১৩০. আপৎকালের রাজধৰ্ম্মনীতি

১৩০তম অধ্যায়

আপৎকালের রাজধৰ্ম্মনীতি

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে পিতামহ! যে মহীপাল মিত্রশূন্য, বহুশত্রুসম্পন্ন, ক্ষীণকোষ ও হীনবল হয়েন, দুষ্ট অমাত্যগণ সহায় হওয়াতে যাঁহার মন্ত্র প্রকাশিত হইয়া যায়, যিনি রাজ্যভ্রষ্ট, কিংকৰ্ত্তব্যবিমূঢ় ও পররাজ্য বিমর্দ্দিত করিবার অভিলাষে শত্রুসৈন্যের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়েন, যিনি স্বয়ং দুর্ব্বল হইয়া বলবানের সহিত সংগ্রাম আরম্ভ করেন, যিনি সুপ্রণালীক্রমে রাজরক্ষায় অসমর্থ, যাঁহার দেশকালের প্রতি কিছুমাত্র দৃষ্টি নাই এবং অতিশয় প্রজাপীড়ন নিবন্ধন সন্ধি ও ভেদ উভয়ই যাঁহার পক্ষে অতিশয় দুর্ল্লভ, তাহার কি অসৎ উপায় অবলম্বনপূর্ব্বক অর্থগ্রহণ করা কর্ত্তব্য অথবা অর্থ ব্যতিরেকে মৃত্যুই শ্রেয়স্কর?”

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! তুমি এক্ষণে আমাকে অতি নিগুঢ় ধৰ্ম্মের বিষয় জিজ্ঞাসা করিলে। জিজ্ঞাসা না করিলে উহা ব্যক্ত করা নিতান্ত অনুচিত, এই নিমিত্ত আমি ইহার উল্লেখ করি নাই। যিনি শাস্ত্র হইতে অল্পমাত্ৰ ধর্ম্মশ্রবণ করিয়া বুদ্ধিপূৰ্ব্বক তদনুসারে কার্য্যানুষ্ঠান করেন, তিনি সাধু; বুদ্ধিপূর্ব্বক কার্য্যানুষ্ঠান করিলে লোকে ধনাঢ্য হয় কি না, তাহা তুমি আপনার বুদ্ধিপ্রভাবে পর্য্যালোচনা করিতে পার। এক্ষণে ভূপালগণের ব্যবহার সম্পাদনের নিমিত্তই আপদ্ধৰ্ম্ম [আপৎকালের আচরিত ধৰ্ম্ম] কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। কিন্তু উহাদ্বারা যে যথার্থ ধর্ম্মলাভ হয়, তাহা আমি স্বীকার করি না। সুকুমারমতি প্রজাগণকে পীড়ন করিয়া অর্থগ্রহণ করিলে রাজার ধন ও সৈন্যসামন্তের সহিত বিনাশলাভের বিলক্ষণ সম্ভাবনা। পুরুষের শাস্ত্রের প্রতি দৃষ্টি থাকিলে জ্ঞান জন্মে এবং সেই জ্ঞান প্রীতিকর হয়। অজ্ঞানপ্রভাবে লোকে কোন বিষয়েই উপায় অবধারণে সমর্থ হয় না। যিনি জ্ঞানপ্রভাবে উপায় উদ্ভাবন করিতে পারেন, তাঁহার শ্ৰেয়োলাভ হইয়া থাকে, সন্দেহ নাই। রাজার কোষক্ষয় হইলেই বলক্ষয় হয়, অতএব তিনি নির্জ্জন স্থানে জলোৎপাদনের ন্যায় যে কোন প্রকারে হউক, ধনাগমে যত্নবান হইবেন। আপকাল উত্তীর্ণ হইলে প্রজাদিগের প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করা রাজার পরমধর্ম্ম। সমর্থ ব্যক্তির ধর্ম্ম যে প্রকার, বিপন্ন ব্যক্তির ধর্ম্ম সে প্রকার নহে। ধনাগম ব্যতিরেকে তপস্যাদিদ্বারাও ধর্ম্মলাভ হয় বটে, কিন্তু অর্থাগম না থাকিলে প্রাণহানির সম্ভাবনা। অতএব অর্থাগমবিরোধী ধৰ্ম্ম অবলম্বন করা কৰ্ত্তব্য নহে। দুর্ব্বল ব্যক্তি ধর্ম্মপরায়ণ হইয়া ধৰ্ম্মানুগত জীবিকালাভে সমর্থ হয় না এবং তৎকালে তাহার বিশেষ যত্নদ্বারাও ধৰ্ম্মানুসারে বললাভ হওয়া সম্ভবপর নহে; সুতরাং আপৎকালে অধৰ্ম্মও ধৰ্ম্ম বলিয়া পরিগৃহীত হইতে পারে; কিন্তু সূক্ষ্মদর্শী পণ্ডিতেরা কহেন যে, ঐ ধৰ্ম্ম অধৰ্ম্মের মধ্যে পরিগণিত হইয়া থাকে।

যাহা হউক, আপৎকাল অতীত হইলে ক্ষত্রিয় তৎকালকৃত পাপের প্রায়শ্চিত্ত বিধান করিবেন। যাহাতে ধৰ্ম্মের কোন হানি না হয় এবং যাহাতে আপনাকে শক্তহস্তে নিপতিত হইতে না হয়, এইরূপ কাৰ্য্যানুষ্ঠান করাই ভূপতির অবশ্য কর্ত্তব্য। আপনাকে অবসন্ন করা তাঁহার কদাপি বিধেয় নহে। তিনি আপনার ও অন্যের ধর্ম্মের ব্যাঘাত করিয়াও আপনার উদ্ধারসাধনে কৃতকার্য্য হইতে যত্ন করিবেন। ধার্ম্মিকদিগের ধৰ্ম্মে এবং ক্ষত্রিয়দিগের বাহুবল ও উৎসাহে নিপুণতা থাকা নিতান্ত আবশ্যক। ব্রাহ্মণ যেমন বিপদগ্রস্ত হইলে অযাজ্যযাজন ও অভোজ্যান্ন ভোজন করিয়াও নিন্দনীয় হয়েন না, সেইরূপ ক্ষত্রিয়ের বৃত্তিবোধ হইলে তিনি তাপস ও ব্রাহ্মণের ধন ব্যতিরেকে আর সকলেরই ধন গ্রহণ করিতে পারেন। যে ব্যক্তি শত্ৰুকর্ত্তৃক নিপীড়িত বা নিরুদ্ধ হইয়া পলায়ন করিবার চেষ্টা করে, তাহার কি সুপথ বিচার করা উচিত?—কখনই নহে; তৎকালে যে কোন পথদ্বারা হউক, পলায়ন করিবার চেষ্টা করিবে।

“ক্ষত্রিয় কোষ ও বলক্ষয় নিবন্ধন লোকের নিকট নিতান্ত অবমানিত হইলেও তাঁহার ভিক্ষাবৃত্তি বা বৈশ্য ও শূদ্রের জীবিকা অবলম্বন নিতান্ত নিষিদ্ধ। জয়লাভদ্বারা ধনোপাৰ্জনই ক্ষত্রিয়ের প্রধান বৃত্তি। তিনি স্বজাতীয়ের নিকট কদাচ কোন বস্তু প্রার্থনা করিবেন না। যে ব্যক্তি মুখ্যকল্প অবলম্বনপূৰ্ব্বক জীবিকা নির্ব্বাহ করে, আপৎকাল উপস্থিত হইলে গৌণকল্পদ্বারা বৃত্তিলাভ করা তাহার পক্ষে নিতান্ত নিষিদ্ধ নহে। ক্ষত্রিয় আপদগ্রস্ত হইলে অধৰ্ম্ম দ্বারা জীবিকা নিৰ্ব্বাহ করিতে পারে। বৃত্তিক্ষয় নিবন্ধন যখন ব্রাহ্মণেরও অধর্ম্মাচরণ বিহিত হইতেছে, তখন ক্ষত্রিয়ের উহা বিহিত না হইবার কারণ কি? ক্ষত্রিয় আপৎকালে ধনবান ব্যক্তিদিগের নিকট বলপূৰ্ব্বক ধন গ্রহণ করিবেন। নিতান্ত অবসন্ন হওয়া তাঁহার বিধেয় নহে। ক্ষত্রিয় প্রজাদিগের হন্তা ও রক্ষিতা, সুতরাং আপদুদ্ধারের নিমিত্ত বলপূৰ্ব্বক অর্থগ্রহণ করা তাহার পক্ষে নিষিদ্ধ নহে। বিশেষতঃ এই জীবলোকে হিংসা না করিলে কাহারই জীবিকালাভের সম্ভাবনা নাই। অধিক কি, একাকী অরণ্যচারী মুনিও হিংসা না করিয়া জীবিকা নির্ব্বাহ করিতে পারেন না, বিশেষতঃ যে রাজা প্রজাপালন করিবার অভিলাষ করেন, কেবল দৈবের উপর নির্ভর করিলে তাঁহার কোনক্রমেই জীবিকালাভের সম্ভাবনা নাই। আর দেখ, রাজা ও রাজ্য ইহারা পরস্পর পরস্পরকে রক্ষা করিয়া থাকে; অতএব রাজা যেমন আপৎকালে স্বীয় ধনব্যয় করিয়া রাজ্যরক্ষা করেন, তদ্রূপ রাজ্যস্থ প্রজাগণেরও রাজার বিপদ্‌কালে তাঁহাকে রক্ষা করা কর্ত্তব্য। আপদ উপস্থিত হইলেও কোষ, দণ্ড, বল, মিত্র ও অন্যান্য সঞ্চিত দ্রব্য রাষ্ট্র হইতে অন্তরিত করা রাজার কদাপি বিধেয় নহে। শম্বর কহিয়া গিয়াছেন যে, ধর্ম্মবিৎ পণ্ডিতদিগের মতে লোক স্বীয় আহারোপযোগী ধান্য হইতে অগ্রে বীজ রক্ষা করিবে। আপনাদিগের অর্থব্যয়দ্বারা রাজাকে রক্ষা করা প্রজাদিগের সৰ্ব্বতোভাবে কৰ্ত্তব্য। যে রাজার রাজ্য নিতান্ত অবসন্ন হয়, যিনি জীবিকার অভাবে অন্য ব্যক্তির আশ্রয় গ্রহণ বা দেশান্তরে অবস্থান করেন, তাঁহার জীবনে ধিক্‌! কোষ ও বল রাজার মূল, তন্মধ্যে কোষ আবার বলের মূল, বল সকল ধর্ম্মের মূল এবং ধর্ম্ম প্রজাগণের মূল। কিন্তু অন্যকে পীড়ন না করিলে কোষ ও বললাভের সম্ভাবনা নাই, সুতরাং আপৎকালে কোষ ও বললাভাৰ্থ অন্যকে পীড়ন করিলে ভূপালগণকে কদাচ দূষিত হইতে হয় না। লোকে যাগযজ্ঞসম্পাদনার্থ অকাৰ্য্যেরও অনুষ্ঠান করিয়া থাকে। সুতরাং রাজা যখন শুভকার্য্যের অনুষ্ঠান করিবেন বলিয়া অন্যকে পীড়ন করেন, তখন তাঁহাকে কি নিমিত্ত দূষিত হইতে হইবে?

“অর্থের অসদ্ভাব হইলেই প্রজাপীড়ন করিতে হয়; আপৎকালে প্রজাপীড়ন না করিলে কোনক্রমেই অর্থলাভের সম্ভাবনা নাই। রাজা অর্থসংগ্রহের মানসেই বহুব্যয়সাধ্য হস্তিপালনাদি কাৰ্য্যে প্রবৃত্ত হইয়া থাকেন। মেধাবী ব্যক্তি বুদ্ধিপূৰ্ব্বক কার্য্য নির্ণয় করিয়া আপৎকালে অর্থোপার্জ্জনে প্রবৃত্ত হইবে। যেমন পশু, যজ্ঞ ও চিত্তসংস্কার এই তিনটি মোক্ষসাধনের উপযোগী, তদ্রূপ কোষ, বল ও জয় এই তিনটি রাজ্যপুষ্টির প্রধান কারণ। আমি এই স্থলে ধর্ম্মতত্ত্ব-প্রকাশের এক নিদর্শন প্রদর্শন করিতেছি, শ্রবণ কর। লোকে যজ্ঞের নিমিত্ত যূপচ্ছেদনে প্রবৃত্ত হইলে সেই যূপবৃক্ষের সন্নিহিত যেসমস্ত বৃক্ষ উহা ছেদনের বিঘ্ন সম্পাদন করে, তৎসমুদয়কে অবশ্যই ছেদন করিতে হয়। তাহারা আবার ছিন্ন হইয়া নিপতিত হইবার সময় অন্যান্য বৃক্ষসমুদয়কে নিপতিত করে। ঐরূপ যেসমস্ত মনুষ্য রাজার কোষ-সঞ্চয়ের বিলক্ষণ প্রতিবন্ধকতাচরণ করে, তাহাদিগকে বিনাশ না করিলে কদাচ সিদ্ধিলাভের সম্ভাবনা নাই। অর্থদ্বারা ইহলোক, সত্য ও ধর্ম্ম সমুদয়ই আয়ত্ত করা যায়। নির্দ্ধনেরা জীবন্মৃত হইয়া অবস্থান করে। যজ্ঞানুষ্ঠানার্থ যে কোনপ্রকারে হউক, ধন গ্রহণ করিবে। এইরূপ করিলে অধিক দোষে লিপ্ত হইতে হয় না। এক ব্যক্তি কদাচ যুগপৎ ধনসংগ্রহ ও ধনত্যাগ করিতে পারে না। অরণ্যমধ্যে ধনবানের অবস্থান সম্ভবপর নহে। আর যাহারা এই জনসমাজে বাস করিতেছে, তাহাদিগের নিরন্তর পার্থিব ধনরত্নসমুদয় অধিকার করিবার নিমিত্ত ব্যগ্র হইতে দেখা যায়। যাহা হউক, ভূপালগণের রাজ্যরক্ষার তুল্য পরমধর্ম্ম আর কিছুই নাই। সম্পদকালে প্রজাদিগের নিকট প্রচুর পরিমাণে কর গ্রহণ করা নিতান্ত পাপজনক বটে, কিন্তু আপকালে উহাদ্বারা তাদৃশ অধর্ম্ম জন্মিবার সম্ভাবনা নাই। এই জগতে কেহ কেহ দান ও যজ্ঞাদি কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান, কেহ কেহ তপস্যা এবং কেহ কেহ বুদ্ধি ও নিপুণতাদ্বারা ধনসঞ্চয় করিয়া থাকেন। লোকে নিৰ্দ্ধনকে দুর্ব্বল ও ধনবানকে বলবান কহিয়া থাকে। ধনবান লোক সমুদয় বস্তু অধিকার করে ও সকল বিপদ হইতে উত্তীর্ণ হয়। অর্থপ্রভাবে ধর্ম্ম কাম ও উভয় লোকে সদ্গতিলাভ হইয়া থাকে। অতএব লোকে ধর্ম্মানুসারে অর্থলাভের চেষ্টা করিবে। অধৰ্ম্মানুসারে-তাহা লাভ করিতে যেন তাহার কদাচ প্রবৃত্তি না জন্মে।”

রাজধৰ্ম্মানুশাসনপৰ্ব্বাধ্যায় সমাপ্ত