১৭৮. অলায়ুধের ঘটোৎকচ-আক্রমণ–ভীমসহ যুদ্ধ

১৭৮তম অধ্যায়

অলায়ুধের ঘটোৎকচ-আক্রমণ–ভীমসহ যুদ্ধ

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! যেরূপ প্লবহীন ব্যক্তিগণ প্লবপ্রাপ্ত হইয়া সাগর পার হইবার মানসে আহ্লাদিত হয়, তদ্রূপ দুর্য্যোধনপ্রমুখ আপনার পুত্রগণ ও সমস্ত কৌরবপক্ষীয় ব্যক্তি সেই ভীমকর্ম্মা বীরপুরুষকে সমাগত দেখিয়া আনন্দিত হইলেন। কৌরবপক্ষীয় ভূপালগণ আপনাদিগের পুনর্জ্জন্ম বোধ করিয়াই যেন সেই স্ব স্ব গণপরিবৃত সমাগত রাক্ষসে অলায়ুধকে স্বাগতপ্রশ্ন করিয়া পূজা করিতে লাগিলেন।

“হে মহারাজ! ঐ সময় কর্ণের সহিত ঘটোৎকচের অতি ভীষণ অলৌকিক সংগ্রাম উপস্থিত হইলে পাঞ্চাল ও অন্যান্য কৌরবপক্ষীয় ভূপালগণ বিষ্ময়াপন্ন হইয়া তাঁহাদের বিক্রম দর্শন। করিতে আরম্ভ করিলেন। দ্রোণ, কৃপ, অশ্বত্থামাপ্রমুখ বীরগণ সমরে ঘটোৎকচের অলৌকিক কাৰ্য্য অবলোকনপূর্ব্বক অসম্ভ্রান্তচিত্তে কৌরবসৈন্যসমুদয় বিনষ্ট হইল বলিয়া চীৎকার করিতে লাগিলেন। আপনার সেনাগণ কর্ণের জীবনাশা পরিত্যাগ করিয়া হাহাকার করিয়া নিতান্ত ভীত হইয়া উঠিল। তখন দুর্য্যোধন কর্ণকে সাতিশয় পীড়িত দেখিয়া রাক্ষসেন্দ্র অলায়ুধকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে রাক্ষসে! কর্ণ ভীমতনয়ের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইয়া স্বীয় বলবীর্য্যের অনুরূপ কাৰ্য্য করিতেছেন। ভীমসেনকুমার তথাপি মহাবীর নৃপতিগণকে গজভগ্ন পাদপের ন্যায় বিবিধ শস্ত্রে নিপীড়িত করিয়া নিহত করিয়াছে; অতএব আমি এক্ষণে তোমার প্রতি এই ভার অর্পণ করিলাম যে, তুমি বিক্রম প্রকাশপূর্ব্বক ভীমপুত্রকে নিপাতিত কর। পাপাত্মা ঘটোৎকচ মায়াবল অবলম্বনপূর্ব্বক যেন কর্ণকে সংহার করিতে না পারে।’

‘মহাবলপরাক্রান্ত অলায়ুধ দুৰ্য্যোধনের বাক্য শ্রবণানন্তর ‘যে আজ্ঞা মহাশয়’ বলিয়া ঘটোৎকচের প্রতি ধাবমান হইল। তখন ভীমকুমার কর্ণকে পরিত্যাগপূর্ব্বক শরনিকরদ্বারা সমাগত শত্রুকে নিপীড়িত করিতে লাগিলেন। তখন অরণ্যে করিণীর নিমিত্ত মত্তমাতঙ্গদ্বয়ের যেরূপ সংগ্রাম হইয়া থাকে, তদ্রূপ সেই রাক্ষসদ্বয়ের তুমুল যুদ্ধ উপস্থিত হইল। মহারথ কর্ণও ঐ অবসরে নিশাচর হইতে মুক্ত হইয়া সূৰ্য্যসমপ্রভ স্যন্দনে আরোহণপূর্ব্বক ভীমসেনের প্রতি ধাবমান হইলেন। ভীমসেন স্বীয় পুত্রকে সিংহার্পিত বৃষের ন্যায় অলায়ুধশরে নিপীড়িত দেখিয়া কর্ণকে উপেক্ষা করিয়া অসংখ্য শরনিক্ষেপপূর্ব্বক রাক্ষসের রথাভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন। অলায়ুধ ভীমকে আগমন করিতে দেখিয়া ঘটোৎকচকে পরিত্যাগপূর্ব্বক তাঁহার অভিমুখে ধাবমান হইল। রাক্ষসান্তকারী বৃকোদর তদ্দর্শনে সহসা তাঁহার সম্মুখীন হইয়া শরবর্ষণদ্বারা সেই স্বগণপরিবেষ্টিত রাক্ষসকে আকীর্ণ করিলেন। তখন অলায়ুধ বারংবার তাঁহার উপর শিলাধৌত সরল শরনিকর বর্ষণ করিতে লাগিল। বিবিধাস্ত্রধারী ভীষণাকার।রাক্ষসগণও জিগীষু হইয়া ভীমসেনের প্রতি ধাবমান হইল। মহাবলপরাক্রান্ত ভীমসেন রাক্ষসগণকর্ত্তৃক এইরূপে তাড়িত হইয়া তাহাদিগের প্রত্যেককে নিশিত পাঁচ পাঁচ বাণে বিদ্ধ করিলেন। নিশাচরগণ ভীমশরে নিপীড়িত হইয়া ভীষণ চীৎকার করিয়া দশদিকে পলায়ন করিতে লাগিল। মহাবল অলায়ুধ নিশাচরগণকে ভীত দেখিয়া বেগে আগমনপূর্ব্বক ভীমসেনকে শরজালে সমাচ্ছন্ন করিল। ভীমসেন তীক্ষ্ণশরনিকরদ্বারা তাহাকে আহত করিতে লাগিলেন। অলায়ুধ ভীমনিক্ষিপ্ত শরনিকরের মধ্যে কতকগুলি ছেদন ও কতকগুলি গ্রহণ করিল; তখন ভীমসেন ভীমপরাক্রম রাক্ষসকে লক্ষ্য করিয়া এক অশনিসদৃশ গদা নিক্ষেপ করিলেন। নিশাচর গদাদ্বারা সেই ভীমনিক্ষিপ্ত জ্বালাকুল গদা তাড়িত করিলে উহা ভীমের প্রতি ধাবধান হইল। তখন ভীমসেন শরবর্ষণ করিয়া নিশাচরকে সমাচ্ছন্ন করিতে লাগিলেন; রাক্ষসও নিশিতশরনিকরে সেই শরসমুদয় ব্যর্থ করিয়া ফেলিল। ঐ সময় ভীষণাকার নিশাচরগণ অলায়ুধের আজ্ঞানুসারে কুঞ্জরগণকে বিনাশ করিতে লাগিল। সেই ভীষণ সংগ্রামে পাঞ্চাল ও সৃঞ্জয়গণ এবং হস্তী ও অশ্বসমুদয় রাক্ষসশরে নিপীড়িত হইয়া নিতান্ত অসুস্থ হইয়া উঠিল।

“হে মহারাজ! তখন মহাত্মা বাসুদেব সেই অতি ভয়াবহ ঘোর সংগ্রাম উপস্থিত দেখিয়া অর্জ্জুনকে কহিলেন, ‘হে ধনঞ্জয়! ঐ দেখ, মহাবাহু ভীমসেন নিশাচরের বশীভূত হইয়াছেন; তুমি কিছুমাত্র বিবেচনা না করিয়া শীঘ্র তাঁহার পদানুসরণে প্রবৃত্ত হইয়া দ্রোণপুরস্কৃত সৈন্যগণকে সংহার কর। ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী, যুধামন্যু, উত্তমৌজা ও মহারথ দ্রৌপদীতনয়গণ কর্ণের প্রতি ধাবমান হউক এবং বলবীৰ্য্যশালী নকুল, সহদেব ও যুযুধান তোমার শাসনে অন্যান্য রাক্ষসগণকে সংহার করুক। এক্ষণে অতি ভয়ানক সময় উপস্থিত হইয়াছে। হে মহারাজ! মহাবাহু কৃষ্ণ এই কথা কহিলে মহারথগণ তাহার আজ্ঞাক্রমে কর্ণ ও নিশাচরগণের প্রতি ধাবমান হইলেন।

‘অনন্তর প্রবলপ্রতাপ অলায়ুধ আশীবিষোপম শরনিকরদ্বারা ভীমসেনের শবাসন ছেদন করিয়া নিশিতশরে তাঁহার অশ্বসমুদয় ও সারথিকে সংহার করিল। তখন বৃকোদর অশ্বহীন ও সারথিবিহীন হইয়া রথ হইতে অবতরণপূর্ব্বক চীৎকার করিয়া অলায়ুধের প্রতি ভয়ঙ্কর গদা পরিত্যাগ করিলেন। রাক্ষস গদাপ্রহারে সেই ভীমনিক্ষিপ্ত ভীষণনির্ঘোষ মহাগদা চূর্ণ করিয়া সিংহনাদ করিতে লাগিল। ভীমসেন অলায়ুধের সেই ভয়ঙ্কর কাৰ্য্য অবলোকন করিয়া আহ্লাদিতচিত্তে অন্য গদা নিক্ষেপ করিলেন। এইরূপে সেই বীরদ্বয়ের তুমুল যুদ্ধ হইতে লাগিল। গদানিপাতশব্দে ভূমণ্ডল কম্পিত হইয়া উঠিল। পরিশেষে তাঁহারা গদাপরিত্যাগপূর্ব্বক পরস্পরের উপর বজ্রসম মুষ্টিপ্রহার এবং যদৃচ্ছা লব্ধ ধ্বজ, রথচক্র, যুগ, অক্ষ, অধিষ্ঠান ও অলঙ্কারাদি নিক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিলেন। তৎপরে উভয়ে, রুধিরমোক্ষণপূর্ব্বক মত্তমাতঙ্গদ্বয়ের ন্যায় পরস্পরকে আকর্ষণ করিতে লাগিলেন। পাণ্ডবহিতৈষী হৃষীকেশ তদ্দর্শনে ভীমসেনের উদ্ধারার্থ ঘটোৎকচকে প্রেরণ করিলেন।”