১৫১. হতাশ দ্রোণের দুৰ্য্যোধন-পাপপরিণামকথন

১৫১তম অধ্যায়

হতাশ দ্রোণের দুৰ্য্যোধন-পাপপরিণামকথন

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! মহাবীর অর্জ্জুন সিন্ধুরাজ ও ভূরিশ্রবাকে বিনষ্ট করিলে তোমাদের মন কি প্রকার হইল? দুৰ্য্যোধন কৌরবগণসমক্ষে দ্রোণাচাৰ্য্যকে সেইরূপ কহিলে তিনি তাহাকে কি প্রত্যুত্তর প্রদান করিলেন, তৎসমুদয় কীৰ্ত্তন কর।”

সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! মহাবীর জয়দ্রথ ও ভূরিশ্রবা নিহত হইলে আপনার সৈন্যমধ্যে মহান্ আৰ্তনাদশব্দ সমুত্থিত হইল। আপনার পুত্রের মন্ত্রণাতে শত শত প্রধান পুরুষেরা নিহত হইলেন দেখিয়া সকলেই তাঁহার পরামর্শে অবজ্ঞা প্রদর্শন করিতে লাগিল। মহাবীর দ্রোণাচাৰ্য্য আপনার পুত্রের সেই বাক্য শ্রবণে নিতান্ত বিমনায়মান হইয়া মুহূর্ত্তকাল চিন্তা করিয়া অতি দীনভাবে কহিলেন, ‘দুৰ্য্যোধন! কেন বৃথা আমাকে বাক্যবাণে বিদ্ধ করিতেছ? আমি ত তোমাকে সততই বলিয়া থাকি যে, অর্জ্জুন অজেয়; শিখণ্ডী অর্জ্জুন-সংরক্ষিত হইয়া, মহাবীর ভীষ্মকে নিপাতিত করাতেই ধনঞ্জয়ের অসাধারণ বলবীৰ্য্য অবগত হওয়া গিয়াছে। আমি দানবগণেরও অবধ্য মহাবীর ভীষ্মকে নিহত নিরীক্ষণ করিয়া কৌরবসৈন্যগণের সমূলে উন্মুলন স্থির করিয়াছি। আমরা ত্রিলোকমধ্যে যাঁহাকে সর্ব্বাপেক্ষা মহাবীর বলিয়া বোধ করিতাম, সেই ভীষ্মই সমরশায়ী হইয়াছেন, এক্ষণে আমার আর কি উপায় আছে? হে বৎস! শকুনি কৌরবসভায় যে অক্ষ নিক্ষেপ করিয়াছিল, উহা অক্ষ নহে; শত্রুবিনাশন সুতীক্ষ্ণ শর। ঐ সকল শর এক্ষণে অর্জ্জুনকর্ত্তৃক নিক্ষিপ্ত হইয়া আমাদিগের যোদ্ধৃগণকে সংহার করিতেছে। হে দুৰ্য্যোধন! ধীরপ্রকৃতি মহাত্মা বিদুর তোমার হিতসাধনার্থ তোমাকে বিবিধ উপদেশ প্রদান এবং তোমার সমক্ষে বারংবার বিলাপ ও পরিতাপ করিয়াছিলেন, কিন্তু তুমি অনাদর প্রদর্শনপূর্ব্বক তাঁহার বাক্যে কর্ণপাতও কর নাই; তন্নিবন্ধনই এক্ষণে এই ঘোরতর বিনাশব্যাপার সমুপস্থিত হইয়াছে। যে মূঢ় হিতকারী সুহৃদের বাক্যে অনাস্থা প্রদর্শনপূর্ব্বক আপনার মতানুসারে কার্য্যানুষ্ঠান করিয়া থাকে, সে অবিলম্বে শোচনীয় হয়। হে মহারাজ! তুমি যে সকুলসম্ভূত, ধর্ম্মপরায়ণ, অসৎকারের নিতান্ত অনুপযুক্ত দ্রৌপদীকে আমাদিগের সমক্ষে সভামণ্ডপে আনয়ন করাইয়াছিলে, এক্ষণে সেই অধর্মের ফলভোগ করিতেছ এবং পরলোকে ইহা অপেক্ষাও অধিকতর ফলভোগ করিবে।

‘তুমি কপটতাচরণপূর্ব্বক যে পাণ্ডবগণকে দ্যূতক্রীড়ায় পরাজিত করিয়া রৌরবচর্ম্ম পরিধান করাইয়া অরণ্যে প্রব্রাজিত করিয়াছিলে, এক্ষণে আমা ভিন্ন অন্য কোন্ ব্রহ্মবাদী মনুষ্য সেই ধর্ম্মপরায়ণ আত্মজতুল্য পাণ্ডবগণের অনিষ্টাচরণ করিবে? তুমি শকুনির সাহায্যে ও মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের সম্মতিক্রমে পাণ্ডবগণের কোপ সংগ্রহ করিয়াছ, দুঃশাসন ও কর্ণ ঐ ক্রোধানল সন্ধুক্ষিত করিয়াছেন এবং তুমি বিদুরের বাক্যে অনাদর প্রদর্শনপূর্ব্বক বারংবার উহা উত্তেজিত করিয়াছ। দেখ, তোমরা সকলে পরাভূত হইয়াও জয়দ্রথের রক্ষাৰ্থ যত্নসহকারে অর্জ্জুনকে নিবারণ করিতে গিয়াছিলে; তবে সিন্ধুরাজ তোমাদিগের মধ্যে কেন বিনষ্ট হইলেন? মহাবীর কর্ণ, কৃপ, শল্য, অশ্বত্থামা ও তুমি—তোমরা সকলে জীবিত থাকিতে জয়দ্রথ কেন কালসদনে আতিথ্য গ্রহণ করিলেন? ভূপালগণ জয়দ্রথকে পরিত্রাণ করিবার নিমিত্ত প্রখর তেজ ধারণ করিয়াছিলেন, তবে তিনি কেন সংগ্রামে নিপাতিত হইলেন? হে দুৰ্য্যোধন! সিন্ধুরাজ তোমার, বিশেষতঃ আমার পরাক্রমপ্রভাবে ধনঞ্জয় হইতে আত্মরক্ষা করিবার বাসনা করিয়াছিলেন; কিন্তু তিনি তদ্বিষয়ে কৃতকার্য্য হয়েন নাই। এক্ষণে আমি কোন্ স্থানে গমন করিলে জীবিত থাকিব, কিছুই বুঝিতে পারি না। আমি যে পৰ্য্যন্ত না ধনঞ্জয়কে পাঞ্চালগণের সহিত সংহার করিতেছি, তদবধি বোধ হইতেছে যেন, মহাত্মা ধৃষ্টদ্যুম্নের হস্তে আমার পরিত্রাণ নাই। হে রাজন! সিন্ধুরাজরক্ষায় অকৃতকাৰ্য্য হইয়া আমাকে বিলাপ ও পরিতাপ করিতে দেখিয়াও কি নিমিত্ত বাক্যবাণে বিদ্ধ করিতেছ? আর সেই সত্যসন্ধ মহাবীর ভীষ্মের সুবর্ণময় ধ্বজদণ্ড নিরীক্ষণ না করিয়া কিরূপে তোমার মনে জয়লাভের প্রত্যাশা হইতেছে? যে যুদ্ধে সৈন্ধব ও ভূরিশ্রবা মহারথগণের মধ্যবর্তী হইয়াও নিহত হইয়াছেন, তথায় তুমি আর কি বিবেচনা কর? কৃপাচার্য্য এখনও সিন্ধুরাজের পথে পদার্পণ করেন নাই, এই নিমিত্ত আমি তাঁহাকে যথোচিত সৎকার করি। হে দুর্য্যোধন! দেবগণসমবেত দেবরাজও যাঁহাকে বিনাশ করিতে সমর্থ নহেন, সেই দুষ্করকর্ম্মকারী মহাবীর ভীষ্মকে যখন তোমার ও দুঃশাসনের সমক্ষে নিপতিত হইতে অবলোকন করিলাম, তখন স্পষ্টই বোধ হইতেছে যে, বসুন্ধরা তোমাকে পরিত্যাগ করিলেন।

দ্রোণাচার্য্যের পুনরায় যুদ্ধযাত্রা

‘হে দুৰ্য্যোধন! এক্ষণে পাণ্ডব ও সৃঞ্জয়দিগের সৈন্যসমুদয় আমার সম্মুখে আগমন করিতেছে। আমি তোমার হিতানুষ্ঠানার্থ সমস্ত সৃঞ্জয়গণকে বিনাশ না করিয়া কখনই কবচ মোক্ষণ করিব না। হে রাজন! তুমি আমার পুত্র অশ্বত্থামার নিকট গমনপূর্ব্বক তাহাকে বল যে, তুমি জীবনরক্ষাৰ্থ সোমকদিগকে পরিত্যাগ করিও না। আর তোমায় পিতা যে যে বিষয়ে আদেশ প্রদান করিয়াছেন, এক্ষণে তৎসমুদয় প্রতিপালনপূর্ব্বক আনৃশংস্য, দম, সত্য ও সরলতায় মন সমাহিত কর, ধর্ম্মার্থকামে নিরত থাকিয়া ধর্ম্ম ও অর্থের পীড়ন না করিয়া সতত ধর্ম্মপ্রধান কার্য্যের অনুষ্ঠানে তৎপর হও। মন ও নেত্ৰদ্বারা ব্রাহ্মণগণকে সন্তুষ্ট ও সাধ্যানুসারে তাঁহাদের পূজা কর। তাঁহারা অগ্নিশিখাসদৃশ; অতএব কদাচ তাঁহাদিগের অপ্রিয় কার্য্যের অনুষ্ঠান বিধেয় নহে। হে মহারাজ! তুমি অশ্বত্থামাকে আমার এই সকল উপদেশবাক্য কহিবে। এক্ষণে আমি তোমার বাক্যশল্যে পীড়িত হইয়া সৈন্যমধ্যে সংগ্রাম করিতে চলিলাম। যদি তুমি সমর্থ হও, তবে সৈন্যসমুদয়কে রক্ষা কর। পাণ্ডব ও সৃঞ্জয়গণ অতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়াছে, তাহারা রজনীযোগেও যুদ্ধে নিবৃত্ত হইবে না।’ হে মহারাজ! দ্রোণাচার্য্য দুৰ্য্যোধনকে এইরূপ কহিয়া- পাণ্ডব ও সৃঞ্জয়দিগের প্রতি ধাবমান হইয়া, দিবাকর যেমন নক্ষত্রগণের তেজ নাশ করেন, তদ্রূপ ক্ষত্রিয়তেজ বিনাশ করিতে লাগিলেন।”