১০১. যোদ্ধা বীরপুরুষের লক্ষণ

১০১ম অধ্যায়

যোদ্ধা বীরপুরুষের লক্ষণ

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! লোকে কিরূপ আচারপরায়ণ, কীদৃশ আকারসম্পন্ন এবং কি প্রকার বর্ম্ম ও অস্ত্রধারী হইলে যুদ্ধের উপযুক্ত হইতে পারে?”

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! যুদ্ধস্থলে কুল ও দেশাচার-প্রচলিত শস্ত্র ও বাহন ব্যবহার করাই প্রশস্ত। বীরপুরুষেরা ঐ নিয়মের অনুবৰ্ত্তী হইয়াই যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া থাকেন। নির্ভীক্‌চিত্ত মহাবলপরাক্রান্ত গান্ধার, সিন্ধু, সৌবীরগণ নখর ও প্রাসদ্বারা যুদ্ধ করিয়া থাকে। সৰ্ব্বশস্ত্রবিশারদ বলবীৰ্য্যশালী কূটযুদ্ধপরায়ণ প্রাচ্যগণ হস্তীতে আরোহণপূৰ্ব্বক উত্তম যুদ্ধ করিতে পারে। যবন, কাম্বোজ ও মথুরানিবাসী বীরগণের বাহুযুদ্ধে এবং দাক্ষিণাত্যদিগের অসিযুদ্ধে বিশেষ নৈপুণ্য আছে।

“সকল দেশেই বীরপুরুষ জন্মপরিগ্রহ করিয়া থাকেন। এক্ষণে যেসমস্ত লক্ষণ থাকিলে বীর বলিয়া নির্দেশ করা যাইতে পারে, তাহা শ্রবণ কর। যাহাদিগের কণ্ঠস্বর ও গতি সিংহ ও শার্দ্দুলের ন্যায় এবং চক্ষু পারাবত ও সর্পের ন্যায়, তাহারা অনায়াসে শত্রুসৈন্য বিমর্দ্দন করিতে পারে। যাহাদের কণ্ঠস্বর মৃগের ন্যায় এবং চক্ষু ব্যাঘ্র ও বৃষভের ন্যায়, তাহারা অনবহিত, মূর্খ ও ক্রোধপরায়ণ হইয়া থাকে। যাহারা উষ্ট্র ও মেষের ন্যায় গভীর গর্জ্জন এবং অনায়াসে বহুদূরে গমন করিতে পারে, যাহাদিগের নাসাগ্র ও জিয়া অতিশয় কুটিল, কলেবর বিড়ালের ন্যায় কুব্জ, কেশকলাপ অতিবিরল, গাত্রের চর্ম্ম অতিসূক্ষ্ম ও চিত্ত অতিশয় চঞ্চল, তাহারাই নিতান্ত দুর্দ্ধর্ষ হইয়া থাকে। যাহারা গোধার ন্যায় মৃদুভাবসম্পন্ন এবং যাহারা অশ্বের ন্যায় মহাবেগে গমন ও চীৎকার করিতে পারে, তাহারা অনায়াসে সমরসাগর সমুত্তীর্ণ হয়। যাহারা অতিশয় দৃঢ়কলেবর, যাহাদিগের বক্ষঃস্থল অতিবিশাল, যাহারা বাদিশব্দে ক্রূদ্ধ ও কলহ উপস্থিত হইলে পুলকিত হয়, যাহাদিগের চক্ষু পিঙ্গল, গাম্ভীৰ্য্যসূচক, বহিনির্গত ও নকুলের ন্যায় অতিকুটিল এবং মুখমণ্ডল ভ্রুকুটিকুটিল, তাহারা অনায়াসে শরীররক্ষায় নিরপেক্ষ হইয়া যুদ্ধ করিতে পারে। যাহাদিগের ললাট অতি প্রশস্ত, হনুদেশ [ললাটের উপরিভাগ] মাংসশূন্য, বাহু ও অঙ্গুলি বজ্রের ন্যায় সুদৃঢ়, শরীর কৃশ ও শিরাব্যাপ্ত এবং যাহারা যুদ্ধ উপস্থিত হইলে মত্ত মাতঙ্গের ন্যায় মহাবেগে সমরাঙ্গনে প্রবেশ করে, তাহাদিগকে পরাজয় করা নিতান্ত দুঃসাধ্য। যাহাদিগের কেশের প্রান্তভাগ পিঙ্গলবর্ণ ও কুটিল, গণ্ডযুগল ও গ্রীবাদেশ অতিশয় স্থূল, স্কন্ধদ্বয় উন্নত, জানুর অধোভাগ অতি বিকটাকার, মস্তক বর্ত্তুলাকার, মুখমণ্ডল মার্জ্জারের ন্যায় বিস্তীর্ণ, কণ্ঠস্বর অতি ভয়ঙ্কর, যাহারা গরুড়ের ন্যায় উদ্ধত ও রোষপরবশ, যুদ্ধস্থলে যাহাদিগের কখনই শান্তি জন্মে না এবং যাহারা অতিশয় অধর্ম্মপরায়ণ, গর্ব্বিত ও ঘোরদর্শন, তাহারা অনায়াসে জীবিতনিরপেক্ষ ও সমরে অপরাঙ্মুখ হইয়া থাকে। উহারা সকলেই নীচজাতিসমুৎপন্ন। এইরূপ ব্যক্তিদিগকে সৈন্যগণের পুরোবৰ্ত্তী করা অবশ্য কর্ত্তব্য। উহারা সাহসসহকারে বিপক্ষসৈন্যগণকেও বিনষ্ট করে এবং আপনারাও প্রাণপরিত্যাগে ভীত হয় না। উহাদের প্রতি সান্ত্ববাক্য প্রয়োগ করিলে উহারা পরাভব বিবেচনা করিয়া থাকে এবং সতত রাজার প্রতি ক্রোধান্বিত হয়।”