১০৬তম অধ্যায়
গালবের বিলাপ-গরুড়সাক্ষাৎকার
নারদ কহিলেন, “হে দুৰ্য্যোধন! তপোধন গালব বিশ্বামিত্রের আজ্ঞা-শ্রবণে নিতান্ত চিন্তিত হইয়া শয়ন, উপবেশন ও আহার পরিত্যাগপূর্ব্বক ক্রমে অস্থিচর্ম্মমাত্রাবশিষ্ট [চর্ম্মমাত্রে আবৃত মাংসহীন শরীরের হাড় যাহার, তাদৃশ] হইয়া উঠিলেন। অনন্তর দুঃখদগ্ধান্তঃকরণে [দুঃখরূপ অগ্নি দ্বারা দগ্ধ চিত্তে] অশ্রুপূর্ণনয়নে বিলাপ করিতে লাগিলেন, ‘হায়! আমার ধনবান মিত্র বা অর্থ কিছুই নাই; অষ্টশত শ্বেতাশ্ব কোথায় পাইব? আমার ভোজনপ্রবৃত্তি ও সুখাভিলাষ কিছুমাত্র নাই, আর জীবনেচ্ছাও [বাঁচিবার অভিলাষ] বিগত হইয়াছে; অতএব এক্ষণে সমুদ্রপারে বা পৃথিবীর অতিদূরপ্রদেশে গমন করিয়া প্রাণ পরিত্যাগ করি। আমি নিৰ্দ্ধন, অকৃতাৰ্থ [ব্যর্থমনোরথ-যাঁহার প্রয়োজনীয় বিষয় অপূর্ণ থাকে, এইরূপ] ও বিবিধ ফলভোগে বঞ্চিত, বিশেষতঃ, ঋণগ্রস্ত হইলাম; আমার সুখ কোথায়? আমার জীবনে প্রয়োজন কি? যে ব্যক্তি প্ৰণয়পূর্ব্বক সুহৃদের ধনসম্ভোগ করিয়া তাহার প্রত্যুপকারে অসমর্থ হয়, তাহার মৃত্যুই শ্ৰেয়ঃ, জীবনধারণ বিড়ম্বনামাত্র। যে ব্যক্তি কর্ত্তব্যবিষয়ে অঙ্গীকার করিয়া তদনুষ্ঠানে অসমর্থ হয়, তাহার পুণ্যকর্ম্ম ও ইষ্টপূর্ত্ত [জলাশয়াদি নির্ম্মাণ ও রাস্তাদি প্রস্তুতের পুণ্য] বিনষ্ট হয়। সত্যবিহীন ব্যক্তির সদগতিলাভ হওয়া দূরে থাকুক, রূপ, সন্ততি ও আধিপত্য কিছুই থাকে না। কৃতঘ্নের [যে পরোপকার বিস্মৃত হয়] যশ, স্থান বা সুখ কোথায়? সে সকলের আশ্রদ্ধেয় [বিরাগভাজন]; তাহার নিষ্কৃতি নাই। ধনহীনের জীবন বৃথা, তাহার কুটুম্ব থাকিবার সম্ভাবনা কোথায়? পাপাত্মা উপকারীর প্রত্যুপকার করিতে না। পারিয়া অচিরাৎ বিনষ্ট হয়, তাহাতে সন্দেহ নাই।
“আমি নিতান্ত পাপাত্মা, কৃতঘ্ন, দীন ও সত্যবিহীন; আমি গুরুর নিকট প্রতিজ্ঞা করিয়া তৎপ্রতিপালনে অসমর্থ হইলাম। অতএব বিষপান বা উদ্বন্ধন [গলায় দড়ি দেওয়া] প্রভৃতি উপায়দ্বারা প্ৰাণ পরিত্যাগ করাই আমার অবশ্য কর্ত্তব্য। আমি কখন দেবগণের নিকট যাচ্ঞা করি নাই; তাঁহারাও যজ্ঞকালে আমার বহুমান করিয়া থাকেন। অতএব এক্ষণে দেবশ্রেষ্ঠ ত্ৰিভুবনেশ্বর বিষ্ণুর নিকট গমন করি। তিনি সর্ব্বভূতের গতি ও সকলকে উপভোগ প্রদান করেন। আমি প্ৰণতভাবে তাঁহাকে দর্শন করিব।”
“তপোধন গালিব এই কথা কহিবামাত্র তাঁহার প্ৰিয়সখা বিনতানন্দন গরুড় তাঁহার প্রিয়কামনায় তথায় সমুপস্থিত হইয়া কহিলেন, “হে বান্ধব! তুমি আমার এবং অন্যান্য সুহৃদ্বর্গের অভিমত সুহৃদ; তোমার অভিলাষ সাধন ও তোমাকে বিভবশালী করা আমার অবশ্য কর্ত্তব্য। আমার বিভব ভগবান মধুসূদন, আমি তাঁহার নিকট প্রার্থনা করিয়াছিলাম; তিনিও আমার প্রার্থনা পূরণ করিয়াছেন। অতএব চল, যে স্থানে তোমার ইচ্ছা হয়, তথায় আমরা দুইজনে শীঘ্ৰ গমন করি।’ ”