১৯৯. ধৃষ্টদ্যুম্নের প্রতি সাত্যকি তিরস্কার

১৯৯তম অধ্যায়

ধৃষ্টদ্যুম্নের প্রতি সাত্যকি তিরস্কার

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! যে মহাত্মা সাঙ্গবেদ অধ্যয়ন করিয়াছিলেন, যিনি ধনুৰ্ব্বেদে অদ্বিতীয়, যাঁহাতে লজ্জা ও দেবসেবাব্রত সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং প্রধান পুরুষগণ যাঁহার অনুগ্রহে দেবগণেরও দুষ্কর অদ্ভুত কার্য্যসমুদয়ের অনুষ্ঠান করিতেছেন, সেই মহর্ষিনন্দন দ্রোণ অশ্বত্থামার মিথ্যা বিনাশবার্তা শ্রবণে রোরুদ্যমান হইলে নীচপ্রকৃতি, ক্ষুদ্রমতি, নৃশংসাচারপরায়ণ ধৃষ্টদ্যুম্ন সর্ব্বসমক্ষে তাঁহাকে সংহার করিয়াছে। কি আশ্চর্য্য! এই বিষয়ে কেহই রোষ প্রকাশ করিতেছে না? অতএব ক্ষত্রিয়ধর্ম্ম ও ক্রোধে ধিক্‌! হে সঞ্জয়! পাণ্ডবেরা এবং অন্যান্য ধনুর্দ্ধর ভূপালগণ এই বিষয় শ্রবণ করিয়া ধৃষ্টদ্যুম্নকে কি কহিলেন, তাহা কীৰ্ত্তন কর।”

সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! দ্রুপদতনয় অর্জ্জুনকে সেই কথা বলিলে অন্যান্য পাণ্ডবগণ তৃষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিয়া রহিলেন। মহাবীর অর্জ্জুন সেই ক্রূরস্বভাব ধৃষ্টদ্যুম্নের প্রতি কটাক্ষনিক্ষেপ করিয়া অনর্গল অশ্রুজল বিসর্জ্জন ও দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক ধৃষ্টদ্যুম্নকে ধিক্কার প্রদান করিলেন। ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির, ভীম, নকুল, সহদেব, কৃষ্ণ ও অন্যান্য বীরগণ লজ্জাবনতমুখে অবস্থান করিতে লাগিলেন। তখন সাত্যকি ক্রোধভরে কহিলেন, ‘পরুষ বাক্যপ্রয়োগে প্রবৃত্ত নরাধম এই পাঞ্চালকুলাঙ্গারকে শীঘ্র বিনষ্ট করিতে পারে, এমন কি কোন ব্যক্তিই নাই? হে ধৃষ্টদ্যুম্ন! ব্রাহ্মণ যেমন চণ্ডালকে নিন্দা করিয়া থাকেন, তদ্রূপ পাণ্ডবগণ তোমার এই পাপকর্ম্ম দর্শনে তোমার নিন্দা করিতেছেন। তুই এই সাধুলোকের নিন্দনীয় কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিয়া জনসমাজে বাক্যব্যয় করিতে কি নিমিত্ত লজ্জিত হইতেছ না? তুমি আচাৰ্য্যবধে প্রবৃত্ত হইলে তোমার জিহ্বা ও মস্তক কি নিমিত্ত শতধা বিদীর্ণ হইল না এবং কি নিমিত্তই বা তুমি অধর্ম্মপ্রভাবে অধঃপতিত হইলে না? তুমি এই গর্হিত কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিয়া জনসমাজের শ্লাঘা প্রকাশপূর্ব্বক পাণ্ডব, অন্ধক ও বৃষিগণের নিকট নিন্দনীয় হইতেছ। তুমি তাদৃশ অনার্য্য কাৰ্য্য সংসাধন করিয়া পুনরায় আচার্য্যের প্রতি বিদ্বেষভাব প্রকাশ করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছ; অতএব তুমি আমাদিগের বধ্য; তোমাকে আর মুহূর্ত্তকাল জীবিত রাখায় আমাদের কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। হে নরাধম! তোমা ভিন্ন অন্য কোন্ ব্যক্তি ধর্ম্মাত্মা সাধু আচার্য্যের কেশগ্রহণপূর্ব্বক বধসাধন করিতে অধ্যবসিত [১] হইয়া থাকে? তুমি পাঞ্চালকুলের কলঙ্ক; তোমার নিমিত্ত তোমার উর্দ্ধতন সপ্ত ও অধস্তন সপ্ত, এই চতুর্দ্দশ পুরুষ যশোভ্রষ্ট ও অধোগামী হইয়াছেন। তুমি অর্জ্জুনকে ভীষ্মঘাতী বলিতেছ, কিন্তু ভীষ্মদেব স্বয়ংই আপনার বিনাশসাধন করিয়াছেন। তোমার সহোদর শিখণ্ডীই সেই ভীষ্মের নিধনের মূল। হে ধৃষ্টদ্যুম্ন! এই পৃথিবীতে পাঞ্চালপুত্রগণ অপেক্ষা পাপকারী আর কেহই নাই। তোমার পিতা ভীষ্মের সংহারার্থ শিখণ্ডীকে সৃষ্টি করিয়াছেন; অর্জ্জুন ভীষ্মের মৃত্যুস্বরূপ শিখণ্ডীকে রক্ষা করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু শিখণ্ডীই প্রকৃত ভীষ্মঘাতী। তুমি ও তোমার ভ্রাতা তোমরা উভয়েই সাধুগণের নিন্দনীয়; পাঞ্চালগণ তোমাদের নিমিত্ত ধর্ম্মভ্রষ্ট হইয়াছেন। এক্ষণে তুমি যদি পুনরায় আমার সন্নিধানে পূর্ব্বের ন্যায় বাক্য প্রয়োগ কর, তাহা হইলে বজ্রকল্প গদাদ্বারা তোমার মস্তক চূর্ণ করিব। তুমি ব্রাহ্মণহন্তা, মনুষ্যেরা তোমার মুখাবলোকন করিয়া আপনার প্রায়শ্চিত্তের নিমিত্ত সূৰ্য্যদর্শন করিয়া থাকে। রে দুর্বৃত্ত! এই দেখ, আমার গুরু সম্মুখে অবস্থান করিতেছেন, তুমি আমার গুরুর গুরুকে বধ করিয়া পুনরায় তিরস্কার করিয়া লজ্জিত হইতেছ না? এক্ষণে তুমি অবস্থানপূর্ব্বক আমার এক গদাঘাত সহ্য কর; আমিও তোমার গদাঘাত বারংবার সহ্য করিব।

ধৃষ্টদ্যুম্নের সাত্যকি-প্রত্যুক্তি

“হে মহারাজ! ধৃষ্টদ্যুম্ন সাত্যকিকর্ত্তৃক এইরূপ তিরস্কৃত হইয়া ক্রোধভরে হাস্যমুখে কহিতে লাগিলেন, হে যুযুধান! তুমি স্বয়ং অনাৰ্য্য ও নীচপ্রকৃতি হইয়া আমাকে নিরপরাধে তিরস্কার করিতেছ। আমি তোমার এই সকল তিরস্কারবাক্য শুনিয়াও তোমাকে ক্ষমা করিলাম। ইহলোকে ক্ষমাগুণই প্রশংসনীয়। পাপ কখন ক্ষমাগুণকে স্পর্শ করিতে পারে না। পাপাত্মারা কেবল ক্ষমাবাকে পরাজিত বোধ করিয়া থাকে। তুমি ক্ষুদ্রতম, নীচস্বভাব, পাপপরায়ণ এবং সর্ব্বতোভাবে নিন্দনীয় হইয়াও আমার নিন্দা করিতেছ। হে সাত্যকি! তুমি যে নিবারিত হইয়াও ছিন্নভুজ প্রায়োপবিষ্ট ভূরিশ্রবার প্রাণসংহার করিয়াছ, তাহা হইতে দুষ্কর্ম্ম আর কি হইতে পারে? দ্রোণাচার্য্য পূর্ব্বে দিব্যাস্ত্রব্যূহ নির্ম্মাণ করিয়া পরিশেষে শস্ত্র পরিত্যাগপূর্ব্বক আমাকর্ত্তৃক নিহত হইয়াছেন, ইহাতে আমার কি অধর্ম্ম হইবার সম্ভাবনা? যে ব্যক্তি অন্যের শরে ছিন্নবাহু, মুনির ন্যায় প্রায়োপবিষ্ট ও সমরপরাঙ্মুখ ব্যক্তির প্রাণসংহারে প্রবৃত্ত হয়, সে কি বলিয়া অন্যের নিন্দা করে? হে যুযুধান! যখন বলবিক্রমশালী সোমদত্ততনয় তোমাকে পদাঘাতে ভূতলে নিপাতিত করিয়া বিক্রম প্রকাশ করিয়াছিল, তুমি সেই সময় কেন তাঁহাকে সংহারপূর্ব্বক সৎপুরুষোচিত কার্য্যের অনুষ্ঠান করিলে না? প্রতাপশালী সোমদত্তপুত্র পার্থকর্ত্তৃক অগ্রে পরাজিত হইলে তুমি তাঁহাকে নিপাতিত করিয়াছ। দেখ, দ্রোণাচাৰ্য্য যে যে স্থানে পাণ্ডবসেনা বিদারণ করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন, আমি শরসহস্র বর্ষণপূর্ব্বক সেই সেই স্থানে গমন করিয়াছিলাম; কিন্তু তুমি অন্যনির্জিত ব্যক্তির সংহাররূপ চণ্ডালসদৃশ কর্ম্মানুষ্ঠানপূর্ব্বক স্বয়ং নিন্দনীয় হইয়া আমার প্রতি পরুষবাক্য প্রয়োগ করিতেছ। হে বৃষ্ণিকুলাধম! তুমি পাপকর্মের আবাস, আমি তোমার ন্যায় দুষ্কৰ্ম্মকারী নহি; অতএব তুমি পুনরায় আমাকে নিষেধ করিও না, মৌনাবলম্বন কর। যদি তুমি অজ্ঞানতাপ্রযুক্ত পুনরায় আমার প্রতি পরুষবাক্য প্রয়োগ কর, তবে নিশ্চয়ই তোমাকে শরনিকরদ্বারা যমালয়ে প্রেরণ করিব। রে মূর্খ! কেবল ধর্ম্মপথ অবলম্বন করিলে যুদ্ধে জয়লাভ হয় না। কৌরবগণ ও পাণ্ডবগণ যে যে অধর্ম্মাচরণ করিয়াছেন, তাহা শ্রবণ কর। কৌরবগণের অধর্ম্মপ্রভাবে রাজা যুধিষ্ঠির বঞ্চিত ও দ্রৌপদী পরিক্লিষ্ট হইয়াছিলেন। তাহারা অধর্ম্মাচরণপূর্ব্বক পাণ্ডবগণকে সর্ব্বস্বান্ত করিয়া উহাদিগকে পাঞ্চালীর সহিত অরণ্যে প্রেরণ করিয়াছে। উহারা অধর্ম্মাচরণপূর্ব্বক মদ্ররাজকে আপনাদের পক্ষে আনয়ন করিয়া বালক সৌভদ্রকে নিধন করিয়াছে। এ দিকে পাণ্ডবগণের অধর্ম্মাচরণে কুরুপিতামহ ভীষ্মদেব নিহত হইয়াছেন। তুমি ধর্ম্মতত্ত্ববেত্তা হইয়াও অধর্ম্মসহকারে ভূরিশ্রবার জীবননাশ করিয়াছ। ধর্ম্মজ্ঞ কৌরব ও পাণ্ডবগণ বিজয়াভিলাষী হইয়া এইরূপ আচরণ করিয়াছেন। হে শৈনেয়! পরমধর্ম্ম ও অধর্মের তত্ত্ব নিতান্ত দুর্জ্ঞেয়। যাহা হউক, এক্ষণে তুমি পিতৃগৃহে গমন না করিয়া কৌরবগণের সহিত যুদ্ধ কর।’

ধৃষ্টদ্যুম্ন-আক্রমণোদ্যত সাত্যকির সান্ত্বনা

“হে মহারাজ! মহাবীর সাত্যকি ধৃষ্টদ্যুম্নের মুখে এইরূপ পরুষ ও ক্রুর বাক্য শ্রবণ করিয়া কম্পিত হইতে লাগিলেন। তাঁহার নয়নদ্বয় রোষানলে তাম্রবর্ণ হইয়া উঠিল। তখন তিনি রথে শরাসন সংস্থাপনপূর্ব্বক সর্পের ন্যায় নিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া গদাহস্তে ধৃষ্টদ্যুম্নের অভিমুখে ধাবমান হইয়া কহিলেন, ‘হে দুরাত্ম। তুমি বধাহ, অতএব তোমার প্রতি পরুষবাক্য প্রয়োগ না করিয়া তোমাকে নিপাতিত করিব।’ তখন বাসুদেব সাত্যকিকে সহসা কালান্তক যমের ন্যায় ধৃষ্টদ্যুম্নের সম্মুখীন হইতে দেখিয়া তাঁহার নিবারণাৰ্থ ভীমসেনকে প্রেরণ করিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত বৃকোদর তৎক্ষণাৎ রথ হইতে অবরোহণ ও বাহুপ্রসারণপূর্ব্বক ক্রুদ্ধ সাত্যকিকে নিবারিত করিয়া তিনি ছয় পদ গমন করিবামাত্র তাঁহাকে ধারণ করিলেন। এইরূপে মহাবীর সাত্যকি ভীমকর্ত্তৃক নিবারিত হইলে মহাত্মা সহদেব অবিলম্বে রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া তাঁহাকে মধুরবাক্যে কহিলেন, ‘হে পুরুষশ্রেষ্ঠ যুযুধান! অন্ধক, বৃষ্ণি ও পাঞ্চালগণ অপেক্ষা আমাদিগের আর অন্য বন্ধু নাই এবং আমরাও অন্ধক ও বৃষ্ণিগণের, বিশেষতঃ কৃষ্ণের যেরূপ মিত্র, সেরূপ অপর কেহই নহে; অতএব তোমরা আমাদের যেরূপ মিত্র, আমরাও তোমাদের সেইরূপ সুহৃৎ। আর পাঞ্চালগণ সমুদ্র পর্য্যন্ত অন্বেষণ করিলেও পাণ্ডব ও বৃষ্ণিগণ অপেক্ষা প্রিয়সুহৃৎ কুত্রাপি প্রাপ্ত হইবেন না। সুতরাং ধৃষ্টদ্যুম্নের সহিত তোমার ও তোমার সহিত ধৃষ্টদ্যুম্নের বিশেষ সৌহার্দ্য থাকাই সঙ্গত, সন্দেহ নাই; অতএব হে সর্ব্বধর্ম্মজ্ঞ! এক্ষণে তুমি ধৃষ্টদ্যুম্নের মিত্ৰধর্ম্ম স্মরণ করিয়া কোপ সংহারপূর্ব্বক ধৃষ্টদ্যুম্নের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন কর; ধৃষ্টদ্যুম্নও তোমাকে ক্ষমা করুন; আমরাও এক্ষণে ক্ষমাবান্ হইতেছি। শান্তি অপেক্ষা হিতকর আর কিছুই নাই।’

“হে মহারাজ! সহদেব সাত্যকিকে এইরূপ সান্ত্বনা করিলে দ্রুপদকুমার হাস্য করিয়া কহিলেন, ‘হে ভীমসেন! তুমি এই যুদ্ধমদান্বিত সাত্যকিকে সত্বর পরিত্যাগ কর। সমীরণ যেমন ভূধরে মিলিত হয়, তদ্রূপ ঐ দুরাত্মা আমার সহিত মিলিত হউক। আমি অচিরাৎ নিশিতশরনিকরে ইহার ক্রোধ, যুদ্ধশ্রদ্ধা ও জীবন বিনষ্ট করিব। ঐ দেখ, কৌরবগণ পাণ্ডবগণের অভিমুখীন হইতেছে; আমি অচিরাৎ এই পাপাত্মাকে সংহারপূর্ব্বক উহাদিগকে পরাজিত করিয়া সুমহৎ কাৰ্য্য সংসাধন করিব অথবা অর্জ্জুন কৌরবগণকে নিবারণ করুন। আমি সায়কনিকরে যুযুধানের মস্তকচ্ছেদন করিব। সাত্যকি আমাকে ছিন্নবাহু ভূরিশ্রবার ন্যায় বোধ করিতেছে। অতএব আমি সংগ্রামে অন্যকে পরিত্যাগ করিয়া অগ্রে ইহাকে বিনাশ করিব। অথবা সাত্যকি আমাকে সংহার করুক।’ ভীমসেনের ভুজদ্বয়ান্তর্গত সাত্যকি পাঞ্চালপুত্রের সেই বাক্যশ্রবণে সর্পের ন্যায় নিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া কম্পিত হইতে লাগিলেন। হে মহারাজ! এইরূপে মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন ও সাত্যকি বৃষভদ্রয়ের ন্যায় গর্জ্জন করিতে আরম্ভ করিলে মহাত্মা বাসুদেব ও ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির সেই বৃদ্বয়সদৃশ বীরদ্বয়কে বহুযত্নে নিবারিত করিলেন। তৎপরে প্রধান প্রধান ক্ষত্রিয়গণও সেই ক্রোধসংরক্তনেত্র ধনুর্ধারী বীরদ্বয়কে নিবারিত করিয়া যুদ্ধার্থ অন্যান্য যোধগণের প্রতি ধাবমান হইলেন।”