১৬৬. সাত্যকিসমরে ভূরির নিধন

১৬৬তম অধ্যায়

সাত্যকিসমরে ভূরির নিধন

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! এদিকে মহাবীর ভূরি সমাগত মত্তমাতঙ্গবিক্রম মহারথ সাত্যকিকে নিবারণ করিলেন। মহাবীর সাত্যকি তদ্দর্শনে ক্রোধাবিষ্ট হইয়া শাণিত পাঁচশরে তাঁহাকে বিদ্ধ করিলে তাঁহার দেহে শোণিতধারা প্রবাহিত হইতে লাগিল। তখন কুরুকুলোদ্ভব ভূরিও যুদ্ধদুর্ম্মদ সাত্যকির বক্ষঃস্থলে দশশর নিক্ষেপ করিলেন। এইরূপে সেই ক্ৰোধান্ধ অন্তকসদৃশ মহাবীরদ্বয় রোষরক্তনয়নে শরাসন বিস্ফারণপূর্ব্বক পরস্পরকে ক্ষতবিক্ষত এবং সুদারুণ শরবৃষ্টিদ্বারা পরস্পরকে সমাচ্ছন্ন করিয়া সমরাঙ্গনে অবস্থান করিতে লাগিলেন। এইরূপে ক্ষণকাল তাঁহাদের সমানরূপ যুদ্ধ হইল। অনন্তর মহাবীর সাত্যকি হাসিতে হাসিতে মহাত্মা ভূরির কোদণ্ড দ্বিখণ্ড করিয়া ফেলিলেন এবং তাঁহার বক্ষঃস্থলে নিশিত নয়বাণ নিক্ষেপপূর্ব্বক তাঁহাকে ‘থাক্ থাক’ বলিয়া আস্ফালন করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর ভূরি শত্রুশরে ছিন্নশরাসন ও অতিমাত্র বিদ্ধ হইয়া ক্রোধভরে অন্য কার্মুক গ্রহণপূর্ব্বক সাত্যকিকে তিনবাণে বিদ্ধ করিয়া হাসিতে হাসিতে সূতীক্ষ্ণভল্লে তাঁহার কার্মুক ছেদন করিয়া ফেলিলেন। মহাবীর সাত্যকি শত্রুশরে শরাসন ছিন্ন হওয়াতে ক্রোধে অন্ধ হইয়া মহাবেগে ভূরির বিপুল বক্ষঃস্থলে শক্তি নিক্ষেপ করিলেন। মহাবীর ভূরি সেই সাত্যকিনিক্ষিপ্ত শক্তির আঘাতে চূর্ণ কলেবর হইয়া আকাশভ্রষ্ট, দীপ্তরশ্মি মঙ্গলগ্রহের ন্যায় রথ হইতে ধরাতলে নিপতিত হইলেন।

অশ্বত্থামার শরে ঘটোৎকচপরাজয়

“হে মহারাজ! মহারথ অশ্বত্থামা দ্রুতবেগে যুযুধানের অভিমুখে ধাবমান হইলেন এবং তাঁহাকে ‘থাক থাক’ বলিয়া তর্জ্জন করিয়া জলধর যেরূপ পর্ব্বতোপরি বারিবর্ষণ করে, তদ্রূপ তাঁহার উপর শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন। ঐ সময় মহাবীর ঘটোৎকচ অশ্বত্থামাকে সাত্যকির রথাভিমুখে মহাবেগে আগমন করিতে দেখিয়া সিংহনাদপরিত্যাগপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে দ্রোণনন্দন। তুমি ঐ স্থানে অবস্থান কর, প্রাণসত্ত্বে আমার নিকট হইতে অন্যত্র গমন করিতে সমর্থ হইবে না। কার্ত্তিকেয় যেমন মহিষাসুরকে সংহার করিয়াছিলেন, তদ্রূপ আজ আমি তোমাকে বিনাশ করিব। হে ব্ৰহ্মন্! আমি অদ্যই তোমার যুদ্ধশ্রদ্ধা অপনীত করিব, সন্দেহ নাই।’ রোষতাম্ৰাক্ষ অরাতিঘাতন ঘটোৎকচ অশ্বত্থামাকে এই কথা বলিয়া ক্রোধাবিষ্ট কেশরী যেমন করীন্দ্রকে আক্রমণ করিতে গমন করে, তদ্রূপ দ্রোণপুত্রের অভিমুখে ধাবমান। হইলেন এবং জলধর যেমন ধরাতলে জলধারা বর্ষণ করে, তদ্রূপ তাঁহার উপর রথাক্ষপরিমিত ইষুজাল বর্ষণ করিতে লাগিলেন। দ্রোণপুত্র আশীবিষোপম শরনিকরদ্বারা সেই রাক্ষসনির্মুক্ত শরবৃষ্টি নিরাকৃত করিয়া তাঁহার উপর একশত মর্ম্মভেদী সুতীক্ষ্ণ শর পরিত্যাগ করিলেন। ঘটোৎকচ আচাৰ্য্যপুত্রের শরনিকরে সমাচ্ছন্ন হইয়া সমরমধ্যে সলোম শল্লকীর ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন এবং ক্রোধাবিষ্টচিত্তে অশনিসম শব্দায়মান ভীষণ ক্ষুর, অর্দ্ধচন্দ্র, নারাচ, বরাহকৰ্ণ, নালীক ও বিকর্ণ প্রভৃতি শরসমূহে অশ্বত্থামাকে সমাচ্ছন্ন করিলেন। তখন মহাবীর অশ্বত্থামা অনাকুলিতচিত্তে দিব্যমন্ত্রপূত ভীষণ শরনিকর পরিত্যাগপূর্ব্বক সমীরণ যেমন জলধরপটল ছিন্নভিন্ন করে, তদ্রূপ সেই রাক্ষসনির্মুক্ত অশনিসন্নিভ সুদুঃসহ শরজাল নিরাকৃত করিতে লাগিলেন। তখন বোধ হইল যেন, আকাশপথে শরসমুদয় পরস্পর ঘোরতর সংগ্রাম করিতেছে। সেই বীরদ্বয়নির্মুক্ত শরসমুদয়ের পরস্পর সংঘর্ষণে অসংখ্য স্ফুলিঙ্গ সমুত্থিত হওয়াতে বোধ হইতে লাগিল যেন, নভোমণ্ডল সন্ধ্যাসময়ে খদ্যোতপুঞ্জে বিচিত্রিত হইয়াছে। হে মহারাজ! এইরূপে দ্রোণপুত্র শরজালদ্বারা দশদিক্‌ সমাচ্ছন্ন করিয়া আপনার পুত্রগণের হিতার্থ ঘটোৎকচকে অসংখ্যশরে সমাকীর্ণ করিলেন।

‘অনন্তর, সেই ঘোরতর রজনীযোগে ইন্দ্র ও প্রহ্লাদের ন্যায় অশ্বত্থামা ও ঘটোৎকচের পুনরায় যুদ্ধ আরম্ভ হইল। ঘটোৎকচ ক্রুদ্ধ হইয়া কালাগ্নিসদৃশ দশবাণে দ্রোণনন্দনের বক্ষঃস্থলে আঘাত করিলে মহাবলপরাক্রান্ত অশ্বত্থামা গাঢ়তর বিদ্ধ ও ব্যথিত হইয়া বায়ুসঞ্চালিত পাদপের ন্যায় বিচলিত হইতে লাগিলেন। তখন আপনার সৈন্যগণ দ্ৰোণতনয়কে নিহত বোধ করিয়া হাহাকার করিতে লাগিল। পাঞ্চাল ও সৃঞ্জয়গণ অশ্বত্থামাকে তদবস্থ দেখিয়া সিংহনাদ করিতে আরম্ভ করিলেন।

“অনন্তর মহারথ অশ্বত্থামা সংজ্ঞালাভ করিয়া বামকরে কার্মুক গ্রহণ ও আকর্ণ আকর্ষণপূর্ব্বক ঘটোৎকচকে লক্ষ্য করিয়া অবিলম্বে এক যমদণ্ডোপম ভীষণশর নিক্ষেপ করিলেন। সেই সুপঙ্খ শর রাক্ষসের হৃদয় ভেদ করিয়া ভূগর্ভে প্রবিষ্ট হইল। মহাবলপরাক্রান্ত ঘটোৎকচ দ্রৌণীনির্মুক্তশরে গাঢ়তর বিদ্ধ ও মোহাবিষ্ট হইয়া রথোপরি উপবেশন করিলেন। তখন সারথি তাঁহাকে বিমোহিত দেখিয়া সসম্ভ্রমে অশ্বত্থামার নিকট হইতে অপবাহিত করিল। মহারথ অশ্বত্থামা এইরূপে রাক্ষসেন্দ্র ঘটোৎকচকে বিদ্ধ করিয়া ঘোরতর সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন এবং আপনার দুর্য্যোধনপ্রমুখ পুত্রগণ ও যোধসমুদয়কর্ত্তৃক পূজিত হইয়া মধ্যাহ্নকালীন দিবাকরের ন্যায় সমধিক তেজঃসম্পন্ন হইলেন।

ভীম-দুর্য্যোধন যুদ্ধে দুর্য্যোধনপরাজয়

“অনন্তর রাজা দুর্য্যোধন আচার্য্যের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত ভীমসেনকে নিশিতশরনিকরে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। তখন ভীমসেন দুর্য্যোধনকে নয়শরে বিদ্ধ করিলে তিনি তাঁহাকে বিংশতিশরে বিদ্ধ করিলেন। এইরূপে তাঁহারা উভয়ে শরনিকরে সমাচ্ছন্ন হইয়া নভোমণ্ডলে জলদজালসমাবৃত চন্দ্ৰসূর্যের ন্যায় দৃষ্ট হইলেন। পরে রাজা দুর্য্যোধন পাঁচবাণে ভীমকে বিদ্ধ করিয়া ‘থাক থাক’ বলিয়া আস্ফালন করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর ভীম নিশিতশরে কুরুরাজের ধ্বজ ও কোদণ্ড খণ্ড খণ্ড করিয়া তাঁহাকে সন্নতপর্ব্ব নবতিশরে বিদ্ধ করিলেন। রাজা দুর্য্যোধন তদ্দর্শনে ক্রোধাবিষ্ট হইয়া অন্য সুদৃঢ় শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক ধনুর্দ্ধরদিগের সমক্ষে নিশিতশরনিকরে ভীমসেনকে নিপীড়িত করিতে লাগিলেন। মহাবীর ভীম সেই দুর্য্যোধনবিমুক্ত শসমুদয় ছেদন করিয়া তাঁহাকে পঞ্চবিংশতি ক্ষুদ্রকাস্ত্রে বিদ্ধ করিলেন। তখন রাজা দুর্য্যোধন নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া ক্ষুরপ্ৰাস্ত্ৰদ্বারা ভীমের কার্মুক ছেদন করিয়া তাঁহার উপর দশবাণ নিক্ষেপ করিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত ভীম তৎক্ষণাৎ অন্য ধনু গ্রহণপূর্ব্বক রাজা দুর্য্যোধনকে নিশিতসাতশরে বিদ্ধ করিয়া লঘুহস্ততা প্রদর্শন করিতে লাগিলেন। তখন রাজা দুর্য্যোধন সত্বর হার সেই কার্মুকও ছেদন করিলেন। হে মহারাজ! এইরূপে আপনার পুত্র জয়শালী দুর্য্যোধন পাঁচবার ভীমের শরাসন ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তখন মহাবীর ভীমসেন বারংবার শরাসন ছিন্ন হওয়াতে যৎপরোনাস্তি ক্রুদ্ধ হইয়া এক সর্ব্বলোহময় সুদৃঢ় শক্তি নিক্ষেপ করিলেন। সেই যমভগিনীতুল্য হুতাশনসমপ্রভ ভীষণ শক্তি নভোমণ্ডল সীমন্তিত [মস্তকের কেশমধ্যগত রেখাপাতের ন্যায় দ্বিধাবিচ্ছিন্ন] করিয়াই যেন দুর্য্যোধনের প্রতি ধাবমান হইলে মহাবীর দুর্য্যোধন যোধগণের সমক্ষে উহা অর্দ্ধপথে দুইখণ্ডে ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তখন ভীমসেন ক্রোধভরে মহাবেগে দুর্য্যোধনের রথ লক্ষ্য করিয়া এক প্রভাবিশিষ্ট গুরুতর গদা নিক্ষেপ করিলেন। ভীমসেনের ভীষণ গদাঘাতে কুরুরাজের রথ ও অশ্বগণ সারথির সহিত চূর্ণ হইয়া গেল। তখন দুর্য্যোধন ভীমের পরাক্রমদর্শনে নিতান্ত ভীত হইয়া পলায়নপূর্ব্বক মহাত্মা নন্দকের রথে সমারূঢ় হইলেন; ভীমসেন সেই রজনীতে মহারথ দুর্য্যোধনকে নিহত বিবেচনা করিয়া কৌরবগণকে তর্জ্জনপূর্ব্বক সিংহনাদ করিতে আরম্ভ করিলেন। আপনার সেনাগণও নরপতিকে মৃত বোধ করিয়া চতুর্দ্দিকে হাহাকার করিতে লাগিল। ঐ সময় রাজা যুধিষ্ঠির কৌরবপক্ষীয় যোধগণের আর্ত্তনাদ ও মহাত্মা ভীমসেনের সিংহনাদশ্রবণে দুর্য্যোধনকে নিহত বিবেচনা করিয়া মহাবেগে বৃকোদরসমীপে আগমন করিলেন। তখন পাঞ্চাল, কৈকেয়, মৎস্য, সৃঞ্জয় ও চেদিগণ দ্রোণের বিনাশবাসনায় সুসজ্জিত হইয়া ধাবমান হইলেন। অনন্তর ঘোর তিমিরনিমগ্ন পরস্পর প্রহারনিরত যোধগণের সমক্ষে বিপক্ষদলের সহিত দ্রোণাচার্য্যের তুমুল সংগ্রাম হইতে লাগিল।”