১২১. দণ্ডের স্বরূপ-নির্ণয়

১২১তম অধ্যায়

দণ্ডের স্বরূপ-নির্ণয়

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! আপনি যে সনাতন রাজধৰ্ম্মবিষয় কীৰ্ত্তন করিলেন, ইহাতে দণ্ডই সৰ্ব্বপ্রধান বলিয়া নির্দিষ্ট হইল। মহাতেজস্বী দণ্ড দেবতা, ঋষি, পিতৃলোক, যক্ষ, রাক্ষস, পিশাচ, সাধ্য ও তির্য্যগযোনি প্রভৃতি সমুদয় প্রাণীর নিকট বিদ্যমান রহিয়াছে। কি সুর, কি অসুর, কি মনুষ্য সকলেই দণ্ডের উপর নির্ভর করিয়া আছে। এক্ষণে সেই দণ্ডের আকারপ্রকার কিরূপ? উহার অধিষ্ঠাত্রী দেবতা কে? উহা কিরূপে অনুক্ষণ অবহিতচিত্তে প্রজাগণের প্রতি জাগরিত থাকিয়া সমুদয় জগৎ প্রতিপালন করে এবং দণ্ডের স্বরূপ ও গতি কি প্রকার, তাহা বিশেষরূপে শ্রবণ করিতে বাসনা করি।”

ভীষ্ম কহিলেন, “হে ধৰ্ম্মরাজ! দণ্ড ও ব্যবহার যেরূপ, তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। ইহলোকে যাহাদ্বারা সমুদয় বশবর্তী হয়; তাহার নাম দণ্ড। যাহাতে ধর্ম্মের লোপ না হইয়া প্রত্যুত তাহার প্রচার হইয়া থাকে, তাহাকেই ব্যবহার কহে। পূৰ্ব্বে ভগবান্ মনু সৰ্ব্বপ্রথমে কহিয়া গিয়াছেন যে, যিনি সুবিহিত দণ্ডদানদ্বারা প্রিয় ও অপ্রিয় ব্যক্তিকে সমভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করেন, তিনি সাক্ষাৎ ধৰ্ম্মম্বরূপ। আমি যে মনুবাক্য কীৰ্ত্তন করিলাম, ইহা ব্রহ্মার বাক্য। ভগবান্ মনু ব্রহ্মার নিকট এই বাক্য শ্রবণ করিয়াছিলেন। এই বাক্য অতি পূৰ্ব্বকালে কথিত হইয়াছে বলিয়া ইহাকে প্রাক্তন বাক্য কহে। যথার্থরূপে দণ্ডবিধান করিলে ত্রিবর্গলাভ হইয়া থাকে। দণ্ড প্রধান দেবতা; উহার তেজ প্রজ্বলিত হুতাশনের ন্যায়, ও রূপ নীলোৎপলদলের ন্যায় শ্যামল। উহার চারি দন্ত, চারি বাহু, দুই জিহ্বা, আট চরণ ও অসংখ্য চক্ষু। উহার কর্ণ অতি তীক্ষ্ন, লোমসকল উৰ্দ্ধ, মস্তক জটাজালে জড়িত, আস্যদেশ তাম্রবর্ণ এবং শরীর কৃষ্ণসারগের ন্যায় চৰ্ম্মে আবৃত। দণ্ড প্রতিনিয়ত এইরূপ উগ্রমূর্ত্তি ধারণ করিয়া অবস্থান করে। খড়্গ, ধনু, গদা, শক্তি, ত্রিশূল, মুদ্গর, শর, মুষল, পরশু, চক্র, পাশ, দণ্ড ও তোমর প্রভৃতি যেসকল অস্ত্র আছে, দণ্ড তাহাদের সকলেরই আকার প্রতিগ্রহপূৰ্ব্বক কাহাকে ছিন্ন, কাহাকে ভিন্ন, কাহাকে নিপীড়িত, কাহাকে বিদারিত, কাহাকে বিপাটিত ও কাহাকে ঘাতিত [নিহত] করিয়া থাকে। দণ্ডের অসি, বিশসন, ধৰ্ম্ম, তীক্ষ্ণবক্স, দুরাধর, শ্রীগর্ভ, বিজয়, শাস্তা, ব্যবহার, সনাতন, শাস্ত্র, ব্রাহ্মণ, মন্ত্র, ধর্ম্মপাল, অক্ষর, দেব, সত্যগ, নিত্যগ, অগ্রজ, অসঙ্গ, রুদ্রতনয়, জ্যেষ্ঠ, মনু ও শিবঙ্কর এই কয়েকটি নাম কীৰ্ত্তিত আছে। দণ্ড সাক্ষাৎ ভগবান বিষ্ণু ও নারায়ণস্বরূপ। ইনি নিয়ত মহৎ রূপ ধারণ করাতে হঁহাকে মহাপুরুষ বলিয়া কীৰ্ত্তন করা যায়।

“মহারাজ! দণ্ডের পত্নী নীতি ও ব্রহ্মকন্যা [ব্রহ্মার কন্যা], লক্ষ্মী, সরস্বতী ও জগদ্ধাত্রী নামে অভিহিত হইয়া থাকে। দণ্ড, অর্থ, অনর্থ, ধর্ম্ম, অধৰ্ম্ম, সুখ, দুঃখ, বল, অবল, দুর্ভাগ্য, সৌভাগ্য, পাপ, পুণ্য, গুণ, অগুণ, কাম, অকাম, ঋতু, মাস, দিবা, রাত্রি, মুহূৰ্ত্ত, প্রমাদ, অপ্রমাদ, হর্ষ, ক্রোধ, শম, দম, দৈব, পুরুষকার, মোক্ষ, অমোক্ষ, ভয়, অভয়, হিংসা, অহিংসা, তপস্যা, যজ্ঞ, সংযম, আদি, অন্ত, মধ্য, কাৰ্য্যপ্রপঞ্চ[জগতের সমস্ত কাৰ্য্য], মদ, প্রমাদ, দর্প, দন্ত, ধৈৰ্য্য, নীতি, অনীতি শক্তি, অশক্তি, অভিমান, অহঙ্কার, ব্যয়, অব্যয়, বিনয়, পরিত্যাগ, কাল, অকাল, সত্য, মিথ্যা, শ্রদ্ধা, অশ্রদ্ধা, ব্যবসায়, লাভ, অলাভ, জয়, পরাজয়, মৃদুতা, তীক্ষ্ণতা, মৃত্যু, আগম[উপচয়—বৃদ্ধি], অনাগম, বিরোধ, অবিরোধ, কাৰ্য্য, অকাৰ্য্য, অসূয়া, অনসূয়া, সলজ্জতা, নির্লজ্জতা, বিপদ, সম্পদ, তেজ, পাণ্ডিত্য, বাক্য, শক্তি ও তত্ত্ববুদ্ধিতা [যথার্থনিরূপণশক্তি] প্রভৃতি বহুবিধ আকারসম্পন্ন। যদি ইহলোকে দণ্ডের প্রাদুর্ভাব না থাকিত, তাহা হইলে সকলেই পরস্পরকে নিপীড়িত করিত। এই জগতে কেবল দণ্ডের ভয়েই কেহ কাহাকে বিনাশ করে না। প্রজাগণ প্রতিদিন দণ্ডদ্বারা প্রতিপালিত হইয়াই নরপতিকে সমুন্নত করে; অতএব দণ্ডই সৰ্ব্বপ্রধান। দণ্ড লোকদিগকে সৎপথে প্রবর্ত্তিত করে।

“ধৰ্ম্ম সৰ্ব্বদা সত্য ও ব্রাহ্মণগণে অবস্থান করিতেছে। ব্রাহ্মণগণ ধার্ম্মিক হইলেই বেদজ্ঞ হইয়া থাকেন। বেদ হইতেই যাগযজ্ঞাদি সুসম্পন্ন হয়। যজ্ঞদ্বারা দেবগণ পরমপ্রীত হইয়া থাকেন। দেবতারা প্রীত হইয়া প্রতিনিয়ত ইন্দ্রের নিকট প্রজাগণের গুণকীর্ত্তন করিলে তিনি তাঁহাদের প্রতি প্রসন্ন হইয়া তাঁহাদিগকে অন্ন দান করেন। অন্নই প্রাণীগণের জীবনধারণের উপায়। অন্ন হইতেই প্রজাগণ প্রাণধারণ করিয়া থাকে এবং দণ্ড ক্ষত্রিয়মূৰ্ত্তি ধারণপূৰ্ব্বক প্রতিনিয়ত জাগরিত থাকিয়া তাহাদিগকে রক্ষা করে। দণ্ড, ঈশ্বর, পুরুষ, প্রাণ, সত্ত্ব, চিত্ত, প্রজাপতি, ভূতাত্মা ও জীব এই আটনামে অভিহিত হইয়া থাকে। জগদীশ্বর ভূপতিগণকে দণ্ড ও ঐশ্বৰ্য্য প্রদান করেন বলিয়াই তাঁহারা প্রভূত সৈন্যসম্পন্ন হয়েন, সন্দেহ নাই। হে রাজন! হস্তী, অশ্ব, রথ, পদাতি, নৌকা, বিষ্টি [বিনা বেতনে ভারবাহক], দেশজলোক ও মেষাদি এই অষ্টবিধদ্বারা কুল, বিপুল ধনশালী অমাত্য, জ্ঞান, শরীর, বল ও কোষ বর্দ্ধনোপযোগী অন্যান্য বল সংগ্রহ করা রাজার অবশ্য কর্ত্তব্য। রথী, সাদী, নিষাদী, পদাতি, মন্ত্রী, বৈদ্য, ভিক্ষুক, প্রাড়ি বাক[বিচারপতি], দৈবজ্ঞ, কোষ, মিত্র, ধান্য, অন্যান্য উপকরণ, সপ্তপ্রকৃতি [স্বামী, মন্ত্রী, সহায়, সম্পত্তি, দেশ, দুর্গ, সৈন্য] ও অষ্টাঙ্গ [পূর্ব্বোক্ত সপ্তপ্রকৃতি এবং পুরশ্রেণী] রাজ্যের শরীরস্বরূপ; দণ্ড রাজ্যের প্রধান অঙ্গ ও প্রধান কারণ। জগদীশ্বর ক্ষত্রিয়ের নিমিত্ত যত্নপূৰ্ব্বক দণ্ড প্রেরণ করিয়াছেন। এই বিশ্বসংসার দণ্ডের অধীন। ব্রহ্মা প্রজাগণের প্রতিপালন ও তাহাদিগকে স্ব স্ব ধৰ্ম্মসংস্থাপনের জন্য যে দরূপ ধর্ম্ম প্রদর্শন করিয়াছেন, তাহা অপেক্ষা রাজাদিগের পূজনীয় আর কিছুই নাই।

ব্যবহারশাস্ত্রের স্বরূপ-নির্ণয়

“ব্যবহার অর্থী ও প্রত্যর্থীর দ্বারা উৎপন্ন হইয়া থাকে। অর্থ ও প্রত্যর্থীর মধ্যে একজনের প্রতি সম্পূর্ণ বিশ্বাস উৎপাদনপূর্ব্বক তাহাকে জয়শালী করিয়া দেয়। ব্যবহার বেদমূলক [শাস্ত্রমূলক]। কুলাচার উল্লঙ্ঘন ও শাস্ত্র অতিক্রমনিবন্ধন উহা দুই প্রকারে পরিণত হইয়া থাকে। অর্থী ও প্রত্যর্থীর মধ্যে একের প্রতি বিশ্বাস করিয়া অন্যকে যে দণ্ড প্রদত্ত হইয়া থাকে, উহা ভূপালনিষ্ঠ [নৃপতিকর্ত্তৃক বিধেয়—রাজার প্রযোজ্য], সুতরাং ভূপালগণের উহা অবগত হওয়া নিতান্ত আবশ্যক। যদিও আপনার বিশ্বাসের উপর নির্ভর করিয়া লোকের প্রতি দণ্ডবিধান করা যায়, কিন্তু ব্যবহার যে দণ্ডের মূল, তাহার আর সন্দেহ নাই। ব্যবহার বেদমূলক। যাহা বৈদিক সিদ্ধান্ত সমুত্থিত, তাহাই বহুগুণসম্পন্ন ধৰ্ম্ম। মনস্বীরা ধৰ্ম্মানুসারে অর্থী ও প্রত্যর্থীর মধ্যে একজনের প্রতি অবিশ্বাস করিয়া, অন্যকে দণ্ডবিধান করিয়া থাকেন। বেদমূলক ব্যবহার তিন লোক রক্ষা করিতেছে। আমাদিগের মতে বেদমূলক ব্যবহারই ধৰ্ম্ম এবং যাহা ধৰ্ম্ম বলিয়া নির্দিষ্ট হয়, তাহাই সৎপথ। সৰ্ব্বলোকপিতামহ ব্রহ্মা সুর, অসুর, রাক্ষস, মনুষ্য ও উরগদিগের সৃষ্টি ও সংহারকর্ত্তা। এই ধৰ্ম্মের সহিত তাঁহার একাত্মতা [তুল্যতা] আছে। মাতা, পিতা, ভ্রাতা, ভাৰ্য্যা ও পুরোহিত প্রভৃতি যে কেহই হউক না কেন, অপরাধী হইলেই রাজা তাহার দণ্ডবিধান করিবেন। রাজার অদণ্ড্য [দণ্ড দিবার অযোগ্য] কেহই নাই।”