১৫৭. সাত্যকিকর্ত্তৃক সোমদত্তপরাজয়

১৫৭তম অধ্যায়

সাত্যকিকর্ত্তৃক সোমদত্তপরাজয়

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! অনন্তর ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির, ভীমসেন, ধৃষ্টদ্যুম্ন ও যুযুধান ইহারা দ্রুপদতনয়গণ, কুন্তিভোজের পুত্রগণ এবং সহস্র সহস্র রাক্ষসগণকে অশ্বত্থামার শরনিকরে নিহত নিরীক্ষণ করিয়া পরমযত্নসহকারে যুদ্ধে মননানিবেশ করিলেন। তখন উভয়পক্ষে অতি অদ্ভুত ঘঘারতর যুদ্ধ আরম্ভ হইল। সোমদত্ত সাত্যকিকে পুনরায় অবলোকনপূর্ব্বক ক্রোধাবিষ্ট হইয়া তাঁহাকে শরনিকরে সমাচ্ছন্ন করিতে লাগিলেন। মহাবীর ভীমসেন সাত্যকির সাহায্যার্থ দশশরে সোমদত্তকে বিদ্ধ করিলে সোমদত্তও তাঁহাকে শতশরে বিদ্ধ করিলেন। তখন মহাবলপরাক্রান্ত সাত্যকি একান্ত ক্রোধাবিষ্ট হইয়া পুত্ৰবিনাশে নিতান্ত সন্তপ্ত, স্থবিরোচিত গুণগ্রামে, সমলস্কৃত যযাতিরাজসদৃশ বৃদ্ধ সোমদত্তকে প্রথমতঃ বজ্রসঙ্কাশ সুতীক্ষ্ণ দশশর ও ভীষণ শক্তিদ্বারা বিদ্ধ করিয়া পুনৰ্ব্বার তাহার উপর সাতশর প্রয়োগ করিলেন। তখন মহাবীর ভীম সাত্যকির সাহায্যার্থে সোমদত্তের মস্তকে এক সুদৃঢ় ভয়ঙ্কর পরিঘ নিক্ষেপ করিলেন; সাত্যকিও সেই সময় ক্রোধাবিষ্ট হইয়া সোমদত্তের বক্ষঃস্থলে অনলসঙ্কাশ শাণিত শর পরিত্যাগ করিলেন। সেই ভীষণ পরিঘ ও শর এককালে সোমদত্তের কলেবরে নিপতিত হইলে তিনি মূর্চ্ছিত হইয়া ভূতলে পতিত হইলেন।

ভীমকর্ত্তৃক বাহ্লীকবধ

“মহাবীর বাহ্লীক স্বীয় পুত্রের তদবস্থা দর্শনে বর্ষাকালীন নীরবর্ষী নীরদের ন্যায় অনবরত শরবর্ষণপূর্ব্বক সাত্যকির প্রতি ধাবমান হইলেন। তখন মহাবীর ভীম সাত্যকির সাহায্যার্থ নয়শরে বাহ্লীককে বিদ্ধ করিলেন। মহাবীর প্রতীপতনয় বাহ্লীক তদ্দর্শনে ক্রোধাবিষ্ট হইয়া পুরন্দরবিনির্মুক্ত অশনির ন্যায় ভীমের বক্ষঃস্থলে এক শক্তি প্রহার করিলেন। মহাবাহু ভীমসেন সেই শক্তিদ্বারা আহত হইয়া একান্ত বিচলিত ও বিমোহিত হইলেন এবং অবিলম্বে পুনরায় সংজ্ঞালাভ করিয়া বাহ্লীকের প্রতি এক গদা নিক্ষেপ করিলেন। সেই ভীমসেনপ্রেরিত ভীষণ গদা বাহ্লীকের মস্তক চূর্ণ করিয়া ফেলিল। তখন তিনি তৎক্ষণাৎ বজ্রাহত পাদপের ন্যায় ভূতলে নিপতিত হইলেন।

ভীমকরে নাগদত্তাদি ধৃতরাষ্ট্রতনয়বধ

“অনন্তর আপনার আত্মজ নাগদত্ত, দৃঢ়রথ, বীরবাহু, অয়োভুজ, দৃঢ়, সুহস্ত, বিজয়, প্রমাথ ও উগ্রযায়ী, দশরথীসদৃশ এই নয় মহাবীর বাহ্লীককে নিহত নিরীক্ষণ করিয়া ভীমসেনকে নিপীড়িত করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। মহাবীর ভীম তাঁহাদিগকে লক্ষ্য করিয়া কার্য্যসাধনক্ষম নারাচসকল সন্ধানপূর্ব্বক প্রত্যেকের মর্ম্মদেশ বিদ্ধ করিলেন। তাঁহারা ভীমের নারাচে বিদ্ধ হইয়া, মহীরুহগণ যেমন প্রচণ্ড বায়ু সহকারে ভগ্ন হইয়া পর্ব্বতশিখর হইতে নিপতিত হয়, তদ্রূপ গতাসু হইয়া ভূতলে নিপতিত হইলেন। এইরূপে ভীম নয়নারাচে সেই নয় বীরের প্রাণসংহার করিয়া কর্ণের প্রিয়পুত্র বৃষসেনের প্রতি শরজাল বিস্তার করিতে লাগিলেন। তখন কর্ণের ভ্রাতা বৃকরথ তাঁহাকে নারাচনিকরে বিদ্ধ করিতে আরম্ভ করিলেন। মহাবীর ভীম তৎক্ষণাৎ তাঁহাকে শমনসদনে প্রেরণপূর্ব্বক আপনার সাতজন শ্যালককে বিনাশ করিয়া নারাচদ্বারা শতচন্দ্রকে সংহার করিলেন। তখন বীরগবাক্ষ, শরভ ও বিভু শকুনির ভ্রাতা শতচন্দ্রকে নিহত নিরীক্ষণ করিয়া একান্ত ক্রোধাবিষ্টচিত্তে ভীমসেনের প্রতি দ্রুতবেগে গমনপূর্ব্বক তাঁহার উপর সুতীক্ষ্ণ নারাচনিকর প্রহার করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর ভীমসেন সেই জলধারাসদৃশ নারাচনিকরে তাড়িত হইয়া পাঁচশরে অলৌকিকবলশালী পাঁচ মহীপালকে বিনাশ করিলেন। অন্যান্য নৃপতিগণ তাঁহাদিগকে বিনষ্ট দেখিয়া সাতিশয় বিচলিত হইলেন।

যুধিষ্ঠিরশরে অজয়াদি বীরগণের বিনাশ

“হে মহারাজ! ঐ সময় রাজা যুধিষ্ঠির ক্রুদ্ধ হইয়া দ্রোণাচাৰ্য্য ও আপনার পুত্রগণের সমক্ষেই আপনার পক্ষীয় অম্বষ্ঠ, মালব, ব্রিগর্ত্ত, শিবি, অভীষাহ, শূরসেন, বাহ্লীক, বসাতি, যৌধেয়, মালব ও মদ্রগণকে অসংখ্যশরে শমনসদনে প্রেরণ করিলেন। তাহাদের মাংস ও শোণিতে পৃথিবী কর্দ্দমাক্ত হইল। ঐ সময় যুধিষ্ঠিরের রথসমীপে ‘বধ কর, আহরণ কর, গ্রহণ কর, বিদ্ধ কর’ ইত্যাকার তুমুল শব্দ হইতে লাগিল। তখন দুৰ্য্যোধনপ্রেরিত মহাত্মা দ্রোণাচাৰ্য্য যুধিষ্ঠিরকে কৌরবসৈন্য বিভ্রাবণ করিতে দেখিয়া তাঁহাকে শরনিকরে সমাচ্ছন্ন করিয়া তাঁহার উপর বায়ব্যাস্ত্র নিক্ষেপ করিলেন। ধর্ম্মনন্দন স্বীয় অস্ত্রদ্বারা আচার্য্যের অস্ত্ৰচ্ছেদন করিয়া ফেলিলেন। এইরূপে অস্ত্র বিনষ্ট হইলে ভারদ্বাজ রোষপরবশ হইয়া যুধিষ্ঠিরের বিনাশার্থ বারুণ, যাম্য, আগ্নেয়, ত্বাষ্ট্র ও সাবিত্র-অস্ত্র প্রয়োগ করিলেন। মহাবাহু যুধিষ্ঠির অকুতোভয়ে স্বীয় অস্ত্রদ্বারা সেই দ্রোণনিক্ষিপ্ত অস্ত্রসমূহ নিরাকৃত করিতে লাগিলেন। তখন দুৰ্য্যোধনহিতৈষী দ্রোণাচার্য্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইয়া ধর্ম্মরাজের বিনাশবাসনায় ঐন্দ্র ও প্রাজাপত্য অস্ত্র আবিষ্কৃত করিলেন। গজসিংহগামী, বিশালবক্ষাঃ, পৃথুললাহিতাক্ষ, অমিততেজাঃ ধর্ম্মরাজও মহেন্দ্র-অস্ত্র আবিষ্কৃত করিয়া দ্রোণাস্ত্র ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তখন দ্রোণাচার্য্য যৎপরোনাস্তি কোপাবিষ্ট হইয়া যুধিষ্ঠিরের বধকামনায় ব্রহ্মাস্ত্র উদ্যত করিলেন। ঐ সময় রণক্ষেত্র তিমিরাবৃত হওয়াতে আমরা কিছুই জানিতে পারিলাম না। যোদ্ধৃগণ সেই ব্রাহ্ম-অস্ত্র দর্শনে অতিশয় শঙ্কিত হইল। তখন কুন্তীপুত্র যুধিষ্ঠির স্বীয় ব্রাহ্ম-অস্ত্রদ্বারা সেই আচার্য্যনিক্ষিপ্ত ব্রাহ্ম-অস্ত্র নিবারণ করিলেন। তদ্দর্শনে আপনার প্রধান প্রধান সৈনিকগণ ধনুর্দ্ধর যুদ্ধবিশারদ দ্রোণাচাৰ্য্য ও যুধিষ্ঠিরের বারংবার প্রশংসা করিতে লাগিলেন।

“অনন্তর দ্রোণাচাৰ্য্য যুধিষ্ঠিরকে পরিত্যাগ করিয়া। সরোষনয়নে বায়ব্যাস্তুদ্বারা দ্রুপদসেনাগণকে তাড়িত করিতে আরম্ভ করিলেন। পাঞ্চালগণ দ্রোণশরে নিপীড়িত হইয়া মহাত্মা অর্জ্জুন ও ভীমসেনের সমক্ষেই ভয়ে পলায়ন করিতে লাগিল। তখন অর্জ্জুন ও ভীমসেন সহসা প্রতিনিবৃত্ত হইয়া অসংখ্য রথদ্বারা অরিসৈন্যগণের অভিমুখীন হইলেন এবং অর্জ্জুন দক্ষিণপার্শ্বস্থ ও ভীমসেন উত্তরপার্শ্বস্থ সেনা আক্রমণপূর্ব্বক শরবর্ষণদ্বারা আচাৰ্য্যকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিলেন। ঐ সময় মহাতেজাঃ মৎস্য, সৃঞ্জয় ও পাঞ্চালগণ সাত্বতদিগের সহিত অর্জ্জুন ও ভীমসেনের অনুগমন করিল। হে মহারাজ! এইরূপে সেই অন্ধকারাবৃত, নিদ্রাক্রান্ত কৌরবসেনাগণ মহাবীর ধনঞ্জয়কর্ত্তৃক বিদীর্ণ হইতে লাগিল। মহাবীর দ্রোণ ও আপনার পুত্র দুর্য্যোধন কোনক্রমেই নিবারণ করিতে সমর্থ হইলেন না।”