১৩৯. অবিশ্বাসের পাত্র—ব্রহ্মদত্ত-পূজনী বৃত্তান্ত

১৩৯তম অধ্যায়

অবিশ্বাসের পাত্র—ব্রহ্মদত্ত-পূজনী বৃত্তান্ত

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! আপনি কহিলেন যে, সকলের প্রতি, বিশেষতঃ শত্রুর প্রতি বিশ্বাস করা কোন মতেই কর্ত্তৃব্য নহে। যদি কাহারও প্রতি বিশ্বাস না করা যায় এবং বিশ্বাস করিলেই যদি মহাভয় উপস্থিত হয়, তাহা হইলে রাজা কিরূপে রাজ্যরক্ষা ও কিরূপেই বা শত্ৰু পরাজয় করিবেন? আপনার মুখে সকলের প্রতি অবিশ্বাস করিবার কথা শ্রবণ করিয়া আমার মহাসংশয় উপস্থিত হইয়াছে, অতএব আপনি আমার এই সংশয়চ্ছেদন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! পূজনীনামক পক্ষীর সহিত ব্রহ্মদত্ত নরপতির যেরূপ কথোপকথন হইয়াছিল, তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। কাস্পিল্যনগরে ব্রহ্মদত্তনামে এক নবপতি ছিলেন। তাঁহার অন্তঃপুরে পূজনীনামে এক পক্ষী বহুকাল পর্য্যন্ত বাস করিতেছিল। ঐ পক্ষী ব্যাধের ন্যায় সকল প্রাণীর স্বর বুঝিতে পারিত। ফলতঃ পূজনী পক্ষী হইয়াও সৰ্ব্বজ্ঞ ছিল। কিয়দ্দিন পরে সেই অন্তঃপুর মধ্যে পূজনীর এক অত্যুত্তম শাবক জন্মে। পূজনী যে দিবস শাবক প্রসব করে, রাজমহিষীও সেই দিবস এক পুত্র প্রসব করিয়াছিলেন। কৃতজ্ঞা পূজনী রাজকুমারকে আপনার শাবকের ন্যায় স্নেহ করিত এবং প্রতিদিন সমুদ্রতীরে গমনপূর্ব্বক দুইটি অমৃততুল্য সুস্বাদু বলাধায়ী ফল আহরণ ও গৃহে প্রত্যাগমন করিয়া একটি স্বীয় শাবককে ও অন্যটি রাজপুত্রকে অর্পণ করিত। রাজকুমার সেই ফল ভক্ষণ করিয়া দিন দিন পরিবর্দ্ধিত হইতে লাগিল।

“একদা ধাত্রী রাজপুত্রকে ক্রোড়ে লইয়া ইতস্ততঃ ভ্রমণ করিতে আরম্ভ করিলে বালক সেই পক্ষীশাবক অবলোকন করিয়া বালস্বভাবপ্রযুক্ত তাহার নিকট গমন করিল এবং সেই শিশু শাবকের সহিত ক্রীড়া করিতে করিতে তাহাকে ঊর্ধ্বে উত্তোলনপূৰ্ব্বক বিনাশ করিয়া পুনরায় ধাত্রীর সমীপে সমুপস্থিত হইল। ঐ সময় পক্ষিমাতা পূজনী ফল আহরণপূৰ্ব্বক অন্তঃপুরে আগমন করিয়া দেখিল যে, রাজপুত্র তাহার শাবককে নিপাতিত করিয়াছে। শাবক বিনষ্ট হইয়াছে দেখিয়া পূজনীর দুঃখের আর পরিসীমা রহিল না। তখন সে বাষ্পকুলনয়নে রোদন করিতে করিতে কহিল যে, ‘ক্ষত্রিয়ের সহিত একত্র বাস ও হৃদ্যতা করা কদাপি কর্ত্তব্য নহে। উহারা কাৰ্য্য উপস্থিত হইলেই লোককে সান্ত্বনা এবং কৃতকাৰ্য্য হইলেই পরিত্যাগ করিয়া থাকে; অতএব ক্ষত্রিয়ের প্রতি বিশ্বাস করা নিতান্ত অনুচিত। ক্ষত্রিয়েরা লোকের অপকার করিয়া তাহাকে নিরর্থক সতত সান্ত্বনা করিয়া থাকে। যাহা হউক, আজি আমিও এই কৃতঘ্ন, নৃশংস ও বিশ্বাসঘাতক রাজকুমারের বিশেষ অপকার করিয়া অনুরূপ বৈরনির্য্যাতন করিব। আমার শাবক উহার সহিত একদিনে জন্মগ্রহণ করিয়া একত্র পরিবর্দ্ধিত হইয়াছিল এবং সতত উহার সহিত একত্র ভোজন ও উহার আশ্রয়ে বাস করিত। ঐ দুরাত্মা তাহার বধসাধন করিয়া ঘোরতর পাপে লিপ্ত হইয়াছে।’ পূজনী এই কথা বলিয়া তৎক্ষণাৎ স্বীয় চরণদ্বারা রাজকুমারের নয়নদ্বয় উৎপাটনপূর্ব্বক সুস্থচিত্তে পুনরায় এই কথা কহিল, ‘যে ব্যক্তি ইচ্ছাপূৰ্ব্বক পাপানুষ্ঠান করে, পাপ তৎক্ষণাৎ তাহাকে আক্রমণ করিয়া থাকে। আর যাহারা কেহ অনিষ্টাচরণ করিলে তাহার প্রতিবিধান করে, তাহাতে কখনই তাহাদিগের পুণ্যনাশ হইবার সম্ভাবনা নাই। লোকে পাপকৰ্ম্ম করিয়া যদি স্বয়ং তাহার ফলভোগ না করে, তাহা হইলে তাহার পুত্র, পৌত্র বা প্রপৌত্রকে নিশ্চয়ই তাহার ফলভোগ করিতে হইবে।’

মিত্ৰতাভঙ্গের দোষ—ব্রহ্মদত্ত-পূজনী কথোপকথন

“অনন্তর মহারাজ ব্রহ্মদত্ত স্বীয় পুত্রের নয়নদ্বয় উৎপাটিত অবলোকনপূৰ্ব্বক পূজনী প্রথমে অপকৃত হইয়া পশ্চাৎ অপকারের প্রতিবিধান করিয়াছে বিবেচনা করিয়া তাহাকে কহিলেন, ‘পূজনি! আমার পুত্র অগ্রে তোমার অপকার করিলে তুমি পশ্চাৎ প্রত্যুপকার করিয়াছ, সুতরাং তোমাদের উভয়ের অপরাধই তুল্য হইয়াছে; অতএব তোমার স্থানান্তরে যাইবার প্রয়োজন নাই; এই স্থলেই অবস্থান কর।’

“তখন পূজনী কহিল, মহারাজ! যে ব্যক্তি একবার একজনের নিকট অপরাধ করিয়া পুনরায় তাহার নিকট অবস্থান করে, পণ্ডিত ব্যক্তিরা কদাচ তাহার প্রশংসা করেন না; অতএব অপকৃত ব্যক্তির নিকট হইতে প্রস্থান করাই শ্রেয়ঃকল্প। যে ব্যক্তি একবার বৈরাচরণ করিয়াছে, তাহার প্রতি সর্ব্বদা সান্ত্বনাবাক্য প্রয়োগ করিলেও তাহার তাহাতে বিশ্বাস করা কর্ত্তব্য নহে। যে মূঢ় ঐরূপ বাক্যে বিশ্বাস করে তাহাকে অচিরাৎ বিনষ্ট হইতে হয়। শত্রুতা এককালে বিনষ্ট হইবার নহে। পরস্পর বৈরভাব জন্মিলে যুদ্ধ উপস্থিত হইয়া উভয়েরই পুত্রপৌত্র পর্য্যন্ত বিনষ্ট হয় এবং পুত্র পৌত্র বিনষ্ট হইলে তাহাদের আর পরলোকপ্রাপ্তির উপায় থাকে না; অতএব একবার বৈরসংঘটন হইলে পরস্পর বিশ্বাস না করাই সুখলাভের নিদান। বিশেষতঃ বিশ্বাসঘাতকের প্রতি একেবারে অবিশ্বাস করাই কর্ত্তব্য; বিশ্বস্ত ব্যক্তিকেও সম্পূর্ণ বিশ্বাস করা উচিত নহে। কারণ, বিশ্বাস হইতে ভয় উপস্থিত হইলে তদ্দারা মূল পৰ্য্যন্ত বিনষ্ট হইবার বিলক্ষণ সম্ভাবনা। অতএব প্রাজ্ঞ ব্যক্তি আপনার প্রতি অন্যের বিশ্বাস উৎপাদন করিবে; কিন্তু স্বয়ং কাহাকেও বিশ্বাস করিবে না। ইহলোকে পিতামাতাই লোকের পরম বন্ধু এবং আত্মাই সুখ-দুঃখের ভোক্তা। আর ভাৰ্য্যা বীৰ্য্যহরণ এবং পুত্র, ভ্রাতা ও বয়স্য ধনগ্রহণনিবন্ধন শত্ৰুপদবাচ্য হইয়া থাকে। পরস্পরের একবার বৈরভাব উপস্থিত হইলে আর সন্ধিসংস্থাপন করা কর্ত্তব্য নহে। আমি যে কারণে এখানে অবস্থান করিয়াছিলাম, এক্ষণে সে কারণ অতীত হইয়াছে। প্রথমতঃ একজনের অপকার করিয়া পরিশেষে তাহাকে অর্থদান ও বহুমান প্রদর্শন করিলেও কখনও তাহার মনে প্রত্যয় জন্মে না। বলবান লোকের কাৰ্য্য প্রদর্শন করিয়াই দুর্ব্বল ব্যক্তির অন্তঃকরণে ভয়সঞ্চার হইয়া থাকে। যে স্থানে প্রথমতঃ সম্মানিত ও পশ্চাৎ অবমানিত হইতে হয়, বুদ্ধিমান ব্যক্তির তাদৃশ স্থান পরিত্যাগ করাই কৰ্ত্তব্য। আমি বহুকাল পর্য্যন্ত পরমসমাদরে তোমার ভবনে বাস করিয়াছিলাম; কিন্তু এক্ষণে যখন তোমার সহিত আমার বৈরভাব জন্মিল, তখন আমি অচিরাৎ এ স্থান হইতে প্রস্থান করিব।

“ব্ৰহ্মদত্ত কহিলেন, “পূজনি! লোকে অপকারীর প্রত্যুপকার করিতে তন্নিবন্ধন কদাচ অপরাধী হয় না, বরং তাহাকে ঋণনির্ম্মুক্ত বলিয়া গণনা করা যাইতে পারে। অতএব তুমি অন্যত্র গমন না করিয়া এই স্থানেই অবস্থান কর।

“পূজনী কহিল, ‘মহারাজ! অপকারীর প্রত্যুপকার করিলে পুনরায় কখনই তাহার সহিত আন্তরিক সখ্যভাব হইবার সম্ভাবনা নাই। কারণ, অপকৃত ও প্রত্যুপকৃত উভয় ব্যক্তিরই অন্তঃকরণে প্রতিনিয়ত পরস্পরকৃত অপকার জাগরূক থাকে। ব্ৰহ্মদত্ত কহিলেন, ‘পূজনি! অনেক স্থলে পরস্পরের বিরোধের পর পুনরায় সন্ধিসংঘটন হইয়া বৈরতার উপশম হইতে দেখা গিয়াছে; ঐ সন্ধিনিবন্ধন তাহাদের কোন অপকারও হয় নাই।’

“পূজনী কহিল, ‘মহারাজ! শত্রুতার উপশম কখনই নাই। শত্রুর সান্ত্বনাবাক্যে বিমোহিত হইয়া কদাচ তাহার প্রতি বিশ্বাস করিবেন না। বিশ্বাস করিলেই বিনষ্ট হইতে হয়, অতএব অতঃপর আমাদের পরস্পর সাক্ষাৎকার না হওয়াই শ্রেয়ঃকল্প। বলপূর্ব্বক সুনিশিত শস্ত্রপ্রহারেও যাহাদিগকে পরাজিত করিতে পারা যায় না, তাহারা কেবল এক সন্ধিপ্রভাবে করেণুলোভাকৃষ্ট মাতঙ্গের ন্যায়। অনায়াসে পরাভূত হইয়া থাকে।’

“ব্রহ্মদত্ত কহিলেন, ‘পূজনি! একত্র সহবাস করিলে হত্যাকারী শত্রুর প্রতিও স্নেহভাবের উদয় হয় এবং কুক্কুর ও চণ্ডালের ন্যায় পরস্পরের প্রতি পরস্পরের বিশ্বাস জন্মিয়া থাকে। আর বৈরভাবও পদ্মপস্থিত সলিলের ন্যায় অধিককাল অবস্থান করিতে পারে না।

“পূজনী কহিল, ‘রাজন! পণ্ডিতেরা স্ত্রী, বাদ্য, পরুষবাক্য, অপরাধ ও জাতিস্বভাব এই পাঁচটিকে শত্রুতার কারণ বলিয়া নির্দেশ করিয়া গিয়াছেন। দামশীল বক্তির সহিত শত্রুতাসংঘটন হইলে প্রকাশ্যরূপেই হউক আর অপ্রকাশ্যরূপেই হউক, দোষের বলাবল বিবেচনা করিয়া তাহাকে বিনাশ করা ক্ষত্রিয়ের কর্ত্তব্য নহে। সুহৃদের সহিত বৈরভাব উপস্থিত হইলে তাহার প্রতিও বিশ্বাস করিবে না। বৈরানল কাষ্ঠস্থিত গুঢ় হুতাশনের ন্যায়, সমুদ্রগর্ভস্থ বাড়বানলের ন্যায় প্রচ্ছন্নভাব অবস্থান করে। অর্থদান, সান্ত্বনা, পুরুষবাক্য-প্রয়োগ বা শাস্ত্রজ্ঞানদ্বারা উহা উপশমিত করা যায় না। ফলতঃ পরস্পরের বৈরানল একবার উদ্দীপিত হইলে উহা এক পক্ষকে দগ্ধ না করিয়া কখনই নিৰ্ব্বাণ হইবার নহে। অপকারী ব্যক্তিকে অর্থ বা সম্মানদ্বারা সমাদর করিলেও কখনই তাহার মনে শান্তি বা বিশ্বাসের উদয় হয় না। তৎকৃত অপকার তাহার অন্তঃকরণে ভয় সঞ্চারিত করিয়া থাকে। অতঃপর অন্য লোকে আমাদের অপকার করিতে চেষ্টা করিলে, আমরা কখনই পরস্পর সাহায্যদানে যত্ন করিব না। ফলতঃ, আমি বিশ্বাসনিবন্ধন তোমার গৃহে বাস করিয়াছিলাম, এক্ষণে আর তোমার প্রতি বিশ্বাস হইতেছে না।’

“ব্রহ্মদত্ত কহিলেন, ‘পূজনি! কালপ্রভাবেই সমুদয় কাৰ্য্য ঘটিয়া থাকে। অতএব কার্য্যনিবন্ধন কেহ কাহারও নিকট অপরাধী হইতে পারে না। জীবগণ কালসহকারেই জন্মগ্রহণ এবং সেই কালপ্রভাবেই আবার দেহত্যাগ করিতেছে। এই জগতে কেহ কেহ এককালে ও কেহ কেহ বা ক্রমে ক্রমে দেহত্যাগ করিতেছে এবং . কেহ কেহ বা অনেক দিন জীবিত রহিয়াছে। অগ্নি যেমন কাষ্ঠকে দগ্ধ করে, তদ্রূপ কাল জীবগণকে নিরন্তর দগ্ধ করিতেছে; অতএব আমরা পরস্পর পরস্পরের সুখ-দুঃখের কারণ নহি। কালই প্রতিনিয়ত জীবগণের সুখদুঃখ বিধান করিতেছে। এক্ষণে তুমি আমার প্রতি স্নেহভাব অবলম্বন করিয়া স্বেচ্ছানুসারে এই স্থানে বাস কর। আমি তোমার কিছুমাত্র অপকার করিব না। তোমার যে অপরাধ হইয়াছে, আমি তাহা ক্ষমা করিলাম, তুমিও আমার দোষ মার্জ্জনা কর।

“পূজনী কহিল, মহারাজ! যদি কালকেই সকল কার্য্যের কারণ বলিয়া নির্দ্দিষ্ট কর, তাহা হইলে বল দেখি, লোকে বন্ধুবান্ধবগণের বিয়োগে কি নিমিত্ত শোকাকুল হয়! যদি কালই সুখ-দুঃখ ও পরাভবের হেতু হয়, তাহা হইলে পূৰ্ব্বকালে দেবগণ কি নিমিত্ত অসুরদিগের সহিত তুমুল সংগ্রাম করিয়াছিলেন? যদি কালসহকারে লোকে আরোগ্য লাভ করিতে পারে, তাহা হইলে চিকিৎসকেরা কি জন্য রোগীর নিমিত্ত ঔষধ প্রস্তুত করেন? যদি কালই সকল কার্য্যের কারণ হয়, তাহা হইলে লোকে শোকাকুল হইয়া কি নিমিত্ত বিবিধ প্রলাপ করে এবং পাপকর্ত্তাকেই বা কি নিমিত্ত পাপভোগ করিতে হয়? হে মহারাজ! তোমার পুত্র আমার সন্তানকে বিনষ্ট করিয়াছে বলিয়া আমিও তোমার পুত্রকে নিহত করিয়াছি, অতঃপর তুমি সুযোগ পাইলেই আমাকে বিনাশ করিবে। আমি পুত্রশোকে কাতর হইয়া তোমার পুত্রকে বিনষ্ট করিয়াছি। এক্ষণে তুমি যে কারণে আমাকে প্রহার করিবে, তাহা কহিতেছি, শ্রবণ কর। মানবগণ ভোজন বা ক্রিয়া করিবার নিমিত্ত পক্ষী গ্রহণ করিবার বাঞ্ছা করে। বধ ও বন্ধন ভিন্ন তাহাদিগের সহিত মনুষ্যের আর কোন সম্বন্ধই নাই। বেদবিৎ পণ্ডিতেরা মরণ ও বন্ধনজনিত দুঃখ পরিজ্ঞাত আছেন বলিয়াই ভয়প্রযুক্ত মোক্ষতন্ত্র আশ্রয় করিয়াছেন। প্রাণ ও পুত্র সকলেরই প্রিয়। সকলেই দুঃখে কাতর হয় এবং সুখলাভের প্রত্যাশা করে। জরা, অর্থনাশ, অনিষ্টসংযোগ ও ইষ্ট-বিয়োগ হইতেই দুঃখ উৎপন্ন হইয়া থাকে। মানবগণ বৈরজনিত, স্ত্রীকৃত, পুত্রবিয়োগজ ও সহজ দুঃখে সৰ্ব্বদা অভিভূত হইয়া থাকে। অনেক বুদ্ধিহীন ব্যক্তি পরদুঃখকে দুঃখ বলিয়া কীৰ্ত্তন করে না। যে ব্যক্তি কখন দুঃখ ভোগ না করে, সেই ব্যক্তিই ভদ্রলোকের নিকট পরের দুঃখকে দুঃখ বলিয়া স্বীকার করিতে চাহে না। কিন্তু যে ব্যক্তি দুঃখে অভিভূত হইয়া শোক প্রকাশ এবং পরের দুঃখকে আপনার দুঃখের ন্যায় বিবেচনা করে, সে কখনই পরদুঃখ-দর্শনে সুস্থির হইতে পারে না।

‘হে মহারাজ! আমরা পরস্পর পরস্পরের যে অপকার করিয়াছি, তাহা শত বৎসরেও অন্তর হইতে অন্তর্হিত হইবার নহে। অতএব আমাদিগের পুনরায় সন্ধি করা কিরূপে যুক্তিসিদ্ধ হইতে পারে? পুত্রকে স্মরণ করিলেই আমার সহিত তোমার নতুন বৈরভাব উপস্থিত হইবে। একজনের সহিত শত্রুতা করিয়া তৎক্ষণাৎ তাহার সহিত সন্ধি করিলে ভগ্ন মৃন্ময়পাত্রের সন্ধির ন্যায় [ভগ্নমৃত্তিকাপাত্রের পরস্পর জোড়া লাগানর] উহা অচিরাৎ বিনষ্ট হইয়া যায়। স্বার্থশাস্ত্রবেত্তারা অবিশ্বাসকেই সুখের মূলীভূত বলিয়া কীৰ্ত্তন করেন। পূর্বে শুক্রাচার্য্য প্রহ্লাদের নিকট কহিয়াছিলেন, যে ব্যক্তি শত্রুর বাক্যে বিশ্বাস করে, তাহাকে মধুলোভে শুষ্কতৃণসমাচ্ছন্ন কূপে নিপতিত মধুলাভার্থীর ন্যায় অচিরাৎ বিনষ্ট হইতে হয়। অনেক স্থলে শত্রুতা বংশপরম্পরাগত হইতে দেখা গিয়াছে। দুই ব্যক্তি পরস্পর শত্রুতা করিয়া পরলোকগমন করিলে অন্যান্য ব্যক্তি সেই দুই জনের পুত্র পৌত্রগণকে সেই শত্রুতায় প্রবর্ত্তিত করিবার নিমিত্ত উত্তেজিত করিয়া থাকে। ভূপালগণ প্রায়ই শত্ৰুদিগের সহিত সন্ধিস্থাপন পূৰ্ব্বক সান্ত্বনা করিয়া পরিশেষে তাহাকে পাষাণ-নিপাতিত পূর্ণঘটের ন্যায় চূর্ণ করেন। উঁহারা যাহার অপকার করেন, তাহাকে কখনই বিশ্বাস করেন না। একজনের অপকার করিয়া তাহার প্রতি বিশ্বাস করিলে অবশ্যই দুঃখভোগ করিতে হয়।

“ব্রহ্মদত্ত কহিলেন, ‘পূজনি! ইহলোকে অবিশ্বাসদ্বারা কাহারও অর্থলাভ হয় না এবং ভয় লোককে মৃতকল্প করিয়া রাখে।”

“পূজনী কহিল, ‘মহারাজ! যে ব্যক্তির চরণদ্বয়ে ক্ষত, সে অতি সাবধানে ধাবমান হইলেও তাহার পদদ্বয়ে অবশ্যই আঘাত লাগিয়া থাকে। যে ব্যক্তি নেত্ররোগে একান্ত আক্রান্ত, সে বায়ুর প্রতিকূলে নয়নদ্বয় উন্মীলিত করিলে নিশ্চয়ই তাহার নেত্ররোগ বৰ্দ্ধিত হয়। যে ব্যক্তি আপনার বল বিদিত না হইয়া মোহপ্রযুক্ত দুষ্টপথ আশ্রয় করে, তাহাকে নিশ্চয়ই অচিরাৎ বিনষ্ট হইতে হয়। যে ব্যক্তি বৃষ্টির কালাকাল পরিজ্ঞাত না হইয়া ক্ষেত্র কর্ষণ করে, সে কখনই শস্যলাভ করিতে সমর্থ হয় না। যে ব্যক্তি প্রতিদিন দেহের হিতসাধনোপযোগী তিক্ত, কষায় বা মধুর আস্বাদসম্পন্ন বস্তু আহার করে, তাহার সে সমুদয় বস্তু অমৃতরূপে পরিণত হইয়া থাকে। আর যে ব্যক্তি পরিণাম বিবেচনা না করিয়া লোভবশতঃ পথ্য পরিত্যাগপূর্ব্বক অপথ্যবস্তু ভোজন করে, তাহাকে অচিরাৎ কালকবলে নিপতিত হইতে হয়। দৈব ও পুরুষকার পরস্পরের আশ্রয় গ্রহণ করিয়া আছে। উদারস্বভাব পুরুষেরা ঐ উভয়ের মধ্যে পুরুষকার শ্রেষ্ঠ বলিয়া গণনা করেন; আর অসার ব্যক্তিরা দৈবকেই বলবান জ্ঞান করিয়া প্রতিনিয়ত উহার উপাসনা করিয়া থাকে। যে কাৰ্য্য আপনার হিতকর, তাহা তীক্ষ্ণ হউক বা মৃদুই হউক, তাহার অনুষ্ঠান করা অবশ্য কর্ত্তব্য। কার্য্যবিহীন মূর্খদিগকেই সৰ্ব্বদা অনর্থগ্রস্ত হইতে হয়; অতএব দৈব অবলম্বন করিয়া পরাক্রমসহকারে কাৰ্য্য করাই বিধেয়। মানবগণ সৰ্ব্বস্ব পরিত্যাগ করিয়াও আপনার হিতজনক কার্য্যের অনুষ্ঠান করিবে। বিদ্যা, শৌর্য্য, দক্ষতা, বল ও ধৈৰ্য্যই লোকের সহজ মিত্র। লোকে ঐ সমুদয়ের প্রভাবেই সুখে জীবন যাপন করিতে পারে। প্রাজ্ঞ পুরুষেরা সৰ্ব্বস্থানেই গৃহ, তাম্ৰাদি ধাতু, ক্ষেত্র, ভাৰ্য্যা ও সুহৃদলাভ করিয়া পরমসুখে কালহরণে সমর্থ হয়েন। উহারা কাহাকেও ভয় প্রদর্শন করেন না এবং কাহারও নিকট ভীত হয়েন না।

‘কার্য্যদক্ষ বুদ্ধিমান ব্যক্তির অল্প অর্থ থাকিলেও তাহা ক্রমে পরিবর্দ্ধিত হয়। কার্য্যদক্ষ না হইলে অর্থবৃদ্ধি হইবার সম্ভাবনা নাই। যে নির্ব্বোধেরা গৃহস্নেহে বদ্ধ হইয়া অন্যত্র গমনের বাঞ্ছা করে, তাহাদিগকে তাহাদের দুশ্চরিত্রা ভার্য্যাগণের দোষে সন্তান প্রসবিনী কর্কটীদিগের [কাঁকড়াদিগের গর্ভবতী কাঁকড়ার সন্তান প্রসবের দ্বার না থাকায় পেট ফাটিয়া মরিয়া যায়] ন্যায় অচিরাৎ অবসন্ন হইতে হয়। কোন কোন মনুষ্য বিদেশে গমন করিতে হইলে আপনাদের বুদ্ধির দোষে “আমার গৃহ, আমার ক্ষেত্র, আমার মিত্র ও আমার স্বদেশ” এই মনে করিয়া যারপরনাই ব্যাকুল হইয়া থাকে।

স্বদেশ ব্যাধি বা দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত হইলে তথা হইতে পলায়নপূৰ্ব্বক অন্য দেশে গমন এবং জনসমাজে সম্মানিত হইয়া তথায় অবস্থান করা সকলেরই কর্ত্তব্য। এক্ষণে আমি এ স্থান হইতে অন্য স্থানে প্রস্থান করিব। আমি তোমার পুত্রের অনিষ্টাচরণ করিয়াছি বলিয়া আর আমার এ স্থানে বাস করিতে অভিলাষ নাই। কুভাৰ্য্যা, কুপুত্র, কুরাজা, কুসুহৃদ, কুসম্বন্ধ ও কুদেশ পরিত্যাগ করা সৰ্ব্বতোভাবে কৰ্ত্তব্য। কুপুত্রের প্রতি বিশ্বাস থাকে না; কুভাৰ্য্যাতে অনুরাগ জন্মে না; কুরাজার রাজ্যে সুখ ও কুদেশে জীবিকা লাভ করা নিতান্ত সুকঠিন; কুমিত্রের সহিত সদ্ভাব চিরস্থায়ী হয় না এবং অর্থক্ষয় হইলেই কুসম্বন্ধনিবন্ধন অবমানিত হইতে হয়। যে ভাৰ্য্যা প্রিয়বাদিনী হয়, তাহাকেই ভাৰ্য্যা, যে পুত্র হইতে সুখলাভ হয়, তাহাকেই পুত্র, যে মিত্র বিশ্বাসের পাত্র হয়, তাহাকেই মিত্র, যে দেশে সুখে জীবিকা নির্ব্বাহ হয়, তাহাকেই দেশ এবং যে রাজা প্রজাগণের প্রতি বল প্রকাশ বা তাহাদিগকে ভয়প্রদর্শন না করেন ও দরিদ্রদিগকে প্রতিপালন করেন, তাঁহাকেই রাজা বলিয়া কীৰ্ত্তন করা যাইতে পারে। নরপতি ধৰ্ম্মজ্ঞ গুণসম্পন্ন হইলেই প্রজাগণ পুত্র, কলত্র ও বন্ধুবান্ধবে পরিবৃত হইয়া স্বদেশে সুখে অবস্থান করিতে পারে; আর রাজা অধার্ম্মিক হইলে প্রজাগণকে নিগৃহীত ও বিনষ্ট হইতে হয়। ভূপতিই প্রজাগণের ত্রিবর্গের মূল। অতএব অপ্রমত্তচিত্তে তাহাদিগকে পালন করা তাঁহার অবশ্য কর্ত্তব্য। যে রাজা প্রজাদিগের উপার্জ্জিত অর্থের ষষ্ঠাংশ করস্বরূপ গ্রহণ করিয়া তাহাদিগকে সুচারুরূপে প্রতিপালন করেন, তাঁহাকে তস্কর বলিয়া নির্দেশ করা যাইতে পারে। যে রাজা প্রজাগণকে অভয় প্রদান করিয়া অর্থলোভে বিপরীতাচরণে প্রবৃত্ত হয়েন, সেই অধৰ্ম্মবুদ্ধি নরপতিকে সকল লোকের নিকট পাপ সংগ্রহপূর্ব্বক নরকগামী হইতে হয়। আর যে রাজা প্রজাদিগকে অভয় প্রদান করিয়া তদনুরূপ কাৰ্য্য করেন, তিনি অশেষ সুখভোগ করিতে সমর্থ হয়েন এবং প্রজাগণ সতত তাহার প্রতি অনুরাগ প্রদর্শন করে।

‘প্রজাপতি মনু নরপতিকে মাতা, পিতা, গুরু, রক্ষিতা, বহ্নি, কুবের ও যম বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়া গিয়াছেন। যে রাজা প্রজাবর্গের প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শন করেন, তিনি রাজ্যের পিতৃস্বরূপ। যে ব্যক্তি তাঁহার সহিত মিথ্যা-ব্যবহার করে, তাহাকে, তির্য্যগযোনি প্রাপ্ত হইতে হয়। রাজা প্রজাগণের হিতচিন্তা ও দরিদ্রদিগের ভরণ-পোষণ করিয়া তাহাদের জননীর, কোপপ্রভাবে অনিষ্ট দহনপূৰ্ব্বক অগ্নির, দুষ্টের দমন করিয়া যমের, ইষ্টবিষয়ে অর্থ প্রদানপূৰ্ব্বক কুবেরের, ধর্ম্মোপদেশ প্রদান করিয়া গুরুর এবং রাজ্যপালনপূৰ্ব্বক রক্ষকের কাৰ্য্য করিয়া থাকে। যে রাজা স্বীয় গুণদ্বারা পুরবাসী ও জনপদবাসীদিগের প্রীতিসম্পাদন করিতে পারেন, তাঁহার রাজ্য কোনকালেই ধ্বংস হয় না। যে রাজা স্বয়ং পুরবাসীদিগের সম্মান করেন, তিনি উভয় লোকেই সুখভোগ করিতে পারেন। যে রাজার প্রজাগণ সর্ব্বদা করভারে পীড়িত, উদ্বিগ্ন ও বিপদগ্রস্ত হয়, তিনি নিশ্চয়ই শক্তহস্তে পরাভূত হইয়া থাকেন। যে ভূপতির প্রজাগণ সরোবরসঞ্জাত উৎপলসমুদয়ের ন্যায় দিন দিন পরিবর্দ্ধিত হয়, তিনি ইহলোকে উৎকৃষ্ট ফলভোগ করিয়া পরলোকে স্বর্গসুখ অনুভব করিতে পারেন। বলবানের সহিত যুদ্ধ করা বিধেয় নহে। বলবান্ শত্রু যাহাকে আক্রমণ করে, তাহার রাজ্যলাভ ও সুখভোগের কিছুমাত্র সম্ভাবনা নাই।’

“হে ধৰ্ম্মরাজ! পূজনী মহারাজ ব্রহ্মদত্তকে এই কথা কহিয়া তাঁহার অনুজ্ঞা গ্রহণপূৰ্ব্বক অভীষ্টস্থানে প্রস্থান করিল। এই আমি তোমার নিকটে পূজনী ও ব্রহ্মদত্তের ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিলাম। এক্ষণে তোমার আর যাহা শ্রবণ করিতে বাঞ্ছা হয়, আমার নিকট ব্যক্ত কর।”