১১৭. অকৃতজ্ঞের অধোগতি—কুক্কুর-শরভ-বৃত্তান্ত

১১৭তম অধ্যায়

অকৃতজ্ঞের অধোগতি—কুক্কুর-শরভ-বৃত্তান্ত

ভীষ্ম কহিলেন, “একদা ঐ ব্যাঘ্ৰ মৃগবধ করিয়া তাহাদিগের শোণিতমাংসে আপনার তৃপ্তিসাধনপূৰ্ব্বক পর্ণকুটীর সমীপে শয়ন করিয়া আছে, এমন সময়ে এক বিশাল বিষাণ[দাঁত]সম্পন্ন অতি প্রকাণ্ড মেঘাকার মত্তমাতঙ্গ তথায় আগমন করিল। ব্যাঘ্র সেই বলগর্ব্বিত মদস্রাবী কুঞ্জরকে সমাগত দেখিয়া ভীতচিত্তে মহর্ষির শরণাপন্ন হইল। মহর্ষি তদ্দর্শনে স্নেহপরবশ হইয়া তাহাকে তৎক্ষণাৎ কুঞ্জরত্ব প্রদান করিলেন। আগন্তুক গজ উহাকে মহামেঘের ন্যায় অবলোকন করিয়া ভীতচিত্তে তথা হইতে অপসৃত হইল। এইরূপে ব্যাঘ্র ঋষির প্রভাবে কুঞ্জরত্ব লাভ করিয়া পরমপ্রীতি সহকারে শল্লকীবন [বাবলা-বন] ও পদ্মবনে পর্য্যটন করিয়া বহুকাল অতিক্রম করিল।

“অনন্তর একদা করিকুলান্তক[গজগণের বিনাশক] গিরিকরসস্তুত কেশররাজিবিরাজিত এক ভীষণ কেশরী সেই গজের সমীপস্থিত হইল। হস্তী সিংহকে উপস্থিত দেখিয়া ভীতমনে মহর্ষির নিকট গমন করিল; মহর্ষিও তৎক্ষণাৎ তাহাকে সিংহত্ব প্রদান করিলেন। তখন সে সেই আগন্তুক বন্য সিংহকে তুল্যজাতি বলিয়া লক্ষ্যই করিল না। আগন্তুক সিংহ তাহাকে নিরীক্ষণ করিয়া যারপরনাই ভীত হইল। এইরূপে সেই কুঞ্জর মহর্ষির অনুকম্পায় সিংহত্ব লাভপূৰ্ব্বক সিংহভয় হইতে উত্তীর্ণ হইয়া আশ্রমমধ্যে বাস করিতে লাগিল। অন্যান্য ক্ষুদ্র পশুসকল উহার ভয়ে নিতান্ত ভীত হইয়া জীবনরক্ষাৰ্থ তপোবন হইতে পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল।

“কিয়ৎকাল অতীত হইলে একদা এক সৰ্ব্বপ্রাণীবিনাশক, মহাবলপরাক্রান্ত, শোণিতলোলুপ, অষ্টপদ, ঊর্দ্ধনেত্র বন্য শরভ [অতি ক্রোধনস্বভাব একপ্রকার মৃগজাতীয়] ঐ সিংহকে বিনাশ করিবার নিমিত্ত মহর্ষির আশ্রমে সমুপস্থিত হইল। মহর্ষি আপনার সিংহকে শরভ-ভয়ে ভীত দেখিয়া তৎক্ষণাৎ শরভত্ব প্রদান করিলেন। তখন সেই আগন্তুক শরভ মহর্ষির শরভকে অতি ভীষণ ও মহাবলপরাক্রান্ত দেখিয়া ভীতমনে দ্রুতবেগে তপোবন হইতে পলায়ন করিল। এইরূপে সেই কুক্কুর মহর্ষির অনুকম্পায় শরভত্ব লাভ করিয়া পরমসুখে তাঁহার সন্নিধানে অবস্থান করিতে লাগিল। অন্যান্য মৃগগণ তাহার ভয়ে নিতান্ত ভীত হইয়া জীবরক্ষাৰ্থ তপোবন হইতে চতুর্দিকে পলায়ন করিল। ঐ সময় সেই শরভের বন্য ফলমুল-ভক্ষণে কিছুমাত্র প্রবৃত্তি ছিল না। সে সতত প্রাণীগণের প্রাণসংহার করিয়াই জীবিকানির্ব্বাহ করিত।

“অনন্তর একদা সেই দুর্দ্দান্ত শরভ বলবতী শোণিততৃষ্ণায় একান্ত অভিভূত হইয়া আপনার পরমহিতৈষী মহর্ষিকে সংহার করিবার অভিলাষ করিল। তখন মহাত্মা তপোধন তপোবললব্ধ জ্ঞানচক্ষুঃপ্রভাবে সেই অকৃতজ্ঞের দুরভিসন্ধি অবগত হইয়া উহাকে কহিলেন, ‘অরে পামর! তুই অগ্রে কুক্কুর-যোনিতে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলি, পরে আমার অনুকম্পায় ক্রমে ক্রমে তোর দ্বীপিত্ব, ব্যাঘ্রত্ব, কুঞ্জরত্ব, সিংহত্ব ও পরিশেষে শরভত্ব পৰ্য্যন্ত লাভ হইয়াছে। আমিই স্নেহপরবশ হইয়া তোকে ক্রমশ উন্নত করিয়াছি। এক্ষণে তুই আমাকেই নিরপরাধে বিনাশ করিতে উদ্যত হইয়াছি; অতএব তুই অবিলম্বে পুনরায় স্বীয় পূর্ধ্বতন কুক্কুর যোনি প্রাপ্ত হ।’ মহাত্মা মহর্ষি এইরূপে শাপ প্রদান করিলে সেই মুনিজনদ্বেষ্টা দুষ্টপ্রকৃতি শরভ অচিরাৎ পূর্ব্বরূপ প্রাপ্ত হইল।”