১০৪. অর্থাভাবকালে কৰ্ত্তব্য—ক্ষেমদর্শীর অবস্থা

১০৪তম অধ্যায়

অর্থাভাবকালে কৰ্ত্তব্য—ক্ষেমদর্শীর অবস্থা

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! ধর্ম্মপরায়ণ মহীপতি অর্থাভাবে সৈন্যবিহীন ও অমাত্যকর্ত্তৃক পরাভূত হইলে কি উপায়ে সুখ লাভ করিবেন, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! আমি এই উপলক্ষে কোশলরাজপুত্র ক্ষেমদর্শীর ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। পূৰ্ব্বকালে রাজকুমার ক্ষেমদর্শী ক্ষীণবল ও ঘোরতর বিপদে নিপতিত হইয়া মহর্ষি কালকবৃক্ষীয়ের নিকট আগমনপূর্ব্বক তাঁহাকে অভিবাদন করিয়া কহিয়াছিলেন, “হে ভগবন্‌! মাদৃশ ব্যক্তি বারংবার রাজ্যলাভের চেষ্টা করিয়াও যদি তদ্বিষয়ে কৃতকাৰ্য্য হইতে না পারে, তাহা হইলে তাহার মরণ, চৌর্য্য ও পরাশ্রয়গ্রহণ প্রভৃতি নীচকৰ্ম্ম ভিন্ন আর যাহা কৰ্ত্তব্য থাকে, কীৰ্ত্তন করুন। ভবাদৃশ নানাবিদ্যাবিশারদ পণ্ডিত ও কৃতজ্ঞ লোকেরাই শারীরিক বা মানসিক পীড়ায় সমাক্রান্ত ব্যক্তিদিগকে আশ্রয় দান করিয়া থাকেন। বিষয় বাসনা পরিত্যাগ করা মনুষ্যের অবশ্য কর্ত্তব্য। সাংসারিক প্রীতি ও শোক পরিত্যাগপুৰ্ব্বক জ্ঞানরূপ ধনলাভ করিতে পারিলেই লোক পবিত্র সুখ অনুভব করিতে সমর্থ হয়। যাঁহারা অর্থজনিত ইন্দ্রিয়সুখে আসক্ত থাকে, আমার মতে তাঁহারা নিতান্ত শোচনীয়। দেখুন, আমার প্রভূত অর্থ স্বপ্নসম্ভূত সম্পত্তির ন্যায় নষ্ট হইয়া গিয়াছে। যাঁহারা বিপুল অর্থ পরিত্যাগ করিতে পারেন, তাঁহাদের তুল্য ক্ষমতাশালী আর কেহই নাই। আমার এক্ষণে কিছুমাত্র অর্থ নাই, তথাপি আমি অর্থমায়াপরিত্যাগে সমর্থ হইতেছি না। যাহা হউক, হে মহর্ষে! এক্ষণে আমি সম্পত্তিবিহীন, কাতর ও নিতান্ত দুরবস্থাগ্রস্ত হইয়াছি। অতঃপর যাহাতে অন্যবিধ সুখ অনুভব করিতে পারি, আপনি তাহার উপদেশ প্রদান করুন।

কালকবৃক্ষীয়মহর্ষির উপদেশ

“তেজঃপুঞ্জকলেবর মহর্ষি কালকবৃক্ষীয় রাজপুত্ৰকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া কহিলেন, ‘রাজকুমার! তুমি সর্ব্বাগ্রে আপনাকে ও আপনার অধিকৃত দ্রব্যজাতকে অনিত্য বলিয়া জ্ঞান এবং যেসকল পদার্থ বর্ত্তমান আছে বলিয়া বোধ করিতেছ, তৎসমুদয় নাই বলিয়া বিশ্বাস কর। প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা ঐরূপ সিদ্ধান্ত করিয়াই ঘোরতর বিপদকালেও ব্যথিত হয়েন না। যাহা যাহা হইয়া গিয়াছে এবং যাহা যাহা হইবে, তৎসমুদয়ই মিথ্যা, তুমি এইরূপ স্থিরনিশ্চয় হইতে পারিলেই অধৰ্ম্ম হইতে বিমুক্ত হইবে। পূর্ব্বপুরুষেরা যেসমস্ত ধনধান্যাদি সঞ্চিত করিয়া গিয়াছেন, তৎসমুদয়ই তাঁহাদের সহিত বিনষ্ট হইয়াছে, ইহা বুঝিতে পারিলে কোন ব্যক্তি অনুতাপিত হয়? দৈবের অনুল্লঙ্ঘনীয়তা প্রভাবে অতুল ঐশ্বৰ্য্যশালী ব্যক্তি এককালে নিৰ্দ্ধন হইয়া যায় এবং যাহার কিছুমাত্র সম্পত্তি নাই, তাহার বিপুল ধনাগম হইয়া থাকে। শোকপ্রকাশ করিলে অর্থাগমের কিছুমাত্র সম্ভাবনা নাই, অতএব শোক করা কোনমতেই বিধেয় নহে। আজ তোমার পিতা ও পিতামহগণ কোথায় রহিয়াছেন? এক্ষণে তুমি তাঁহাদিগকে দেখিতে পাইতেছ না। তাঁহারাও তোমাকে দেখিতে পাইতেছেন না। এক্ষণে তাঁহাদের নিমিত্ত শোকপ্রকাশ না করিয়া আপনি চিরজীবী বা নশ্বর, তাহা পৰ্য্যালোচনা কর। তুমি সম্যরূপে বুদ্ধিবৃত্তির পর্য্যালোচনা করিয়া বিবেচনা করিলে নিশ্চয়ই অবগত হইবে যে, তুমি কখনই চিরকাল জীবিত থাকিতে পারিবে না। আমি, কি তুমি, কি শত্ৰু, কি মিত্র এবং কি বিংশতিবর্ষ, কি ত্রিংশবর্ষবয়স্ক মানবগণ সকলকেই কোন না কোন সময়ে কালকবলে প্রবিষ্ট হইতে হইবে, সন্দেহ নাই। কেহই চিরজীবী হইবে না। যদি কোন মনুষ্যের বিপুল ধন বিনষ্ট হয়, তাহা হইলে তিনি সেই ধন আমার নয় বিবেচনা করিয়া আপনার মনের প্রীতিসাধন করিবেন। যাঁহারা অনাগত ও অতীত বিষয় আপনার নহে বিবেচনা করিয়া অদৃষ্টকে বলবান্ বোধ করেন, তাঁহাদিগকেই পণ্ডিত ও সাধু বলিয়া নির্দেশ করা যাইতে পারে। তোমার সদৃশ ও তোমা অপেক্ষা সমধিক বুদ্ধি ও পুরুষকারসম্পন্ন মানবগণ ধনহীন হইয়াও বুদ্ধিবলে পৌরুষ প্রকাশ করিয়া রাজ্যশাসন করিতেছে। তাহারা ত তোমার ন্যায় শোকে অভিভূত হয় নাই। তুমি কি নিমিত্ত বৃথা শোকপ্রকাশ করিতেছ?

“ক্ষেমদর্শী কহিলেন, “ভগবন্! আমি অনায়াসে রাজ্যলাভ করিয়াছিলাম। এক্ষণে কালসহযোগে উহার উচ্ছেদদশা উপস্থিত হওয়াতে আমি নিতান্ত অনুতাপিত হইয়াছি।

“মহর্ষি কহিলেন, ‘মহারাজ! অতীত বা অনাগত বিষয়ের নিমিত্ত শোক করা কর্ত্তব্য নহে। আপনার প্রাপ্য বিষয় লাভ করিতে ইচ্ছা করাই অবশ্য কর্ত্তব্য, অপ্রাপ্য বিষয়ের কামনা করা কদাপি বিধেয় নহে। তুমি অধিকৃত বিষয়ের উপভোগে নিরত থাকিয়া সুখানুভব কর। অনাগত বিষয়ের জন্য কদাচ শোক করিও না। অর্থনাশনিমিত্ত অনুতাপ করা তোমার কর্ত্তব্য নহে। দুর্বুদ্ধি মানবগণই ভূতপূৰ্ব্ব সৌভাগ্য হইতে বঞ্চিত হইয়া বিধাতাকে তিরস্কার করে, অধিকৃত অর্থে সন্তুষ্ট হয় না এবং নীচব্যক্তিদিগকে সম্পত্তিশালী বলিয়া বোধ করিয়া থাকে। ঐ সকল কারণবশতঃ তাহাদিগকে অধিকতর দুঃখ ভোগ করিতে হয়। আত্মাভিমানী ব্যক্তিরাই ঈর্ষাপরায়ণ হইয়া থাকে। তুমি ত’ কদাপি ঈর্ষাপরবশ হও নাই? যাহা হউক, এক্ষণে তুমি স্বয়ং সম্পত্তিহীন হইয়াও অন্যের সৌভাগ্যদর্শনে কাতর হইও না। নিৰ্ম্মৎসর [মাৎসর্য্যহীন] ব্যক্তিরা কৌশলক্রমে শত্ৰুদিগেরও রাজ্য ভোগ করিতে সমর্থ হয়। যোগধর্ম্মপরায়ণ পণ্ডিতগণ ধনকে অস্থির ও বাসনাবৃদ্ধির নিদান জানিয়া অনায়াসে রাজলক্ষ্মী ও পুত্র-পৌত্রাদি পরিত্যাগ করিয়া থাকেন। অনেকে ঐশ্বৰ্য্য অতিদুর্লভ বিবেচনা করিয়া সংসারস্থ সমুদয় পদার্থ পরিত্যাগ করেন। কিন্তু তুমি বিজ্ঞ হইয়াও অপ্রার্থনীয় অস্থির বিষয়ের অভিলাষ করিয়া দীনভাবে পরিতাপ করিতেছ। এক্ষণে অভিলাষ পরিত্যাগ করাই তোমার কৰ্ত্তব্য।

‘অনর্থ অর্থরূপে এবং অর্থ অনর্থরূপে পরিণত হইয়া থাকে। অনেকে অর্থবৃদ্ধি করিতে গিয়া এককালে নিৰ্দ্ধন হইয়া পড়ে এবং অনেকে অর্থই অনন্ত সুখের মূল, উহা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট পদার্থ আর কিছুই নাই বিবেচনা করিয়া সতত উহার কামনা করে। যে ব্যক্তি নিরন্তর ধন অন্বেষণ করে, তাহার অন্যান্য সমুদয় কার্য্যই নষ্ট হইয়া যায়। যদি কেহ কথঞ্চিৎ স্বীয় প্রার্থিত ধন লাভ করে এবং পরিশেষে উহা বিনষ্ট হইয়া যায়, তাহা হইলে তাহার দুঃখের পরিসীমা থাকে না; সদ্বংশীয় সাধুব্যক্তিরা পারলৌকিক [পরকালের] সুখ কামনা করিয়া লৌকিক সুখ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক ধৰ্ম্মোপার্জ্জনে মনোনিবেশ করেন। ধনলোলুপ ব্যক্তিরা ধনলাভার্থ প্রাণ পৰ্য্যন্ত পরিত্যাগ করিয়া থাকে এবং ধন ব্যতীত জীবনধারণ করা নিরর্থক বলিয়া বোধ করে। হায়! যাহারা এই অচিরস্থায়ী জীবন ধারণ করিয়া ধনতৃষ্ণায় বিমোহিত হয়, তাহাদের ন্যায় নির্ব্বোধ ও শোচনীয় আর কে আছে? যখন সঞ্চিত দ্রব্যমাত্রেরই বিনাশ, জীবিত ব্যক্তিমাত্রেরই মরণ ও সংযোগমাত্রেরই বিয়োগ নির্দ্ধারিত রহিয়াছে, তখন কোন্ বুদ্ধিমান ব্যক্তি সংসারে অনুরাগ প্রকাশ করিবেন? হয় মানবগণ ধনকে, না হয় ধন মানবগণকে পরিত্যাগ করে। বিদ্বান ব্যক্তি ইহা বিবেচনা করিয়া ধননাশ নিবন্ধন কখনই ব্যথিত হয়েন না। এই সংসারে অসংখ্য লোকের ধননাশ ও বন্ধুবিয়োগ হইতেছে। তুমি উহা অবলোকন করিয়া স্থিরচিত্ত হও। ইন্দ্রিয়, মন ও বাক্য সংযত কর এবং অতীত বা অনাগত বিষয়ের নিমিত্ত শোক করিও না। ভবাদৃশ [তোমার মত] মৃদু, দান্ত, সংযতাত্মা ও ব্রহ্মচর্য্যব্রতধারী ব্যক্তিরা সামান্য বস্তুর নিমিত্ত চঞ্চল বা অনুতাপিত হয়েন না। অতি নৃশংস পাপজনক কাপুরুষোচিত ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করাও তোমার উচিত নহে। তুমি বাগ্‌যত ও সকল জীবের প্রতি দয়ালু হইয়া ফলমূল আহার করিয়া একাকী মহাবনে বাস কর। যিনি একাকী অরণ্যমধ্যে বৃহদ্দন্ত [বড় দাঁতওয়ালা] হস্তীর সহিত একত্র বাস করিয়া অল্পলাভে সন্তুষ্ট হয়েন, তাঁহাকে পণ্ডিত বলিয়া গণনা করা যায়; মহাহ্রদ একবার সংক্ষুব্ধ হইয়া আবার আপনিই প্রসন্ন হইয়া থাকে। এক্ষণে তুমি অমাত্যাদিবিহীন হইয়াছ, তোমার ধনলাভেরও সম্ভাবনা নাই; অতএব বোধ হয়, তুমি ঐরূপ বৃত্তি অবলম্বন করিলেই সুখে অবস্থান করিতে সমর্থ হইবে।