১২৮. আশায় মানুষের কৃশতা—আশাত্যাগে সবলতা

১২৮তম অধ্যায়

আশায় মানুষের কৃশতা—আশাত্যাগে সবলতা

“নরপতি কহিলেন, মহর্ষিগণ! আমি বীরদ্যুম্ননামক নরপতি। আমার নাম সৰ্ব্বত্র বিখ্যাত আছে। আমার ভূরিদ্যুম্ন নামে এক শিশুসন্তান অদৃশ্য হইয়াছে। আমার একমাত্র পুত্র। আমি তাহার অন্বেষণার্থ অরণ্যে পর্য্যটন করিতেছি; কিন্তু অদ্যাবধি কুত্রাপি তাহার অনুসন্ধান পাইলাম না।

“মহারাজ বীরদ্যুম্ন এই কথা কহিলে মহর্ষি কৃশ তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বপুর্ব্বক অধোবদনে অবস্থান করিতে লাগিলেন; নরপতির বাক্যে কিছুমাত্র প্রত্যুত্তর প্রদান করিলেন না। পূৰ্ব্বে বীরদ্যুম্ন ঐ মহর্ষিকে যথোচিত সমাদর করেন নাই বলিয়া উনি হতাশ হইয়া দীর্ঘতর তপোনুষ্ঠানে মনোনিবেশপূৰ্ব্বক এই সঙ্কল্প করিয়াছিলেন যে, আমি কখনই ক্ষত্রিয় বা অন্য কোন বর্ণের নিকট প্রতিগ্রহ স্বীকার করিব না। আশা মানবগণকে ব্যাকুলিত করে; অতএব আমি সৰ্ব্বপ্রযত্নে সেই আশাকে দূরীকৃত করিব।

“মহর্ষি কৃশ এইরূপে অধোমুখে অবস্থান করিলে রাজা বীরদ্যুম্ন তাঁহাকে তদবস্থ দেখিয়া পুনরায় সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “মহর্ষে! আপনি সব্বার্থদর্শী, অতএব ইহলোকে আশাবান্‌ অপেক্ষা কৃশ কে এবং কোন বস্তুই বা দুর্ল্লভ, তাহা বিশেষরূপে কীৰ্ত্তন করুন।’

“তখন তপঃশীর্ণকলেবর কৃশ নরপতিকে পূৰ্ব্ববৃত্তান্তসকল স্মরণ করাইয়া কহিলেন, ‘রাজন! আশাবান অপেক্ষা কৃশ এবং আশানুরূপ অর্থলাভ অপেক্ষা দুর্ল্লভ আর কিছুই নাই। আমি সেই আশাকৃত অর্থ নিতান্ত দুর্ল্লভ বলিয়া অনেক নরপতির নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা করিয়াছিলাম।’

“তখন নরপতি কহিলেন, ‘মহর্ষে! আমি আপনার বাঙনিস্পত্তিমাত্রেই বুঝিলাম যে, যিনি আশার বশীভূত, তিনি কৃশ এবং যিনি আশাকে জয় করিয়াছেন, তিনিই সবল। আর আশাকৃত অর্থলাভও বেদবাক্যের ন্যায় নিতান্ত দুর্ল্লভ। যাহা হউক, এক্ষণে আমার অন্তঃকরণে আর এক সংশয় উপস্থিত হইয়াছে যে, আপনা অপেক্ষা কৃশ আর কে আছে? যদি ঐ বিষয় গোপনীয় হয়, তাহা হইলে কীৰ্ত্তন করিয়া আমার সন্দেহ ভঞ্জন করুন।’

“কৃশ কহিলেন, ‘মহারাজ! ধৈৰ্য্যগুণসম্পন্ন অর্থ নিতান্ত বিরল অথবা কুত্রাপি বিদ্যমান নাই। আর যিনি কদাপি অর্থীর অবমাননা না করেন, এতাদৃশ ব্যক্তি নিতান্ত দুর্ল্লভ। এই জগতে যাহারা লোকের উপকার করিব বলিয়া স্বীকার করিয়া পরিশেষে সাধ্যানুসারে তাহা সম্পাদন করে না, তাহাদের নিকট যে আশা করা যায়, লোকে যে আশার প্রভাবে কৃতঘ্ন, নৃশংস, অলস ও পরোপকারী ব্যক্তিদিগের নিকট হইতে উপকারলাভের চেষ্টা করে, যাহার প্রভাবে পিতা একমাত্র পুত্র নষ্ট বা প্রোষিত হইলে না পাইয়াও সন্দর্শনলাভে যত্নবান হয়েন, যে আশা বৃদ্ধ রমণীগণকে পুত্ৰপ্ৰসবে সচেষ্ট করে এবং যাহার প্রভাবে পরিণয়াকাঙ্ক্ষিণী [বিবাহ-প্রার্থিনী] কামিনীগণ প্রাপ্তবয়স্ক পাত্রলাভের কথা মাত্র শ্রবণ করিয়া আহ্লাদ সাগরে নিমগ্ন হয়, সেই আশা আমা অপেক্ষা কৃশতর।’

“মহর্ষি কৃশ এই কথা কহিলে মহারাজ সপরিবারে তাঁহার পদতলে নিপতিত হইয়া কহিলেন, ‘ভগবন্! আপনি প্রসন্ন হউন, আমি পুত্রের সহিত সমাগমলাভে নিতান্ত অভিলাষী হইয়াছি। আপনি যাহা যাহা কহিলেন, সমুদয়ই যথার্থ সন্দেহ নাই।’ তখন ধাৰ্ম্মিকশ্রেষ্ঠ ভগবান কৃশ ঈষৎ হাস্য করিয়া বিদ্যা ও তপঃপ্রভাবে অবিলম্বে বীরদ্যুম্নের পুত্রকে তথায় উপনীত করিলেন এবং পরিশেষে স্বীয় দিব্যমূৰ্ত্তি প্রদর্শনপূর্ব্বকনিষ্পাপ ক্রোধবিহীন হইয়া বনমধ্যে বিচরণ করিতে লাগিলেন। হে মহারাজ! আমি স্বয়ং এই বিষয় দর্শন ও শ্রবণ করিয়াছি; অতএব অবিলম্বে কৃশতরী [অতিশয় কৃশতর] আশাকে নিরাকৃত কর।’

“হে যুধিষ্ঠির। মহাত্মা ঋষভ এই কথা কহিলে রাজা সুমিত্র তৎক্ষণাৎ স্বীয় আশা পরিত্যাগ করিলেন। অতএব এক্ষণে তুমিও আমার কথানুসারে আশানিরাকৃত করিয়া হিমালয় পর্ব্বতের ন্যায় সুস্থির হও। তুমি কষ্টের সময় আমার নিকট প্রশ্ন করিয়া উপদেশ গ্রহণ করিতেছ, অতএব আমার বাক্যশ্রবণে অনুতাপিত হইও না।”