১১৮. নীচসম্পর্ক নিন্দা—উচ্চসম্পর্কের উৎকর্ষ

১১৮তম অধ্যায়

নীচসম্পর্ক নিন্দা—উচ্চসম্পর্কের উৎকর্ষ

ভীষ্ম কহিলেন, “হে ধৰ্ম্মরাজ! এইরূপে সেই সারমেয় পুনৰ্ব্বার স্বীয় পূর্ব্বরূপ প্রাপ্ত হইয়া নিতান্ত বিষণ্ন হইল। তখন তপোধন তাহাকে যথোচিত তিরস্কার করিয়া তপোবন হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দিলেন। অতএব নীচকে প্রশ্রয় প্রদান করা কদাপি বিধেয় নহে। বুদ্ধিমান নরপতি ভৃত্যগণের সত্য, শৌচ, সরলতা, প্রকৃতি, বিদ্যা, চরিত্র, কুল, জিতেন্দ্রিয়তা, দয়া, বলবীৰ্য্য ও ক্ষমাগুণের পরিচয় গ্রহণপূর্ব্বক তাহাদিগকে যথাযোগ্য কার্য্যে নিযুক্ত করিয়া প্রতিপালন করিবেন। পরীক্ষা না করিয়া কোন ব্যক্তিকে অমাত্যপদ প্রদান করা কর্ত্তব্য নহে; যে রাজা প্রতিনিয়ত অসৎকুলসদ্ভূত জনগণে পরিবৃত হইয়া অবস্থান করেন, তিনি কখনই সুখভোগে সমর্থ হয়েন না। সৎকুলোদ্ভব সাধুব্যক্তিরা ভূপতিকর্ত্তৃক বিনাপরাধে নিপীড়িত হইয়াও তাঁহার অনিষ্ট চিন্তা করেন না, কিন্তু অসদ্বংশসম্ভূত প্রাকৃত পুরুষেরা সাধুদিগের নিকট দুল্লভ ঐশ্বৰ্য্য লাভ করিয়াও তাঁহাদিগের শত্রুতাচরণে প্রবৃত্ত হয়, অতএব যে ব্যক্তি সতত আপনার প্রভু ও মিত্রগণের ঐশ্বর্য্য কামনা করেন ও যাহা পান, তাহাতেই সন্তুষ্ট থাকেন, পুরবাসী ও জনপদবাসীদিগকে আশ্রয় দান করাই যাঁহার প্রধান কার্য্য, যিনি কদাচ অসাধুগণের সহিত একত্র বাস করেন না এবং যিনি সৎকুলসম্ভূত, সুশিক্ষিত, সহিষ্ণু, স্বদেশজাত, কৃতজ্ঞ, বলবান, ক্ষমতাশীল, জিতেন্দ্রিয়, লোকরঞ্জনতৎপর, স্থিরচিত্ত, হিতৈষী, আলস্যশূন্য, স্বকার্য্যনিরত, সন্ধিবিগ্রহবিশারদ, ত্রিবর্গবেত্তা, শত্রুসৈন্যবিদারণসমর্থ, ব্যূহতত্ত্বজ্ঞ, ইঙ্গিতজ্ঞ, বলহর্ষণবেত্তা [সৈন্যগণের প্রীতি প্রদানের উপায়বিৎ],হস্তশিক্ষাসুনিপুণ [দ্রুত কাৰ্য্যসাধনপটু], অহঙ্কারশূন্য, অনুকূল, নীতিপরায়ণ, শুদ্ধস্বভাব, প্রিয়দর্শন, মৃদুভাষী ও দেশকালজ্ঞ, তাঁহাকেই মন্ত্রিপদে অভিষেক করা কর্ত্তব্য। যে রাজা ঐরূপ ব্যক্তিকে মন্ত্রিপদ প্রদানপূর্ব্বক যথোচিত সমাদর করেন, তাঁহার রাজ্য চন্দ্রমার আলোকের ন্যায় চতুর্দিকে বিস্তীর্ণ হইয়া থাকে, সন্দেহ নাই।

“যে রাজা শাস্ত্রবিশারদ, ধর্ম্মপরায়ণ, প্রজাপালনতৎপর, ধীরস্বভাব, অমর্ষপরায়ণ, শুদ্ধপ্রকৃতি ও উগ্র, যিনি অবসরক্রমে পুরুষকার প্রদর্শন করিতে পারেন, যিনি বৃদ্ধগণের শুশ্রূষাতৎপর, জ্ঞানবান, গুণগ্রাহী, বিচারপটু, মেধাবী, জিতেন্দ্রিয় ও প্রিয়বাদী, যিনি নীতি অনুসারে কার্য্যনির্ব্বাহ করিয়া থাকেন, যিনি অপকারী ব্যক্তির প্রতিও ক্ষমাপ্রদর্শন এবং স্বহস্তে দান গ্রহণ করেন, যিনি পরমশ্রদ্ধাবান, নিরহঙ্কার ও হিতানুষ্ঠাননিরত, যাঁহার অমাত্য অতি বিশ্বস্ত, যিনি সতত দুঃখিত ব্যক্তির দুঃখনিবারণ ও বিবেচনাপূৰ্ব্বক কার্য্য অনুষ্ঠান করিয়া থাকেন, যিনি অমাত্যেরা কোন শুভজনক কাৰ্য্যসাধন করিলে তাহাদিগের সবিশেষ উপকার করেন, ভৃত্যগণ যাঁহার প্রতি প্রতিনিয়ত প্রীতিপ্রদর্শন করে, যাঁহার বিলক্ষণ লোকসংগ্রহ আছে, যিনি সততই ভৃত্যগণ ও প্রজাগণের অবস্থা পর্য্যবেক্ষণ এবং চরগণের সাহায্যে গূঢ়বৃত্তান্ত অনুসন্ধান করেন আর যিনি ধৰ্ম্মকর্ম্মের অনুষ্ঠানে একান্ত নিরত, তিনি সকলের প্রার্থনীয় ও সমাদরভাজন হয়েন।

“গুণবান্ যোদ্ধা সংগ্রহ করা রাজার অতিশয় আবশ্যক। যোদ্ধারা গুণশালী হইলে ভূপতিকে রাজ্যরক্ষাবিষয়ে সবিশেষ সাহায্য প্রদান করিয়া থাকে। যে রাজা নিরন্তর অভ্যুদয়লাভে অভিলাষ করেন, তিনি কদাচ যোদ্ধৃবর্গের অবমাননা করিবেন না। যে রাজার অধিকারে সমরদক্ষ, কৃতজ্ঞ, শাস্ত্রজ্ঞ, ধার্ম্মিক, অস্ত্রবিদ্যা-বিশারদ অসংখ্য পদাতি, রথী, গজারোহী ও অশ্বারোহী সৈন্য থাকে, তিনিই সমুদয় পৃথিবী অধিকার করিতে সমর্থ হয়েন। আর যে রাজা সসন্ত দ্রব্যের সংগ্রহে নিতান্ত ব্যগ্র, উদযোগী ও বহুমিত্রসম্পন্ন হয়েন, তাঁহাকেই প্রধান বলিয়া গণনা করা যায়।”