১২৩. মোক্ষের ধৰ্ম্ম-অর্থ-কাম-সাপেক্ষতা

১২৩তম অধ্যায়

মোক্ষের ধৰ্ম্ম-অর্থ-কাম-সাপেক্ষতা

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! ধৰ্ম্ম, অর্থ ও কাম কিরূপে নির্ণয় করা যাইতে পারে? লোকে কি উদ্দেশ্যে ঐ সমুদয়ের অনুষ্ঠান করিয়া থাকে? উহাদের উৎপাদক কে এবং উহাদের সংসৃষ্ট [বিচ্ছিন্ন] ও অসংসৃষ্ট [মিলিত অবস্থা] ভাবই বা কিরূপ আর কোন্ কোন্ বস্তুকে নির্ভর করিয়া লোকযাত্রা সম্পূর্ণ নির্ব্বাহ হইতে পারে? আপনি এই সমস্ত বিষয় সবিস্তরে কীৰ্ত্তন করুন। ঐ সমুদয় শ্রবণ করিতে আমার অতিশয় অভিলাষ হইতেছে।”

ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! পুরুষেরা বিশুদ্ধচিত্ত হইয়া ধর্ম্মার্থকামনির্ণয়ে প্রবৃত্ত হইলে এককালে ঐ তিনেরই অনুশীলন করিতে পারে। উহাকে ঐ ত্রিবর্গের সংসৃষ্টভাব কহে। অর্থ ধৰ্ম্মমূলক, কাম অর্থমূলক এবং ধৰ্ম্ম, অর্থ ও কাম এই ত্রিবর্গ সঙ্কল্পমূলক, আর সঙ্কল্প বিষয়মূলক। বিষয়সমুদয় আহারসিদ্ধির উপযোগিতা সম্পাদন করিয়া থাকে। উহারাই ত্রিবর্গের মূল। ত্রিবর্গ হইতে নিবৃত্তিই মোক্ষ, লোকে শরীররক্ষাৰ্থ ধৰ্ম্মের নিমিত্ত অর্থের এবং ইন্দ্রিয়বর্গের প্রীতিসম্পাদনার্থ কামের সেবা করিয়া থাকে। ঐ তিন বর্গই রজোগুণপ্রধান বলিয়া পরিগণিত হয়। উহাদিগকে এককালে মন হইতে পরিত্যাগ না করিয়া অনাসক্তচিত্তে উহাদের অনুশীলন করা আবশ্যক। ত্রিবর্গের অনুশীলন করিতে করিতেই লোকের মোক্ষলাভের ইচ্ছা হইয়া থাকে। ধৰ্ম্ম হইতেই অর্থ ও অর্থ হইতেই ধৰ্ম্ম উৎপন্ন হয়। অজ্ঞানান্ধ মনুষ্যেরা কদাচ ঐরূপ ধৰ্ম্মার্থের ফললাভে সমর্থ হয় না। ফলাভিসন্ধি ধর্ম্মের মল[অসার অংশ]স্বরূপ, দানভোগবিমুখতা অর্থের মলস্বরূপ এবং প্রমোদপরাঙ্মুখতা কামের মলস্বরূপ বলিয়া কীৰ্ত্তিত হইয়া থাকে। যখন ত্রিবর্গ ঐ সকল মল হইতে বিমুক্ত হয়, তখন উহাদের ব্রহ্মানন্দরূপ ফল প্রদান করিবার ক্ষমতা জন্মে।

ধৰ্ম্মাদি ত্রিবর্গসেবা—কামন্দক-আঙ্গরিষ্ঠ-সংবাদ

“এই স্থলে কামন্দকাঙ্গরিষ্ঠসংবাদ নামক এক প্রাচীন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। একদা মহারাজ আঙ্গরিষ্ঠ মহর্ষি কামন্দকে উপবিষ্ট দেখিয়া অভিবাদনপূৰ্ব্বক জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তপোধন! মহীপাল কাম ও লোভপ্রভাবে পাপানুষ্ঠান করিয়া অনুতাপিত হইলে কিরূপে তাঁহার পাপাপনোদন হইতে পারে? আর যে ব্যক্তি অজ্ঞানতানিবন্ধন ধৰ্ম্মবোধে অধর্ম্মের অনুষ্ঠান করে, রাজা কিরূপে তাহাকে পাপ হইতে বিমুক্ত করিবেন?’

“কামন্দক কহিলেন, ‘মহারাজ! যে ব্যক্তি ধর্ম্ম ও অর্থ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক কেবল কামের অনুশীলন করে, তাহার বুদ্ধিনাশ হইয়া যায়; বুদ্ধিনাশ হইলেই ধর্ম্মার্থনাশক মোহ প্রাদুর্ভূত হইয়া থাকে এবং সেই মোহপ্রভাবেই লোকে নাস্তিক ও দুরাচার হইয়া উঠে। রাজা যদি সেই দুরাচারদিগকে দণ্ড প্রদান না করেন, তাহা হইলে গৃহস্থিত সর্পের ন্যায় তাহা হইতে সকলেই ভীত হয়। প্রজাগণ, ব্রাহ্মণগণ ও সাধুগণ কদাচ তাহার অনুবৃত্তি করেন না; ক্রমে ক্রমে তাহার অবনতি ও প্রাণসংশয় হইয়া উঠে এবং তাহাকে নিন্দিত ও অপমানিত হইয়া অতিকষ্টে জীবন অতিবাহিত করিতে হয়। নিন্দিত ও অপমানিত হইয়া প্রাণধারণ করা মৃত্যুতুল্য বলিয়া পরিগণিত হইয়া থাকে। এক্ষণে বিদ্বান ব্যক্তিরা পাপনিবৃত্তির যেরূপ উপায় নির্দেশ করিয়া দিয়াছেন, তাহা শ্রবণ কর। রাজা সতত ত্রিবিদ্যার অনুশীলন ও ব্রাহ্মণগণকে সৎকার করিবেন, ধর্ম্মে নিরন্তর অনুরক্ত থাকিবেন, ক্ষমাশীল মনস্বী ব্রাহ্মণগণের নিকট উপদেশ গ্রহণ করিবেন। কেবল সলিল পান করিয়া পরমসুখে জপ এবং পাপাত্মাদিগকে রাজ্য হইতে বহিষ্কৃত করিয়া ধার্ম্মিক ব্যক্তিদিগের আশ্রয়গ্রহণ করিবেন, মধুরবাক্য ও হিতজনক কাৰ্য্যদ্বারা সকলের সন্তোষসাধন, অন্যের গুণকীর্ত্তন এবং সকলেরই নিকট আত্মীয়তা প্রদর্শন করিবেন। রাজা এইরূপ আচারপরায়ণ হইলে সকলেরই আদরভাজন হয়েন এবং তাঁহার পাপসমূহও নিরাকৃত হইয়া যায়, সন্দেহ নাই। গুরুলোকেরা যেরূপ ধৰ্ম্মোপদেশ প্রদান করিবেন, তদনুসারে কাৰ্য্য করা তাঁহার অবশ্য কর্ত্তব্য। গুরুর প্রসাদে অশেষ শ্ৰেয়োলাভ হইয়া থাকে।”