১০৩. শত্রুভেদে সামাদিপ্রয়োগ—ইন্দ্ৰ-বৃহস্পতি-সংবাদ

১০৩তম অধ্যায়

শত্রুভেদে সামাদিপ্রয়োগ—ইন্দ্ৰ-বৃহস্পতি-সংবাদ

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! মৃদু, তীক্ষ্ণ ও সহায়সম্পন্ন অরাতিগণের মধ্যে কাহার সহিত কিরূপ ব্যবহার করিতে হইবে, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মনন্দন! এই বিষয় উপলক্ষে ইন্দ্র বৃহস্পতি-সংবাদনামে এক পুরাতন ইতিহাস কীৰ্ত্তিত আছে, শ্রবণ কর। একদা শত্রুহন্তা সুররাজ পুরন্দর দেবগুরু বৃহস্পতিসমীপে সমুপস্থিত হইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে বিনীতভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘ব্রহ্মন্! আমি কিরূপে সতত সাবধান হইয়া শত্রুগণের সহিত ব্যবহার করিব এবং কি উপায়েই বা তাহাদিগকে এককালে উচ্ছিন্ন করিয়া আপনার বশবর্ত্তী করিব? আমি অরাতির সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলে তাহার ও আমার, আমাদের উভয়েরই জয়লাভের সম্ভাবনা; কিন্তু আমি কি উপায় অবলম্বন করিলে শত্রুকে জয়লাভে বঞ্চিত করিয়া স্বয়ং জয়ী হইতে পারিব?

“তখন অসাধারণ ধীশক্তিসম্পন্ন [বুদ্ধিমান্] ত্রিবর্গবেত্তা [ধৰ্ম্ম-অর্থ-কামনাবিৎ] রাজধৰ্ম্মজ্ঞ [রাজনীতিনিপুণ] বৃহস্পতি ইন্দ্রকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘পুরন্দর! কলহদ্বারা শত্রুগণকে শাসন করিতে বাসনা করা কদাপি বিধেয় নহে। বালকগণই রোষ ও অক্ষমপরবশ [অধৈর্য্যের অধীন] হইয়া থাকে। শত্রুর বধকামনা করিয়া উহা প্রকাশ করা কর্ত্তব্য নহে। শত্রুর নিকট ক্রোধ, ভয় ও হর্ষলক্ষণসকল গোপন করিয়া রাখা এবং তাহার প্রতি বিশ্বাস না করিয়া বিশ্বস্তের ন্যায় ব্যবহার করা উচিত। বুদ্ধিমান ব্যক্তি শত্রুর প্রতি প্রতিনিয়ত প্রিয়বাক্য প্রয়োগ করিবেন এবং কদাপি উহার সহিত অপ্রিয় ব্যবহার, বৃথা বৈরাচরণ বা মুর্খতা প্রকাশ করিবেন না। ব্যাধগণ যেমন পক্ষীদিগের ন্যায় শব্দ করিয়া তাহাদিগকে বশীভূত করে, নরপতিও তদ্রূপ শত্রুগণের সহিত আত্মীয়বৎ ব্যবহার করিয়া তাহাদিগকে বশীভূত বা বিনষ্ট করিবেন। অরাতিকে পরাভব করিয়া নিয়ত নিশ্চিন্ত থাকা উচিত নহে। দুরাত্মারা চটৎকারশীল [চট্‌চটাশব্দকারী—কাষ্ঠদহনকালে চটচট শব্দ হয়] বহ্নির ন্যায় নিয়ত জাগরিত থাকে। সংগ্রামে উভয় পক্ষেরই জয়লাভের সম্ভাবনা; অতএব যুদ্ধে প্রবৃত্ত হওয়া নিতান্ত অনুচিত। শত্রুকে বশীভূত করিয়া পুনরায় তাহাকে ক্ষমতা প্রদান বা উপেক্ষা করিলে সে প্রতিপক্ষের অনবধানতা দেখিলেই প্রহার, ভেদোৎপাদন ও অর্থদান প্রভৃতি উপায়দ্বারা তাহার সৈন্যগণকে আপনার বশে আনয়ন ও প্রচ্ছন্নভাবে তাহার সৰ্ব্বনাশের চেষ্টা করে।

বুদ্ধিমান্ ব্যক্তি কদাপি শত্রুর সংসর্গ পরিত্যাগ করিবেন না। সহসা শত্রুকে আক্রমণ না করিয়া দীর্ঘকাল উপেক্ষা করিয়া তাহার বিশ্বাসোৎপাদন ও বিনাশের চেষ্টা করাই তাঁহার কর্ত্তব্য। এককালে অনেক শত্রুকে প্রহার বা উহাদের প্রতি কটুবাক্য প্রয়োগ করা বিধেয় নহে। উপযুক্ত সময় উপস্থিত হইলেই শত্রুকে প্রহার করিবে। কদাপি কালান্তর প্রতীক্ষা করিবে না। কার্য্যসাধনের সুযোগ একবার অতিক্রম হইলে উহা পুনরায় প্রাপ্ত হওয়া সহজ নহে। অনুপযুক্ত সময়ে কদাপি শত্রুর প্রতি তেজঃপ্রকাশ বা তাহার পরাভবের চেষ্টা করিবে না। কাম, ক্রোধ ও অহঙ্কার পরিহারপূর্ব্বক নিয়ত শত্রুগণের রন্ধ্র অন্বেষণ করিবে। অদূরদর্শী নরপতিকে স্বীয় আলস্য, মৃদুতা, অধিক দণ্ডবিধান ও প্রমাদ এবং শত্রুর সুপ্রযুক্ত মায়াপ্রভাবে উৎসন্ন হইতে হয়। যে রাজা আলস্য প্রভৃতি দোষসমুদয় পরিত্যাগ ও অরাতির মায়া অতিক্রম করিতে পারেন, তিনি অনায়াসে শত্রুপক্ষের বিনাশসাধনে সমর্থ হয়েন। যদি কোন মন্ত্রী একাকীই কোন গোপনীয় কাৰ্য্যে সমর্থ হয়, তবে কেবল তাহারই সহিত সেই বিষয়ের মন্ত্রণা করা কর্ত্তব্য। অনেক অমাত্যের সহিত উহার মন্ত্রণা করিলে তাহারা পরস্পর পরস্পরের প্রতি সেই কাৰ্য্যের ভারার্পণ করে, তাহাতে কাৰ্য্যহানির বিলক্ষণ সম্ভাবনা। যদি একের সহিত মন্ত্রণা করিলে উহাতে কোন ব্যাঘাত উপস্থিত হয়, তবে অন্যান্য অমাত্যগণের সহিত মন্ত্রণা করা উচিত। শত্রু দূরে অবস্থান করিলে পুরোহিতদ্বারা অভিচারপ্রয়োগ এবং নিকটে অবস্থিত হইলে তাহার প্রতি চতুরঙ্গিণী সেনা প্রেরণ করা অবশ্য কর্ত্তব্য। নরপতি উপযুক্ত সময় বুঝিয়া প্রথমতঃ শত্ৰুদিগের ভেদোৎপাদনপূৰ্ব্বক পরিশেষে গোপনে দণ্ডবিধান করিবেন। কালবশতঃ শত্রু বলবান হইয়া উঠিলে প্রথমতঃ তাহার নিকট অবনত হওয়া এবং তৎপরে তাহার অনবধানসময়ে সাবধান হওয়া, তাহার বধকামনা করা রাজার অবশ্য কর্ত্তব্য। প্রণিপাত, অর্থদান এবং মধুরবাক্য প্রয়োগ করিয়া বলবান শত্রুর মনোরঞ্জন করা আবশ্যক; তাহার শঙ্কা উৎপাদন করা কদাচ বিধেয় নহে। শঙ্কার স্থানসকল সতত পরিত্যাগ করা উচিত। শত্রুগণের প্রতি বিশ্বাস করা রাজার কর্ত্তব্য নহে। উহারা পরাভূত হইয়া সতত অবহিত থাকে। অস্থিরচিত্ত মানবগণের উন্নতিলাভ অপেক্ষা দুর্ঘট আর কিছুই নাই; অতএব রাজা সতত স্থিরচিত্ত হইয়া, কে মিত্র আর কে অমিত্র, তাহা সবিশেষ পর্য্যালোচনা করিবেন।

‘রাজা মৃদু হইলে সকলেই তাঁহাকে পরাভব করিয়া থাকে এবং অতিশয় উগ্রস্বভাব হইলে তাহা হইতে ভীত হয়; অতএব তুমি নিতান্ত মৃদু বা নিতান্ত উগ্র হইও না। রাজ্যরক্ষায় নিতান্ত অমনোযোগী ব্যক্তির রাজ্য বেগবতী নদীর তীরস্থিত সলিলসমাক্রান্ত [জলের বেগে বিধ্বস্ত] প্রাসাদের ন্যায় অচিরাৎ উৎসন্ন হইয়া যায়। শত্রুসংখ্যা অধিক হইলে তাহাদিগের সকলকেই এককালে আক্রমণ করা বিধেয় নহে; প্রত্যুত সন্ধি, দান, ভেদ ও দণ্ডদ্বারা ক্রমে ক্রমে তাহাদিগের অনেককে বশীভূত করিয়া অবশিষ্ট অল্পসংখ্যক ব্যক্তিকে এককালে আক্রমণ করিবে। সামর্থ্য থাকিলেও এককালে সকলকে আক্রমণ করা বুদ্ধিমান রাজার কর্ত্তব্য নহে। যখন হস্তী, অশ্ব, রথ ও পদাতিসঙ্কুল যন্ত্রবহুল সেনাগণ অনুরক্ত থাকিবে, যখন শত্রু অপেক্ষা আপনার বল অধিক বলিয়া বিবেচিত হইবে, রাজা সেই সময়েই প্রকাশ্যরূপে অবিচারিতচিত্তে শত্রুকে প্রহার করিবেন। শত্রু অপেক্ষাকৃত বলবান্ হইলে তাহার সহিত সন্ধি, তাহার উপর মৃদুভাব অবলম্বন বা প্রকাশ্যে তাহার প্রতি যুদ্ধার্থ গমন না করিয়া গোপনে তাহার দণ্ডবিধান করা কর্ত্তব্য। প্রকাশ্যভাবে বলবান্ শত্রুর সহিত যুদ্ধ করিতে গমন করিলে শস্যনাশ ও সলিলে বিষসংযোগ এবং কোষ, অমাত্য প্রভৃতি সপ্তবিধ প্রকৃতির উপর বারংবার সন্দেহ উৎপত্তিনিবন্ধন চিন্তাবৃদ্ধি হইবার বিলক্ষণ সম্ভাবনা। অতএব উহা সৰ্ব্বতোভাবে পরিহার করাই উচিত। শত্রুর প্রতি সতত মায়া প্রয়োগ এবং শত্রুগণের উত্তেজনা ও অপযশ ঘোষণা করিবে। অরাতিগণ স্ব স্ব নগর ও জনপদমধ্যে যেসমস্ত কার্য্যানুষ্ঠান করিবে, বিশ্বস্ত মনুষ্যদ্বারা তাহার তত্ত্বাবধান করা অবশ্য কর্ত্তব্য। ভূপালগণ শত্রুবর্গের পুরমধ্যে প্রবেশ করিয়া তত্রত্য ভোগ্যবস্তুর উচ্ছেদ এবং আপনার নগরমধ্যে নীতি প্রচার করিবেন। শত্রুকে প্রতারণা করিবার নিমিত্ত গোপনে চরদিগকে ধন প্রদান ও সৰ্ব্বসমক্ষে তাহাদিগের ভোগ্যদ্রব্যসমুদয় অপহরণপূৰ্ব্বক ইহারা দুষ্টস্বভাব বলিয়া তাহাদিগকে শত্রুরাজ্যে প্রেরণ করিবেন। ঐ সময় সুশিক্ষিত বিদ্বান্ ব্যক্তিদিগের দ্বারা আপনার পুরমধ্যে শত্রুবিনাশার্থ দৈবক্রিয়ার অনুষ্ঠান করা তাঁহার কর্ত্তব্য।

‘ইন্দ্ৰ কহিলেন, ভগবন্! কোন্ কোন্ চিহ্নদ্বারা দুষ্ট ব্যক্তিকে বিদিত হওয়া যায়, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।’

“বৃহস্পতি কহিলেন, “হে দেবরাজ! দুষ্ট ব্যক্তিরা পরোক্ষে অন্যের দোষকীৰ্ত্তন, লোকের সদ্‌গুণে অসূয়াপ্রদর্শন বা অন্যের গুণকীৰ্ত্তন শ্রবণপূৰ্ব্বক মৌনাবলম্বন করিয়া থাকে। উহাদের সতত ঘন ঘন দীর্ঘনিশ্বাস, ওষ্ঠদংশন ও শিরঃপ্রকম্পন প্রভৃতি বিকারসমুদয় লক্ষিত হয়। উহারা সততই লোকের সংসর্গে অবস্থান ও জনসমাজে অসংলগ্ন বাক্য প্রয়োগ করে। পরোক্ষে অঙ্গীকার-প্রতিপালন ও সাক্ষাতে তদ্বিষয়ক কোন কথাই উল্লেখ করে না, পৃথক পৃথক্ আসিয়া আহার করে এবং “অদ্য আহাৰ্য্য বস্তুসমুদয় উৎকৃষ্ট হয় নাই” বলিয়া দোষারোপে প্রবৃত্ত হয়। ফলতঃ শয়ন, উপবেশন ও গমন প্রভৃতি সকল কাৰ্য্যেই উহাদিগের দুষ্টভাব লক্ষিত হইয়া থাকে।

‘দুঃখের সময় দুঃখিত ও আহ্বাদের সময় আহ্লাদিত হওয়াই মিত্রের লক্ষণ; ইহার বিপরীত কাৰ্য্য শত্রুতার চিহ্ন। হে সুররাজ! এই আমি তোমার নিকট শাস্ত্রানুসারে দুষ্টের স্বভাব কীৰ্ত্তন করিলাম।

“হে ধৰ্ম্মরাজ! শত্রুবিনাশনিরত সুররাজ বৃহস্পতির সেই শাস্ত্রসম্মত বাক্য শ্রবণ করিয়া সংগ্রামকালে তদনুসারে কার্য্যানুষ্ঠানপূর্ব্বক বিপক্ষগণকে বশবর্ত্তী করিয়াছিলেন।”