১৪৯. শরণাগত-বাৎসল্য প্রশংসা—ব্যাধের দিব্যগতি

১৪৯তম অধ্যায়

শরণাগত-বাৎসল্য প্রশংসা—ব্যাধের দিব্যগতি

ভীষ্ম কহিলেন, “হে ধৰ্ম্মরাজ! যৎকালে সেই কপোতদম্পতি বিমানে আরোহণ করিয়া স্বর্গে গমন করিতেছিল, সেই সময় সেই ব্যাধ ইতস্ততঃ পৰ্য্যটন করিতে করিতে দৈবাৎ ঊর্দ্ধে দৃষ্টিনিক্ষেপপূৰ্ব্বক তাহাদিগকে অবলোকন করিয়াছিল। কপোতদম্পতির সেই উৎকৃষ্ট অবস্থা-সন্দর্শনে ব্যাধের মনে নিতান্ত দুঃখ হইল। তখন সে তপঃপ্রভাবে উহাদের ন্যায় সদ্‌গতিলাভে কৃতনিশ্চয় হইয়া বাতাহারপরায়ণ [বায়ুমাত্রভক্ষণনিরত], মমতাপরিশূন্য ও নিস্পৃহ হইয়া তথা হইতে প্রস্থান করিল। কিয়দ্দূর গমন করিতে করিতে এক পঙ্কজ পরিপূর্ণ, নানাবিধ বিহঙ্গমসমাকীর্ণ, সুশীতল সলিলসমন্বিত সুবিস্তীর্ণ সরোবর তাহার দৃষ্টিপথে নিপতিত হইল। পিপাসার্ত্ত ব্যক্তিরা ঐ সরোবর সন্দর্শন করিবামাত্র পরম পরিতুষ্ট হইয়া থাকে, সন্দেহ নাই। কিন্তু সেই উপবাসনিরত শীর্ণকলেবর লুব্ধক উহার প্রতি দৃষ্টিপাতও না করিয়া শ্বাপদসমাকীর্ণ বন অতি সুবিস্তীর্ণ মনে করিয়া হৃষ্টচিত্তে তথায় প্রবেশ করিতে লাগিল। বনে প্রবেশ করিবার সময় তাহার সৰ্ব্বাঙ্গ কণ্টকে ক্ষতবিক্ষত ও শোণিতলিপ্ত হইল; তথাপি সেই বিবিধ হিংস্ৰজন্তুসমাকীর্ণ অটবীতে প্রবেশ করিয়া ভ্রমণ করিতে নিরস্ত [ক্ষান্ত] হইল না। কিয়ৎক্ষণ পরে বায়ুবেগবশতঃ বৃক্ষে বৃক্ষে সঙ্ঘর্ষণ হওয়াতে অতি ভীষণ দাবানল সমুত্থিত হইল। ঐ অগ্নি প্রলয়কালীন হুতাশনের ন্যায় অতি ভীষণমূৰ্ত্তি ধারণ করিয়া ক্রোধভরে যেন সেই বৃক্ষলতা ও পাত্রসমাযুক্ত পশুপক্ষীসঙ্কুল মহারণ্যের চতুর্দ্দিক দগ্ধ করিতে আরম্ভ করিল। ঐ সময় লুব্ধক বনমধ্যে দাবাগ্নি সমুঙ্খিত দেখিয়া, স্বীয় কলেবর পরিত্যাগ করিবার মানসে মহা আহ্লাদে সেই ভীষণ হুতাশনের মধ্যে ধাবমান হইল। ব্যাধ অনলমধ্যে উপস্থিত হইবামাত্র তাহার শরীর ভস্মসাৎ হইয়া গেল। কলেবর দগ্ধ হওয়াতে ব্যাধের আর পাপের লেশমাত্র রহিল না; সুতরাং সে অনায়াসে স্বর্গে গমনপূর্ব্বক আপনাকে যক্ষ, গন্ধৰ্ব্ব ও সিদ্ধগণের মধ্যে ইন্দ্রের ন্যায় পরিভ্রমণ করিতে দেখিয়া পরম পরিতুষ্ট হইল।

“হে ধৰ্ম্মরাজ! এইরূপে কপোত, কপোতী ও ব্যাধ তিনজনেই। স্ব স্ব পুণ্যফলে স্বর্গে গমন করিল। যে পতিব্রতা নারী এইরূপে স্বামীর অনুগমন করেন, তিনি কপোতীর ন্যায় অনায়াসে স্বর্গসুখ অনুভব করিতে সমর্থ হয়েন। এই আমি তোমার নিকট লুব্ধক ও কপোতের পুরাবৃত্ত কীৰ্ত্তন করিলাম। যে ব্যক্তি প্রতিদিন এই ইতিহাস কীৰ্ত্তন বা শ্রবণ করিবেন, তাহার কিছুমাত্র অমঙ্গল ঘটিবে না।

হে ধৰ্ম্মরাজ! শরণাগত ব্যক্তিকে আশ্রয় দান করা প্রধান ধর্ম্ম। গোহত্যাকারীর বরং নিষ্কৃতিলাভ হইতে পারে, কিন্তু যে ব্যক্তি শরণাগতকে বিনাশ করে, তাহার কোনরূপেই নিষ্কৃতিলাভের সম্ভাবনা নাই। এই পাপনাশক ইতিহাস শ্রবণ করিলে লোকে সমুদয় দুঃখ হইতে বিমুক্ত ও চরম স্বর্গলোক প্রাপ্ত হয়, সন্দেহ নাই।”