১৪৩. শরণাগত-বাৎসল্য—ভার্গব-মুচুকুন্দ সংবাদ

১৪৩তম অধ্যায়

শরণাগত-বাৎসল্য—ভার্গব-মুচুকুন্দ সংবাদ

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! আপনি সমুদয় শাস্ত্র পরিজ্ঞাত হইয়াছেন; অতএব শরণাগত ব্যক্তিকে প্রতিপালন করিলে যে মহান ধর্ম্মলাভ হয়, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! উত্তম প্রশ্ন করিয়াছ। শরণাপন্ন ব্যক্তিকে রক্ষা করা অতি উৎকৃষ্ট ধর্ম্ম। শিবি প্রভৃতি মহাত্মা মহীপালগণ শরণাগত প্রাণীগণের রক্ষাবিধানপূর্ব্বক পরমগতি লাভ করিয়াছেন। পূৰ্ব্বে এক কপোত শরণাগত শত্রুর যথোচিত সৎকার করিয়া স্বীয় মাংস প্রদানপূর্ব্বক তাহার ক্ষুধাশান্তি করিয়াছিল।”

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! কপোত কিরূপে শরণাগত শত্রুকে স্বীয় মাংস প্রদান করিয়াছিল এবং তাহার কি গতিই বা লাভ হইয়াছিল, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! ভার্গব মহারাজ মুচুকুন্দের নিকট ঐ সৰ্ব্বপাপনাশিনী বিচিত্র কথা কীৰ্ত্তন করিয়া গিয়াছেন, এক্ষণে তুমি উহা শ্রবণ কর। একদা মহারাজ মুচুকুন্দ ভার্গবকে প্রণিপাত করিয়া তাঁহাকে শরণাগত প্রতিপালকের ধর্ম্ম জিজ্ঞাসা করিলে তিনি কহিলেন, মহারাজ! তুমি অবহিত হইয়া এক ধৰ্ম্মকামার্থসম্বলিত অপূৰ্ব্ব ইতিহাস শ্রবণ কর।

কপোতী-ব্যাধ বৃত্তান্ত

“পূৰ্ব্বকালে এক পক্ষিলুব্ধক পাপপরায়ণ ক্ষুদ্রাশয়, নিষাদ কালান্তক যমের ন্যায় অরণ্যমধ্যে পৰ্য্যটন করিত। সেই দুরাত্মার শরীর কাকের ন্যায় কৃষ্ণবর্ণ, নেত্রদ্বয় রক্তবর্ণ, জঙ্ঘা-সুদীর্ঘ, পদদ্বয় খৰ্ব্ব, মুখ প্রকাণ্ড ও হনুদেশ প্রশস্ত ছিল। ঐ পাপাত্মা ঘোরতর নিষ্ঠুরের ব্যবসায় অবলম্বন করাতে তাহার পত্নী ভিন্ন আর সমুদয় সুহৃদ, সম্বন্ধী ও বন্ধুবান্ধব তাহাকে পরিত্যাগ করিয়াছিল। জ্ঞানবান্ লোকে কদাপি পাপীদিগের সহিত সংস্রব রাখিতে বাসনা করেন না। তাহার কারণ, যাহারা দুষ্কৰ্ম্মদ্বারা আপনাদিগের অনিষ্টসম্পাদন করে, তাহাদের দ্বারা অন্যের হিতসাধনের সম্ভাবনা কোথায়? হত্যাকারী নৃশংস নরাধমেরা সর্পের ন্যায় প্রাণীগণের উদ্বেগজনক হইয়া থাকে।

“ঐ পাপাত্মা নিষাদ জালগ্রহণপূৰ্ব্বক সৰ্ব্বদা বনে বনে ভ্রমণ ও পক্ষিগণের প্রাণসংহার করিয়া তাহাদিগকে বিক্রয় করিত। এইরূপে বহুকাল গত হইল, কিন্তু সেই দুরাত্মা কোনক্রমেই আপনার অসৎপ্রবৃত্তিনিবন্ধন অধৰ্ম্ম পরিজ্ঞাত হইতে পারিল না। একদা সেই ব্যাধ অরণ্যে পর্য্যটন করিতেছে, এমন সময়ে বায়ুবেগ সমুত্থিত হইয়া পাদপগণকে উৎপাটিত প্রায় করিতে লাগিল। মুহূর্ত্তমধ্যে নভোমণ্ডল অর্ণবযান[সমুদ্রযান-জাহাজাদি]পরিপূর্ণ সাগরের ন্যায় মেঘজালে সমাচ্ছন্ন ও বিদ্যুন্মালায় বিভূষিত হইল; মুষলধারে অনবরত বারিধারা নিপতিত হওয়াতে বসুন্ধরা ক্ষণকালমধ্যে প্লাবিত হইয়া গেল। ঐ সময় দুরাত্মা নিষাদ শীতার্ত্ত ও বিচেতন হইয়া আকুলিতচিত্তে বনমধ্যে পরিভ্রমণ করিতে লাগিল; কিন্তু সমুদয় অরণ্য জলাকীর্ণ হওয়াতে কুত্রাপি স্থান প্রাপ্ত হইল না। ঐ বৃষ্টির প্রভাবে বিহঙ্গমগণ নিহত ও তরুতলে নিপতিত হইয়াছিল এবং মৃগ, সিংহ ও বরাহগণ উন্নতভূমি আশ্রয় করিয়া অবস্থান ও অন্যান্য বন্য-জন্তুগণ ভয়ার্ত্ত ও শীতার্ত্ত হইয়া অরণ্যে ভ্রমণ করিতেছিল। দুরাত্মা ব্যাধ সেই বাতবৃষ্টিপ্রভাবে নিতান্ত শীতার্ত্ত হইয়া অন্য স্থানে প্রস্থান বা তথায় অবস্থান করিতে সমর্থ হইল না। সেই সময় এক শীতবিহ্বলা কপোতী তাহার নেত্রগোচর হইল। দুরাত্মা নিষাদ তৎকালে স্বয়ং যারপরনাই কষ্টে নিপতিত হইয়াছিল, তথাপি সেই কপোতীকে ভূতলে নিপতিত দেখিবামাত্র স্বীয় পিঞ্জরমধ্যে নিক্ষেপ করিল। স্বয়ং দুঃখে অভিভূত হইয়াও সেই কপোতীকে দুঃখিত করিতে তাহার কিছুমাত্র কষ্ট হইল না। অনন্তর সেই দুরাত্মা নিষাদ সেই অরণ্যজাত পাদপগণের মধ্যে এক মেঘের ন্যায় নীলবর্ণ বৃক্ষ অবলোকন করিল। ঐ পাদপের ছায়া ও ফল ভোগ করিবার নিমিত্ত অসংখ্য বিহঙ্গম উহাতে বাস করিত। বিধাতা পরোপকারের নিমিত্তই সাধুর ন্যায় ঐ তরুর সৃষ্টি করিয়াছিলেন।

“কিয়ৎক্ষণ পরে নভোমণ্ডল নিৰ্ম্মল ও নক্ষত্রজালে মণ্ডিত হইয়া প্রফুল্লকুসুমদলশোভিত [পুষ্পসমূহে শোভিত] বিমল সরোবরের ন্যায় শোভা ধারণ করিল। তখন সেই শীতবিহ্বল নিষাদ আকাশমণ্ডল মেঘনির্ম্মুক্ত ও নক্ষত্রজালে সমাকীর্ণ দেখিয়া চতুর্দ্দিকে দৃষ্টিপাতপূৰ্ব্বক মনে মনে চিন্তা করিল, ‘এক্ষণে রজনী উপস্থিত হইয়াছে এবং আমার গৃহস্ত এখান হইতে অনেক দূর; অতএব অদ্য এই তরুতলেই রজনীযাপন করা কর্ত্তব্য।’ পক্ষিঘাতক নিষাদ মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে বনস্পতিকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিল, ‘তরুগণ! তোমাতে যেসমস্ত দেবতা আশ্রয় করিয়া রহিযাছেন, আমি তাঁহাদিগের শরণাপন্ন হইলাম।’ নিষাদ এই কথা ভূতলে পর্ণশর্য্যা নির্ম্মাণপূর্ব্বক এক শিলার উপর মস্তকসংস্থাপনপূর্ব্বক দুঃখিতচিত্তে শয়ন করিল।”