ্রু কুক্কুরগণের ন্যায় পরস্পরের নিকট বলপূৰ্ব্বক দ্রব্য অপহরণ ও দুর্ব্বলগণকে নিপীড়ন করিতে লাগিল। এইরূপে সমুদয় জগৎ বিশৃঙ্খল হইয়া উঠিলে সৰ্ব্বলোকপিতামহ ভগবান্ ব্রহ্মা সনাতন বিষ্ণুকে পূজা করিয়া দেবদেব মহাদেবকে কহিলেন, “ভগবন্! যাহাতে প্রজাগণমধ্যে এইরূপ বিশৃঙ্খলতা না থাকে, আপনি কৃপা করিয়া তাহার উপায়-বিধান করুন।”

‘তখন ভগবান্ শূলপাণি বহুক্ষণ চিন্তা করিয়া স্বয়ং দণ্ডের সৃষ্টি করিলেন। ঐ সময় নীতিদেবী সরস্বতীর অনুগ্রহে সেই দণ্ড হইতে ত্রিলোকবিশ্রুত দণ্ডনীতির সৃষ্টি হইল। অনন্তর শূলবরায়ুধ [শূল ও বরধারী] ভগবান্ মহাদেব চিন্তা করিয়া সহস্রাক্ষ ইন্দ্রকে দেবগণের, বৈবস্বত যমকে পিতৃগণের, কুবেরকে ধন ও রাক্ষসগণের, সুমেরুকে পর্ব্বতসমুদয়ের, সমুদ্রকে নদীকুলের, বরুণকে জল ও অসুরগণের, মৃত্যুকে প্রাণের, ভাস্কর ও হুতাশনকে তেজের, ঈশানকে রুদ্রগণের, বশিষ্ঠকে বিপ্রগণের, নিশাকরকে নক্ষত্রমণ্ডলের, অংশুমানকে লতাজালের, দ্বাদশভুজ ভগবান কুমারকে ভূতগণের, কালকে মৃত্যু ও সুখদুঃখের এবং ক্ষুপকে সমুদয় লোকের আধিপত্য প্রদান করিলেন। কিয়দ্দিন পরে লোকপিতামহ ব্রহ্মার যজ্ঞ সুসম্পন্ন হইলে দেবাদিদেব মহাদেব সেই ধৰ্ম্মরক্ষক দণ্ড গ্রহণপূৰ্ব্বক বিষ্ণুকে প্রদান করিলেন। তৎপরে ভগবান্ বিষ্ণু অঙ্গিরাকে, মহর্ষি অঙ্গিরা ইন্দ্র ও মরীচিকে, মরীচি ভৃগুকে, ভৃগু ঋষিগণকে, ঋষিগণ লোকপালদিগকে, লোকপালেরা ক্ষুপকে, ক্ষুপ বৈবস্বত মনুকে এবং মনু ধৰ্ম্মার্থের সূক্ষ্মকারণ অবগত করিবার নিমিত্ত স্বীয় সন্তানগণকে সেই দণ্ড প্রদান করেন।

‘হে মহারাজ! স্বেচ্ছাচারী হইয়া ন্যায়-অন্যায় অবধারণপূৰ্ব্বক দণ্ডবিধান করা কর্ত্তব্য। দুষ্টনিগ্রহের নিমিত্তই দণ্ডের সৃষ্টি হইয়াছে। রাজারা কেবল ভয়প্রদর্শনার্থ প্রজাগণের অর্থ গ্রহণ করিবেন। অল্প কারণে প্রাজাগণকে নিতান্ত পীড়িত, নিহত বা নির্ব্বাসিত করা তাঁহাদিগের কর্ত্তব্য নহে। বৈবস্বত মনু প্রজারক্ষার্থ ভূমণ্ডলে দণ্ড প্রচারিত করিয়াছেন। ঐ দণ্ড তদবধি প্রজারক্ষণে নিযুক্ত রহিয়াছে। প্রথমত, পরাক্রমশালী ভগবান ইন্দ্রই সমুদয় প্রজা পালন করিতেন। তৎপরে ইন্দ্র হইতে অগ্নি, অগ্নি হইতে বরুণ, বরুণ হইতে প্রজাপতি, প্রজাপতি হইতে ধর্ম্ম, ধৰ্ম্ম হইতে ব্রহ্মার পুত্র সনাতন ব্যবসায়, ব্যবসায় হইতে তেজ, তেজ হইতে ওষধি, ওষধি হইতে পর্ব্বত, পর্ব্বত হইতে রস ও রসগুণ, তাহা হইতে নির্ঋতিদেবী, ঐ দেবী হইতে জ্যোতি, জ্যোতি হইতে বেদ, বেদ হইতে ভগবান্ মহাদেব, মহাদেব হইতে বিশ্বদেবগণ, বিশ্বদেবগণ হইতে ঋষিগণ, ঋষিগণ হইতে ভগবান্ চন্দ্র, চন্দ্র হইতে সনাতন দেবগণ এবং দেবগণ হইতে ব্রাহ্মণগণ প্রজাপালনের ভার গ্রহণ করেন। এক্ষণে ক্ষত্রিয়গণ ব্রাহ্মণগণ হইতে সেই ভার গ্রহণ করিয়া ধৰ্ম্মানুসারে প্রজাপালন করিতেছেন। এই স্থাবরজঙ্গম পরিপূর্ণ পৃথিবী ক্ষত্রিয়গণের প্রভাবেই শাসিত হইয়া থাকে। দণ্ড সতত প্ৰজাগণের প্রতি জাগরিত রহিয়াছে। পিতামহসদৃশ দণ্ডের প্রভাবেই সমুদয় জগৎ শাসিত হইতেছে। সাক্ষাৎ কালস্বরূপ ভূতভাবন দেবাদিদেব মহাদেব আদি, মধ্য ও শেষ এই তিন কালেই নিরন্তর জাগরিত রহিয়াছেন। দণ্ডও ঐ তিন কালেই জনসমাজে বিরাজিত থাকে। অতএব ধৰ্ম্মপরায়ণ নরপতি ন্যায়ানুসারে বিচার করিয়া দণ্ড প্রয়োগ করিবেন।

“হে ধৰ্ম্মরাজ! যে ব্যক্তি মহারাজ বসুহোমের এই ইতিহাস অবহিতচিত্তে শ্রবণ করে, তাহার সমুদয় মনোরথ পূর্ণ হয়। এই আমি তোমার নিকট সৰ্ব্বলোকনিয়ন্তা দণ্ডের বিষয় সবিস্তর কীৰ্ত্তন করিলাম।”