১৫৩. ঘটোৎকচবধপর্ব্বাধ্যায়—উভয়পক্ষে ভীষণ যুদ্ধ

১৫৩তম অধ্যায়

ঘটোৎকচবধপর্ব্বাধ্যায়—উভয়পক্ষে ভীষণ যুদ্ধ

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! আপনার সেই প্রভূত গজসমাকীর্ণ মহাসৈন্য পাণ্ডবসেনাদিগকে অতিক্রম করিয়া চারিদিকে যুদ্ধ করিতে লাগিল। পাঞ্চাল ও কৌরবগণ যমরাজ্যগমনে কৃতসঙ্কল্প হইয়া পরস্পর যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইল। বীরগণ বীরগণের সহিত সমাগত হইয়া শর, শক্তি ও তোমরদ্বারা পরস্পরকে বিদ্ধ করিয়া যমরাজের রাজধানীতে প্রেরণ করিতে লাগিলেন। রথীগণ রথীগণের সহিত মিলিত হইয়া শরনিকরদ্বারা পরস্পরের গাত্র হইতে রুধিরধারা স্রাবিত করিতে আরম্ভ করিলেন। মদমত্ত মাতঙ্গগণ কোপাবিষ্ট হইয়া বিষাণদ্বারা [দন্ত] পরস্পরকে বিদারিত করিতে লাগিল। অশ্বারোহীরা অশ্বারোহীগণের সহিত সমাগত হইয়া যশোলাভাভিলাষে প্রাস, শক্তি ও পরশুদ্বারা পরস্পরের দেহ ভেদ করিতে আরম্ভ করিল এবং পদাতিগণ শস্ত্রপাণি হইয়া পরমযত্নসহকারে পরস্পরের প্রতি ধাবমান হইল। তখন কেবল নাম, গোত্র ও কুল শ্রবণেই কৌরবগণের সহিত পাঞ্চালদিগের বৈলক্ষণ্য বোধ হইতে লাগিল। হে মহারাজ! এইরূপে যোদ্ধৃগণ পরস্পর পরস্পরকে শর, শক্তি ও পরশুদ্বারা শমনসদনে প্রেরণ করিয়া নির্ভীকচিত্তে রণস্থলে ভ্রমণ করিতে লাগিল। দিবাকরের অস্তগমননিবন্ধন সৈন্যগণকর্ত্তৃক দশদিকে পরিত্যক্ত শরনিকর পূর্ব্বের ন্যায় উদ্ভাসিত হইল না।

দুর্য্যোধনের ভীষণ আক্রমণ—পাণ্ডবপরাজয়

“পাণ্ডবেরা এইরূপে কৌরবগণের সহিত যুদ্ধ করিতেছেন এমন সময়ে মহাবীর দুর্য্যোধন সিন্ধুরাজধজনিত দুঃখে অতিমাত্র কাতর হইয়া রথনির্ঘোষে বসুন্ধরা প্রতিধ্বনিত ও কম্পিত করিয়া জীবিতাশা পরিত্যাগপূর্ব্বক অরিবাহিনীমধ্যে প্রবেশ করিলেন। তথায় পাণ্ডবদিগের সহিত তাঁহার তুমুল সংগ্রাম সমুপস্থিত হইল। ঐ যুদ্ধে অসংখ্য সৈন্য বিনষ্ট হইয়া গেল। দিবাকর যেমন মধ্যাহ্নকালে করজালদ্বারা সমুদয় জগৎ তাপিত করেন, তদ্রূপ আপনার পুত্র শরনিকরদ্বারা পাণ্ডবসৈন্যগণকে সন্তাপিত করিতে লাগিলেন। পাণ্ডবগণ তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিতে অসমর্থ ও বিজয়লাভে ভগ্নোৎসাহ হইয়া পলায়নোন্মুখ হইলেন। পাঞ্চালগণ মহাধনুর্দ্ধর দুর্য্যোধনের সুবর্ণপুঙ্খ শাণিত শরনিকরে বিদ্ধ হইয়া ইতস্ততঃ ধাবমান হইতে লাগিলেন এবং পাণ্ডবগণের সৈনিক পুরুষেরা সুতীক্ষ্ণশরে নিপীড়িত হইয়া রণশয্যায় শয়ন করিতে আরম্ভ করিল। হে মহারাজ! আপনার পুত্র তৎকালে সমরাঙ্গনে যেরূপ কাৰ্য্য করিয়াছিলেন, পাণ্ডবেরা কখনই তদ্রূপ কাৰ্য্য করিতে, সমর্থ হয়েন নাই। দ্বিরদ যেরূপ নলিনীবন আলোড়িত করে, তদ্রূপ তিনি পাণ্ডবসৈন্যগণকে প্রমথিত করিয়া ফেলিলেন। পদ্মবন যেমন সূৰ্য্য ও অনিলপ্রভাবে সলিলবিহীন হইয়া শোভাশূন্য হয়, তদ্রূপ দুৰ্য্যোধনপ্রভাবে পাণ্ডবসৈন্যসমুদয় শোভাহীন হইল।

“ঐ সময় পাঞ্চালগণ পাণ্ডবসেনাগণকে নিহত নিরীক্ষণপূর্ব্বক ভীমসেনকে অগ্রবর্তী করিয়া আপনার পুত্র দুর্য্যোধনের প্রতি ধাবমান হইলেন। তখন মহাবীর দুৰ্য্যোধন ভীমসেনকে দশ, নকুলকে তিন, বিরাট ও দ্রুপদকে ছয়, শিখণ্ডীকে শত, ধৃষ্টদ্যুম্নকে সপ্ততি, যুধিষ্ঠিরকে সাত, সাত্যকিকে পাঁচ, দ্রৌপদীতনয়গণকে তিন তিন এবং কেকয় ও চেদিদিগকে অসংখ্য নিশিতশরে বিদ্ধ করিলেন; তৎপরে ঘটোৎকচ ও অন্যান্য অসংখ্য যোদ্ধৃগণকে বিদ্ধ করিয়া সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন এবং ক্রোধাবিষ্ট অন্তকের ন্যায় সুতীক্ষ্ণ শরনিপাতে হস্তী ও অশ্বগণের দেহ খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলেন।

যুধিষ্ঠিরাক্রান্ত দুর্য্যোধনের দ্রোণসাহায্য লাভ

“তখন পাণ্ডবজ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির দুৰ্য্যোধনকে এইরূপে অরাতিসংহারে প্রবৃত্ত দেখিয়া সুতীক্ষ্ণ ভল্লদ্বারা তাঁহার সুবর্ণপৃষ্ঠ কার্মুক ত্রিধা ছেদন করিয়া তাঁহাকে শাণিত, দশবাণে বিদ্ধ করিলেন। যুধিষ্ঠিরনিক্ষিপ্ত সেই তীক্ষ্ণ শরনিকর দুৰ্য্যোধনের দেহ ভেদ করিয়া ধরাতলে প্রবিষ্ট হইল। তখন পাণ্ডবপক্ষীয় যোদ্ধারা বৃত্রাসুর বিনাশসময়ে দেবতারা যেরূপ পুরন্দরকে পরিবেষ্টন করিয়াছিলেন, তদ্রূপ যুধিষ্ঠিরকে বেষ্টন করিলেন। তৎপরে ধর্ম্মাত্মা যুধিষ্ঠির পুনরায় শর নিক্ষেপ করিলে, মহারাজ দুৰ্য্যোধন অতিমাত্র বিদ্ধ ও অবসন্ন হইয়া রথোপরি অবস্থান করিতে লাগিলেন। তখন পাঞ্চালসৈন্যগণ ‘রাজা দুৰ্য্যোধন বিনষ্ট হইয়াছেন’ বলিয়া ঘোরতর চীৎকার করিতে লাগিল। ঐ সময় অতি ভীষণ শরশব্দও শ্রুতিগোচর হইল। দ্রোণাচার্য্য সেই শব্দশ্রবণে সত্বর তথায় গমনপূর্ব্বক অবলোকন করিলেন যে, মহাবীর দুর্য্যোধন পুনরায় হৃষ্টচিত্তে কার্মুক গ্রহণপূর্ব্বক রাজা যুধিষ্ঠিরকে ‘তিষ্ঠ তিষ্ঠ’ বলিয়া তাঁহার প্রতি ধাবমান হইলেন। হে মহারাজ! ঐ সময় পাঞ্চালগণ জয়লাভাৰ্থ দ্রোণের অভিমুখীন হইলেন; মহাবীর দ্রোণাচাৰ্য্যও কুরুপ্রবীর দুর্য্যোধনের রক্ষণেচ্ছায় তাঁহাদিগের সম্মুখীন হইলেন। হে মহারাজ! তৎপরে যুদ্ধার্থ সমবেত কৌরব ও পাণ্ডবপক্ষীয় যোদ্ধৃগণের নাশজনক ঘোরতর সংগ্রাম হইতে লাগিল।”