১৮১. ঘটোৎকচবধঘটিত রহস্য

১৮১তম অধ্যায়

ঘটোৎকচবধঘটিত রহস্য

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! মহাত্মা পাণ্ডবগণ মহাবীর হিড়িম্বাতনয়কে নিহত ও পর্ব্বতের ন্যায় নিপতিত নিরীক্ষণ করিয়া শোকে বাষ্পকুলনেত্র হইলেন; কিন্তু অসাধারণ ধীশক্তিসম্পন্ন বাসুদেব হর্ষসাগরে নিমগ্ন হইয়া পাণ্ডবগণকে নির্ব্যথিত করিয়া সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। তিনি রথরশ্মি সংযত করিয়া অর্জ্জুনকে আলিঙ্গনপূর্ব্বক বাতোদ্ধূত বনস্পতির ন্যায় রথোপরি নৃত্য আরম্ভ করিলেন এবং অনতিবিলম্বেই পুনৰ্বার অর্জ্জুনকে আলিঙ্গন করিয়া বারংবার আস্ফোটনপূর্ব্বক পুনর্ব্বার সিংহনাদ পরিত্যাগে প্রবৃত্ত হইলেন।

“হে মহারাজ! ঐ সময় মহাবীর অর্জ্জুন কেশবকে সাতিশয় হৃষ্ট সন্দর্শন করিয়া উৎকণ্ঠিতচিত্তে কহিলেন, ‘হে মধুসূদন! আমাদিগের প্রধানতম সৈন্যগণ ও আমরা সকলেই হিড়িম্বাতনয়কে নিহত নিরীক্ষণ করিয়া অতিশয় শোকার্ত্ত হইয়াছি; কিন্তু তুমি সাতিশয় আহ্লাদ প্রকাশ করিতেছ। তোমার এই অনুপযুক্ত সময়ে আহ্লাদ প্রকাশ সমুদ্রশোষের [সাগর শুকাইবার] ন্যায় ও মেরুসঞ্চালনের [পর্ব্বতের বিচলিত হইবার] ন্যায় নিতান্ত আশ্চর্য্যবোধ হইতেছে। যাহা হউক, তোমার এই আহ্লাদের অবশ্যই কোন মহৎ কারণ আছে। যদি উহা গোপনীয় হয়, তাহা হইলে যথাবৎ কীৰ্ত্তন কর, উহা শুনিতে আমার নিতান্ত বাসনা হইতেছে।’

“বাসুদেব কহিলেন, ‘হে ধনঞ্জয়! আমি যে জন্য সাতিশয় আহ্লাদিত হইয়াছি, তাহা কহিতেছি শ্রবণ কর। মহাবীর কর্ণ আজ ঘটোৎকচের উপর বাসবদত্ত শক্তি নিক্ষেপ করিয়া আমাদের অতিশয় প্রীতিকর কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াছে। হে ধনঞ্জয়! তুমি এখন কর্ণকে সমরভূমিতে নিপাতিত বলিয়া বোধ কর। এই পৃথিবীমধ্যে এমন কোন বীরপুরুষ নাই যে, কার্ত্তিকেয়সদৃশ শক্তিধারী সূতপুত্রের অভিমুখে অবস্থান করিতে পারে; কিন্তু আমাদের ভাগ্যক্রমে কর্ণের কবচ ও কুণ্ডল অপহৃত হইয়াছে এবং অদ্য উহার শক্তিও ঘটোৎকচের উপর নিক্ষিপ্ত ও উহার নিকট হইতে অপসৃত হইল। সুতপুত্রের কবচ এবং কুণ্ডল থাকিলে ঐ বীর একাকীই সুরগণের সহিত ত্রিলোক পরাজয় করিতে সমর্থ হইত। কি দেবরাজ, কি কুবের, কি বরুণ, কি যম—কেহই কর্ণসমীপে অবস্থান করিতে সমর্থ হইতেন না। তুমি গাণ্ডীব এবং আমি সুদর্শনচক্র উদ্যত করিয়াও উহাকে পরাজিত করিতে পারিতাম না; কিন্তু দেবরাজ ইন্দ্র তোমার হিতসাধনার্থ কর্ণকে কবচ ও কুণ্ডলবিহীন করিয়াছেন। মহাবীর রাধেয় পূর্ব্বে কবচকুণ্ডলদ্বয় ছেদন করিয়া পুরন্দরকে প্রদান করায় বৈকৰ্ত্তন নামে বিখ্যাত হইয়াছে। আজ কর্ণকে মন্ত্রবলে শিথিলিত ক্রুদ্ধ আশীবিষের ন্যায়, স্নিগ্ধজ্বাল অনলের ন্যায় বোধ হইতেছে। মহারথ কর্ণ যেদিন ইন্দ্রের নিকট কবচ ও কুণ্ডলদ্বয়ের বিনিময়ে শক্তি প্রাপ্ত হইয়াছে, সেইদিন অবধি ঐ মহাবীর উহাদ্বারা তোমাকে বিনাশ করিবে বলিয়া স্থির করিয়াছিল। এক্ষণে ঐ বীর শক্তিশূন্য হইয়াছে। উহা হইতে তোমার আর কিছুমাত্র শঙ্কা নাই।

কৃষ্ণকর্ত্তৃক কর্ণবধোপায়নির্ধারণ

‘যাহা হউক, হে ধনঞ্জয়! আমি শপথ করিয়া বলিতেছি যে, কর্ণ এক্ষণে শক্তিশূন্য হইলেও তুমি ভিন্ন অন্য কেহই উহাকে বিনাশ করিতে সমর্থ হইবে না। কর্ণ নিয়ত ব্ৰহ্মানুষ্ঠানে তৎপর, সত্যবাদী, তপস্বী, ব্রতচারী এবং অরাতিগণেরও প্রতি দয়াবান্ বলিয়া বৃষনামে বিখ্যাত হইয়াছে। ঐ মহাবাহু রণদক্ষ এবং নিরন্তর শরাসন উদ্যত করিয়া কেশরী যেমন বনমধ্যে মত্তমাতঙ্গগণকে মদবিহীন করে, তদ্রূপ মহারথগণকে মদহীন করিয়া মধ্যাহ্নকালীন শারদ মাৰ্ত্তণ্ডের ন্যায় যোধগণের দুর্দ্দর্শনীয় হইয়া সমরাঙ্গনে বিচরণ করিয়া থাকে। ঐ মহাবীর বর্ষাকালীন বারিধারাবর্ষী জলধরের ন্যায় শরনিকরবর্ষণে প্রবৃত্ত হইলে ত্রিদশগণও শরজাল বিস্তার করিয়া উহাকে পরাজিত করিতে সমর্থ হয়েন না। উহার শরপ্রভাবে তাঁহাদিগেরই শরীর হইতে মাংস, শোণিত বিগলিত হইতে থাকে; কিন্তু এক্ষণে সূতপুত্র কবচ, কুণ্ডল ও বাসবদত্ত শক্তিবিহীন হইয়া সামান্য মনুষ্যের ন্যায় অবস্থান করিতেছে। এক্ষণে কর্ণের বধোপায় অবধারণ করিয়া দিতেছি, শ্রবণ কর। সূতপুত্রের রথচক্র ভূতলে নিমগ্ন হইলে সেই ছিদ্রে আমার সঙ্কেত অবগত হইয়া সাবধানে উহাকে বিনাশ করিবে। কর্ণ উদ্যতায়ুধ হইয়া সংগ্রামে নিযুক্ত থাকিলে বজ্ৰায়ুধ বাসবও উহাকে পরাজিত করিতে সমর্থ হয়েন না। যাহা হউক, হে ধনঞ্জয়! আমিই তোমার হিতার্থ বিবিধ উপায় উদ্ভাবনপূর্ব্বক ক্রমে ক্রমে মহাবলপরাক্রান্ত জরাসন্ধ, শিশুপাল, নিষাদ একলব্য এবং হিড়িম্ব, কিৰ্মীর, বক, অলায়ুধ, উগ্ৰকর্ম্মা, ঘটোৎকচপ্রমুখ রাক্ষসের বধসাধন করিয়াছি।’ ”