১৭৩. দ্রোণ-কর্ণশরে নিপীড়িত পাণ্ডবসৈন্যপলায়ন

১৭৩তম অধ্যায়

দ্রোণ-কর্ণশরে নিপীড়িত পাণ্ডবসৈন্যপলায়ন

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! অনন্তর বাক্যপ্রয়োগসুনিপুণ আপনার আত্মজ রাজা দুর্য্যোধন স্বীয় সৈন্যগণমধ্যে কতকগুলিকে পাণ্ডবগণের শরে নিহত ও কতকগুলিকে পলায়মান দেখিয়া অবিলম্বে কর্ণ ও দ্রোণের সন্নিধানে গমনপূর্ব্বক ক্রোধভরে কহিতে লাগিলেন, ‘হে বীরদ্বয়! আপনারা অর্জ্জুনশরে জয়দ্রথকে নিহত নিরীক্ষণপূর্ব্বক ক্রোধাবিষ্ট হইয়া সমরানল প্রজ্বলিত করিয়াছেন; কিন্তু এক্ষণে পাণ্ডবসৈন্যগণকর্ত্তৃক আমার সৈন্যসমুদয় বিনষ্ট হইতেছে দেখিয়া অরাতিবিনাশে সমর্থ হইয়াও একান্ত অশক্তের ন্যায় উপেক্ষা প্রদর্শন করিতেছেন। যদি আমাকে পরিত্যাগ করাই আপনাদের অভিপ্রেত ছিল, তবে তৎকালে কি নিমিত্ত আপনারা পাণ্ডবগণকে সমরে পরাজিত করিবেন বলিয়া অঙ্গীকার করিয়াছিলেন? আপনারা পাণ্ডবগণকে পরাজিত করিতে স্বীকার না করিলে আমি কদাচ তাহাদের সহিত এই লোকক্ষয়কর যুদ্ধ আরম্ভ করিতাম না। যাহা হউক, যদি এক্ষণে আমাকে পরিত্যাগ করা আপনাদিগের অভিপ্রেত না হয়, তাহা হইলে আপনারা অনুরূপ বিক্ৰম প্ৰকাশপূর্ব্বক সংগ্রামে প্রবৃত্ত হউন।’

“হে মহারাজ। মহাবীর দ্রোণ ও কর্ণ মহারাজ দুৰ্য্যোধনের বাক্যশ্রবণে দণ্ডঘট্টিত [ষষ্ঠিদ্বারা তাড়িত] ভুজঙ্গের ন্যায় ক্রুদ্ধ হইয়া ঘোরতর যুদ্ধ করিবার মানসে সিংহনাদ পরিত্যাগপূর্ব্বক পাণ্ডবপক্ষীয় সাত্যকিপ্রমুখ বীরগণের প্রতি ধাবমান হইলেন। তখন পাণ্ডবেরাও স্বীয় সৈন্যগণসমভিব্যাহারে সেই মহাবীরদ্বয়ের প্রতি আগমন করিতে লাগিলেন। অনন্তর শাস্ত্রবিদগণের অগ্রগণ্য মহাবীর দ্রোণ রোষপরবশ হইয়া সত্বর সাত্যকিকে দশবাণে বিদ্ধ করিলেন। তখন মহাবীর কর্ণ দশ, রাজা দুর্য্যোধন সাত, বৃষসেন দশ ও শকুনি সাতশরে সাত্যকিকে বিদ্ধ করিলেন। ঐ সময় সোমকগণ দ্রোণাচাৰ্য্যকে পাণ্ডবসৈন্যসংহারে প্রবৃত্ত দেখিয়া অবিলম্বে তাঁহার উপর শরনিকর বর্ষণ করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর দ্রোণ ক্রুদ্ধ হইয়া দিবাকর যেমন স্বীয় করজাল বিস্তারপূর্ব্বক অন্ধকার বিনষ্ট করিয়া থাকেন, তদ্রূপ শরজাল প্রয়োগপূর্ব্বক ক্ষত্রিয়গণের প্রাণসংহার করিতে আরম্ভ করিলেন। পাঞ্চালগণ দ্রোণশরে নিহন্যমান হইয়া তুমুল আর্ত্তনাদ করিতে লাগিলেন এবং কেহ কেহ পুত্র, কেহ কেহ পিতা, কেহ কেহ ভ্রাতা, কেহ কেহ মাতুল, কেহ কেহ ভাগিনেয়, কেহ কেহ বয়স্য এবং কেহ কেহ বা সম্বন্ধী ও বান্ধবগণকে পরিত্যাগপূর্ব্বক প্রাণরক্ষাৰ্থ সত্বর পলায়ন করিতে আরম্ভ করিলেন। কেহ কেহ মোহাবিষ্ট হইয়া দ্রোণ অভিমুখেই উপস্থিত হইলেন। ঐ যুদ্ধে পাণ্ডবপক্ষীয় অসংখ্য সৈন্য শমনসদনে গমন করিল। হতাবশিষ্ট সেনাগণ দ্রোণশরে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া প্রদীপ পরিত্যাগপূর্ব্বক পাণ্ডবগণ, কৃষ্ণ ও ধৃষ্টদ্যুম্নের সমক্ষেই পলায়নপর হইল। তৎকালে পাণ্ডবসৈন্যগণ প্রদীপ পরিত্যাগ করিলে দিঙ্মণ্ডল গাঢ়তর অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন হওয়াতে কেহ কিছু বিদিত হইতে সমর্থ হইল না। কেবল কৌরবগণের দীপালোকপ্রভাবে পাণ্ডবপক্ষীয় যোদ্ধাদিগের পলায়ন নয়নগোচর হইতে লাগিল। তখন মহাবীর দ্রোণ ও কর্ণ পাণ্ডবসৈন্যগণকে পলায়মান দেখিয়া শরনিকর বর্ষণপূর্ব্বক তাহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইলেন।

“হে মহারাজ! এইরূপে পাঞ্চালগণ বিনষ্ট ও পলায়িত হইলে মহাত্মা জনার্দ্দন নিতান্ত দীনমনাঃ হইয়া ধনঞ্জয়কে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে অর্জ্জুন! মহাবীর সাত্যকি ও ধৃষ্টদ্যুম্ন পাঞ্চালসৈন্যগণসমভিব্যাহারে দ্রোণ ও কর্ণের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়াছেন! এক্ষণে আমাদিগের সৈন্যগণ দ্রোণের শরনিকরে ছিন্নভিন্ন হইয়া পলায়ন করিতেছে; কিছুতেই নিবৃত্ত হইতেছে না। অতএব আইস, আমরা উহাদিগকে নিবারণ করিবার চেষ্টা করি।’ তখন কৃষ্ণ ও অর্জ্জুন পলায়মান সৈন্যদিগকে সম্বোধন করিয়া কহিতে লাগিলেন, ‘হে বীরগণ! তোমরা ভীত হইয়া পলায়ন করিও না; ভয় পরিত্যাগ কর। এই আমরা সৈন্যসংগ্রহপূর্ব্বক ব্যূহ প্রস্তুত করিয়া দ্রোণ ও কর্ণের প্রতি ধাবমান হইতেছি।

“হে মহারাজ! ঐ সময় কেশব বৃকোদরকে আগমন করিতে দেখিয়া ধনঞ্জয়ের হর্ষোৎপাদন করিবার মানসে কহিতে লাগিলেন,—‘হে সখে! ঐ দেখ, সমরশ্নাঘী মহাবীর ভীমসেন সোমক ও পাণ্ডবগণসমভিব্যাহারে দ্রোণ ও কর্ণের সহিত যুদ্ধার্থে আগমন করিতেছেন। অতএব আজ তুমি পাঞ্চালদেশীয় মহারথগণ ও ভীমের সহিত সমবেত হইয়া বিপক্ষপক্ষীয় সৈন্যগণকে সংহার কর।’ মহাবীর ধনঞ্জয় বাসুদেবের বাক্য শ্রবণানন্তর তাহার সহিত দ্রোণ-কর্ণসমক্ষে সমুপস্থিত হইলেন। তখন পাণ্ডবসৈন্যগণ পুনরায় প্রতিনিবৃত্ত হইয়া অরাতিনিপাতনে প্রবৃত্ত দ্রোণ ও কর্ণের নিকট আগমন করিল। অনন্তর সেই চন্দ্রোদয়ে প্রবৃদ্ধ সাগরদ্বয়ের ন্যায় সমুত্তেজিত উভয়পক্ষের ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হইল। কৌরবসৈন্যগণ প্রদীপসকল পরিত্যাগপূর্ব্বক উন্মত্তের ন্যায় পাণ্ডবদিগের সহিত যুদ্ধ আরম্ভ করিল। ঐ সময় ধূলিপটল ও অন্ধকারপ্রভাবে রণস্থল সমাচ্ছন্ন হওয়াতে যোদ্ধারা স্ব স্ব নামোল্লেখপূর্ব্বক যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। তখন স্বয়ংবরসভার ন্যায় সেই সমরাঙ্গনে ঘোরতর যুদ্ধে প্রবৃত্ত মহীপালগণের নাম শ্রবণগোচর হইল। ঐ সময় রণস্থল মুহূর্ত্তকাল নিঃশব্দ হইয়া রহিল। অনন্তর পুনরায় জয়শীল ও পরাজিত ব্যক্তিরা ক্রোধভরে তুমুল কোলাহল করিতে লাগিলেন। হে মহারাজ! তখন যে যে স্থানে প্রদীপসকল পরিদৃশ্যমান হইল, বীরগণ পতঙ্গের ন্যায় সেই সেই স্থানে গমন করিতে আরম্ভ করিলেন। এইরূপে সেই কৌরব ও পাণ্ডবগণ ঘোরতর যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলে বিভাবরী অতি প্রগাঢ় হইয়া উঠিল।”