১৫৫. দ্রোণাচাৰ্য্যকর্ত্তৃক শিবিবধ

১৫৫তম অধ্যায়

দ্রোণাচাৰ্য্যকর্ত্তৃক শিবিবধ

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ ও ভূরিশ্রবা নিহত হইলে নিতান্ত দুর্দ্ধর্ষ মহাবীর দ্রোণ আমার আত্মজ দুৰ্য্যোধনকে সেই কথা কহিয়া ক্রোধাবিষ্টচিত্তে পাঞ্চাল ও সৃঞ্জয়গণমধ্যে প্রবিষ্ট হইলে তোমরা কি মনে করিলে? ধনঞ্জয় অপরাজিত মহাবীর আচাৰ্য্যকে সৈন্যমধ্যে প্রবেশ করিতে দেখিয়া কি বিবেচনা করিতে লাগিল এবং মূঢ় দুর্য্যোধনই বা কোন্ কাৰ্য্য তত্ত্বালোচিত বলিয়া অবধারণ করিল? তৎকালে কোন্ কোন্ বীর দ্রোণের অনুগমনে প্রবৃত্ত হইল আর কোন্ কোন্ বীরই বা তাঁহাকে শত্ৰুসংহারে সমুদ্যত দেখিয়া তাঁহার পশ্চাৎ ও সম্মুখে যুদ্ধ করিতে লাগিল? স্পষ্টই বোধ হইতেছে, পাণ্ডবগণ দ্রোণের শরনিকরে নিপীড়িত হইয়া শীতার্ত্ত কৃশ গোসমূহের ন্যায় কম্পিত হইয়াছিল। যাহা হউক সেই অরাতিনিপাতন মহাবীর পাঞ্চালগণমধ্যে প্রবেশ করিয়া কিরূপে পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইলেন? হে মহৎ সঞ্জয়! সেই রাত্রিকালে সমস্ত মহারথ ও সৈন্যগণ সমবেত হইয়া বিমর্পিত হইতে থাকিলে তোমাদের মধ্যে কোন্ কোন্ বুদ্ধিমান ব্যক্তি তথায় অবস্থান করিলেন? তুমি কহিতেই, আমার পক্ষীয় বীরগণ ও মহারথগণ নিহত, পরাভূত ও রথশূন্য হইয়াছেন। এক্ষণে তাঁহারা গাঢ়ান্ধকারনিমগ্ন, পাণ্ডবগণের শরে নিপীড়িত ও মোহাবিষ্ট হইয়া কিরূপ কৰ্ত্তব্য অবধারণ করিলেন? তুমি কহিতেছ, পাণ্ডবগণ জয়লাভে একান্ত হৃষ্ট ও নিতান্ত সন্তুষ্ট এবং অস্মপক্ষীয় বীরগণ অপ্রহৃষ্ট, ভীত ও বিমনস্ক হইতেছে; কিন্তু সেই ঘোর নিশাকালে পাণ্ডব ও কৌরবগণের বিভিন্নতা কিরূপে তোমার অনুমান হইল?”

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! সেই রাত্রিকালে ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হইলে পাণ্ডবগণ, সোমকদিগের সহিত দ্রোণের অভিমুখে ধাবমান হইলেন। তখন আচাৰ্য্য দ্রুতগামী শরনিকরে কেকয়গণ ও ধৃষ্টদ্যুম্নের আত্মজগণকে যমরাজের রাজধানীতে প্রেরণ করিলেন। ঐ সময়ে যে যে মহারথ তাঁহার সম্মুখীন হইয়াছিলেন, সকলেই শমনসদনে আতিথ্য গ্রহণ করিলেন। তখন প্রবল প্রতাপশালী মহারাজ শিবি ক্রোধাবিষ্ট হইয়া বলপ্রমার্থী মহারথ দ্রোণাচার্য্যের প্রতি ধাবমান হইলেন। মহাবীর আচার্য্য তাঁহাকে সমাগত সন্দর্শন করিয়া লৌহময় দশশরে বিদ্ধ করিলে তিনি কঙ্কপত্রভূষিত ত্রিংশত্বণে আচাৰ্য্যকে প্রতিবিদ্ধ করিয়া ভল্লাস্ত্রে তাঁহার সারথিকে নিপাতিত করিলেন। মহাবীর দ্রোণাচাৰ্য্য তদ্দর্শনে ক্রুদ্ধ হইয়া মহাত্মা শিবির অশ্ব ও সারথিকে সংহারপূর্ব্বক তাঁহার উষ্ণীষযুক্ত মস্তক ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তখন মহারাজ দুৰ্য্যোধন সত্বর দ্রোণের নিকট অন্য এক সারথি প্রেরণ করিলেন। সারথি দুর্য্যোধনের আদেশানুসারে দ্রোণের অসঞ্চালন করিতে আরম্ভ করিলে মহাত্মা আচার্য্য অরাতিগণের অভিমুখে ধাবমান হইলেন।

ভীমকর্ত্তৃক ধ্রুবাদি কলিঙ্গরাজপুত্রসংহার

“এদিকে কলিঙ্গরাজের পুত্র পিতৃবধজনিত দুঃখে অতিমাত্র ক্রুদ্ধ হইয়া কলিঙ্গদেশোদ্ভব সৈন্যগণসমভিব্যাহারে ভীমের অভিমুখে গমনপূর্ব্বক প্রথমতঃ পাঁচ ও তৎপরে সাতশরে তাঁহাকে বিদ্ধ করিলেন। তদনন্তর তাঁহার সারথি বিশোককে তিনশরে নিপীড়িত করিয়া একবাণে তাঁহার রথধ্বজ ছেদন করিয়া ফেলিলেন। মহাবল ভীমসেন তদ্দর্শনে ক্রোধভরে স্বীয় রথ হইতে তাঁহার রথে গমনপূর্ব্বক মুষ্টিপ্রহারে তাঁহাকে নিহত করিলেন। ভীমের ভীষণ মুষ্টিপ্রহারে কলিঙ্গরাজতনয়ের অস্থিসকল চূর্ণ হইয়া পৃথক পৃথক নিপতিত হইল। মহাবীর কর্ণ এবং কলিঙ্গরাজতনয়ের ভ্রাতা ধ্রুব ও জয়রাতপ্রমুখ বীরগণ কলিঙ্গরাজপুত্রের বিনাশ সহ্য করিতে না পারিয়া আশীবিষসদৃশ নারাচদ্বারা ভীমকে প্রহার করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর ভীম অবিলম্বে ধ্রুবের রথে গমনপূর্ব্বক তাঁহাকে নিরন্তর শরনিকর বর্ষণ করিতে দেখিয়া মুষ্টিপ্রহার করিলেন। ধ্রুব সেই মহাবলপরাক্রান্ত পাণ্ডুনন্দনের মুষ্ট্যাঘাতে তৎক্ষণাৎ ভূতলে নিপতিত হইলেন। মহাবীর ভীম এইরূপে ধ্রুবকে সংহার করিয়া জয়রাতের রথে সমুপস্থিত হইয়া সিংহনাদ করিতে লাগিলেন এবং কর্ণের সমক্ষে তাঁহাকে বামহস্তে আকর্ষণপূর্ব্বক তলপ্রহারে বিনষ্ট করিলেন। তখন মহাবীর কর্ণ ভীমের প্রতি কাঞ্চনময়ী শক্তি প্রয়োগ করিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত ভীম হাস্যমুখে তৎক্ষণাৎ সেই শক্তি গ্রহণপূর্ব্বক তাঁহারই প্রতি নিক্ষেপ করিলেন। সুবলনন্দন শকুনি সেই শক্তি কর্ণের প্রতি আগমন করিতে দেখিয়া সত্বর সুতীক্ষ্ণশরে ছেদন করিয়া ফেলিলেন।

ধৃতরাষ্ট্রতনয় দুর্ম্মদদুষ্কর্ণ সংহার

“হে মহারাজ! এইরূপে ভীমপরাক্রম ভীমসেন এই সমুদয় মহাকাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিয়া স্বরথে আরোহণপূর্ব্বক পুনরায় আপনার সৈন্যগণের প্রতি ধাবমান হইলেন। তখন আপনার মহারথ পুত্রগণ ভীমকে ক্রুদ্ধ অন্তকের ন্যায় জিঘাংসাপরবশ হইয়া আগমন করিতে দেখিয়া শরজাল বিস্তারপূর্ব্বক তাঁহাকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। মহাবীর ভীম তদ্দর্শনে হাস্যমুখে শরনিকর বর্ষণপূর্ব্বক দুর্ম্মদের সারথি ও অশ্বগণকে শমনসদনে প্রেরণ করিলেন। দুর্ম্মদ সত্বর দুষ্কর্ণের রথে সমারূঢ় হইলেন। তখন সেই ভ্রাতৃদ্বয় বরুণ ও সূৰ্য্য যেমন তারকাসুরের অভিমুখীন হইয়াছিলেন, তদ্রূপ ভীমের অভিমুখীন হইয়া শরনিকর বর্ষণপূর্ব্বক তাঁহাকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। মহাবীর ভীম তদ্দর্শনে ক্রোধভরে কর্ণ, দ্রোণ, দুৰ্য্যোধন, কৃশ, সোমদত্ত ও বাহ্লিকের সমক্ষে পাদপ্রহারে ঐ বীরদ্বয়ের রথ ধরাতলে প্রোথিত করিলেন এবং ক্রোধভরে তাঁহাদিগকে মুষ্টিপ্রহারে বিনষ্ট করিয়া সিংহনাদ করিতে লাগিলেন। তখন সৈন্যগণমধ্যে হাহাকারশব্দ সমুত্থিত হইল। মহীপালগণ ভীমকে নিরীক্ষণ করিয়া কহিতে লাগিলেন, এই ভীমসেন সাক্ষাৎ রুদ্রদেব, ইনি ভীমরূপে এক্ষণে ধৃতরাষ্ট্র তনয়গণকে বিনাশ করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। হে মহরাজ। ভূপতিগণ এই বলিয়া মোহাবিষ্টচিত্তে অশ্বসঞ্চালন পূর্ব্বক প্রত্যেকে পৃথক পৃথক্‌ দিকে পলায়ন করিতে লাগিলেন।

“এইরূপে লোহিতলোচন ভীমপরাক্রম ভীম সেই নিশাকালে ধাৰ্তরাষ্ট্রসৈন্যগণকে সংহারপূর্ব্বক ভূপতিগণের প্রশংসাভাজন হইয়া যুধিষ্ঠিরসন্নিধানে গমন করিয়া তাহাকে পূজা করিলেন। ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির, নকুল, সহদেব, বিরাট, দ্রুপদ ও কেকয়গণ ভীমকে নিরীক্ষণ করিয়া সাতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন এবং ভগবান শঙ্কর অন্ধকাসুরকে সংহার করিয়া আগমন করিলে সুরগণ যেমন তাঁহার সৎকার করিয়াছিলেন, তদ্রূপ তাঁহারাও ভীমের সৎকার করিতে লাগিলেন।

“হে মহারাজ! অনন্তর বরুণাত্মজসদৃশ আপনার আত্মজগণ দ্রোণসমবেত হইয়া ক্রোধাবিষ্টচিত্তে রথ, পদাতি ও কুঞ্জরগণসমভিব্যাহারে যুদ্ধার্থ ভীমকে পরিবেষ্টন করিলেন। তখন সেই জলদজালসদৃশ অন্ধকারসমাচ্ছন্ন ভয়ঙ্কর নিশাকালে বৃক, কাক ও গৃধ্রণের আমোদজনক ঘোরতর সংগ্রাম আরম্ভ হইল।”