১৬৯. সঙ্কুল যুদ্ধ-পাণ্ডবপরাজয়

১৬৯তম অধ্যায়

সঙ্কুল যুদ্ধ-পাণ্ডবপরাজয়

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ। এদিকে আপনার পুত্র চিত্রসেন নকুলপুত্র শতানীককে সুতীক্ষ্ণশরনিকরে কৌরবসৈন্যগণকে বিনষ্ট করিতে দেখিয়া তাঁহার নিবারণে প্রবৃত্ত হইলেন। নকুলনন্দন নারাচাস্ত্ৰদ্বারা চিত্রসেনকে নিপীড়িত করিলে চিত্রসেন তাঁহাকে প্রথমতঃ নিশিতদশশরে বিদ্ধ করিয়া পুনরায় তাঁহার বক্ষঃস্থলে নয়বাণ নিক্ষেপ করিলেন। তখন নকুলকুমার নতপর্ব্বশরনিকরে চিত্রসেনের বিচিত্র বর্ম্ম ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তদ্দর্শনে সকলেই চমৎকৃত হইল। মহাবীর চিত্রসেন বর্ম্মবিহীন হইয়া নিম্মোকনির্মুক্ত ভুজগের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। তখন নকুলতনয় সুনিশিতশরজালে তাঁহার ধ্বজ ও শরাসন ছেদন করিয়া ফেলিলেন। এইরূপে মহারথ চিত্রসেন বর্ম্মহীন ও শরাসনবিহীন হইয়া ক্রোধভরে অরাতিবিদারণ অন্য শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক শতানীককে নতপর্ব্বশরনিকরে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। তখন মহাবলপরাক্রান্ত শতানীক ক্রোধাবিষ্ট হইয়া তাঁহার চারি অশ্ব ও সারথিকে নিপাতিত করিলেন। বলবান চিত্রসেন তৎক্ষণাৎ রথ হইতে অবরোহণপূর্ব্বক নকুলতনয়কে পঞ্চবিংশতিশরে নিপীড়িত করিলেন। মহাবীর শতানীক চিত্রসেনকে বাণবর্ষণ করিতে দেখিয়া অর্দ্ধচন্দ্রবাণে তাহার সুবর্ণমণ্ডিত শরাসন ছেদন করিয়া ফেলিলেন। এইরূপে চিত্রসেন অশ্ব, সারথি, রথ ও শরাসনবিহীন হইয়া মহাত্মা হার্দ্দিক্যের রথে আরোহণ করিলেন।

“হে মহারাজ! ঐ সময় মহাবীর কর্ণপুত্র বৃসেন মহারথ দ্রুপদকে শরজালে সমাচ্ছন্ন করিতে লাগিলেন। যজ্ঞসেন ষষ্টিশরে কর্ণপুত্রের বাহুদ্বয় ও বক্ষঃস্থল বিদ্ধ করিলেন; বৃষসেনও রোষাবিষ্ট হইয়া রথস্থ দ্রুপদরাজের বক্ষঃস্থলে সুতীক্ষ্ণ শরনিকর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। তখন সেই বীরদ্বয় পরস্পরের শরজালে বিদ্ধ হইয়া সলোম শল্লকীদ্বয়ের ন্যায় শোভা ধারণ করিলেন। স্বর্ণপুঙ্খ নতপর্ব্ব সরল শরনিকরের আঘাতে তাঁহাদের কলেবর শোণিতাক্ত হওয়াতে তাঁহাদিগকে অদ্ভুত কল্পবৃক্ষদ্বয়ের ন্যায় ও বিকশিত কিংশুকদ্বয়ের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল।

‘অনন্তর মহাবীর বৃষসেন দ্রুপদকে প্রথমতঃ নয়শরে বিদ্ধ করিয়া পুনরায় সপ্ততি ও তৎপরে তিনশরে বিদ্ধ করিলেন এবং এক একবারে সহস্র সহস্র শর পরিত্যাগ করিয়া বৰ্ষমান মেঘের ন্যায় শোভমান হইলেন। তখন মহাবীর দ্রুপদ দ্রুদ্ধ হইয়া। নিশিতভশ্লদ্বারা বৃষসেনের শরাসন দুই খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। মহাবীর কর্ণতনয় তৎক্ষণাৎ অন্য এক সুবর্ণমণ্ডিত শরাসন গ্রহণ ও তূণীর হইতে সুবর্ণবর্ণ নিশিতভল্ল বহিষ্কৃত করিয়া তাহাতে সংযোজনপূর্ব্বক সোমকগণকে ভীত করিয়া দ্রুপদের প্রতি নিক্ষেপ করিলেন। বৃষসেননিক্ষিপ্ত ভল্ল দ্রুপদরাজের হৃদয় ভেদ করিয়া বসুধাতলে প্রবিষ্ট হইল। মহাবীর যজ্ঞসেন সেই ভল্লের আঘাতে মোহপ্রাপ্ত হইলেন। সারথি আপনার কর্ত্তব্য স্মরণপূর্ব্বক তাঁহাকে লইয়া পলায়ন করিল।

“হে মহারাজ! এইরূপে সেই মহারথ পাঞ্চালরাজ সমর পরিত্যাগ করিলে কৌরবসৈন্যরা সেই ভীষণ রজনীযোগে বহীন দ্রুপদসেনাগণের প্রতি ধাবমান হইল। তৎকালে প্রদীপসকল ইতস্ততঃ প্রজ্বলিত হওয়াতে বোধ হইতে লাগিল যেন মেঘশূন্য আকাশমণ্ডল গ্রহগণে সমাকীর্ণ হইয়াছে। অঙ্গদসকল চতুর্দ্দিকে নিপতিত থাকাতে সমরভূমি তখন বর্ষাকালীন বিদ্যুদ্দামরঞ্জিত জলপটলের ন্যায় শোভা ধারণ করিল। তারকাসুরের সংগ্রামসময়ে দানবগণ যেমন ইন্দ্রের ভয়ে পলায়ন করিয়াছিল, তদ্রূপ সোমকগণ বৃষসেনের শরনিকরে সমাহত হইয়া প্রাণভয়ে পলায়ন করিতে লাগিল। মহাবীর কর্ণতনয় তাঁহাদিগকে পরাজয় করিয়া মধ্যাহ্নকালীন মাৰ্ত্তণ্ডের ন্যায় শোভা ধারণ করিলেন। কৌরব ও পাণ্ডবপক্ষীয় সহস্র নরপতিমধ্যে একমাত্র বৃষসেন স্বীয় তেজঃপ্রভাবে প্রজ্বলিত হইয়া অবস্থান করিতে লাগিলেন। এইরূপে মহাবীর কর্ণনন্দন সোমমহারথদিগকে ছিন্নভিন্ন করিয়া রাজা যুধিষ্ঠিরের নিকট গমন করিলেন।

“হে মহারাজ! এদিকে আপনার পুত্র মহারথ দুঃশাসন প্রতিবিন্ধ্যকে অরাতিনিধনে নিতান্ত তৎপর দেখিয়া তাঁহার প্রতি ধাবমান হইলেন। তখন সেই বীরদ্বয় সংগ্রামার্থ পরস্পর মিলিত হইয়া নির্ম্মল নভোমণ্ডলস্থ বুধ ও শুক্রাচার্যের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। মহাবীর দুঃশাসন অতিভীষণ কাৰ্য্যে প্রবৃত্ত প্রতিবিন্ধ্যের ললাটে তিনশর নিক্ষেপ করিলেন। মহাবীর প্রতিবিন্ধ্য দুঃশাসনের শরে অতিমাত্র বিদ্ধ হইয়া শৃঙ্গবান্‌পর্ব্বতের ন্যায় শোভা প্রাপ্ত হইলেন এবং দুঃশাসনকে প্রথমতঃ নয় ও তৎপরে সাতশরে বিদ্ধ করিলেন। তখন আপনার পুত্র তীক্ষ্ণশরনিকরে প্রতিবিন্ধ্যের অশ্বগণকে নিপাতিত করিয়া একভল্লে তাঁহার ধ্বজ ও সারথির মস্তক ছেদনপূর্ব্বক তাঁহার রথ, পতাকা, তূণীর, রথী ও যোক্ত্রসমুদয় খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। মহাত্মা প্রতিবিন্ধ্য রথবিহীন হইয়াও শরাসনহস্তে অবস্থানপূর্ব্বক অসংখ্য শরনিক্ষেপপূর্ব্বক আপনার পুত্রের সহিত যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর দুঃশাসন তদ্দর্শনে ক্ষুরপ্র-অত্র নিক্ষেপপূর্ব্বক তাঁহার কোদণ্ড দ্বিখণ্ড করিয়া তাঁহাকে দশশরে তাড়িত করিলেন। অনন্তর প্রতিবিন্ধ্যের ভ্রাতৃগণ তাঁহাকে রথবিহীন অবলোকন করিয়া বিপুল সৈন্যসমভিব্যাহারে তাঁহার সমীপে সমাগত হইলেন। তখন প্রতিবিন্ধ্য শ্রুতসোমের ভাস্বররথে আরোহণপূর্ব্বক শরাসন গ্রহণ করিয়া আপনার পুত্রকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। তদ্দর্শনে কৌরবপক্ষীয়েরা দুঃশাসনের সাহায্যার্থ মহতী সেনাসমভিব্যাহারে আগমনপূর্ব্বক তাঁহাকে পরিবেষ্টিত করিয়া বিপক্ষগণের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন। হে মহারাজ! সেই ঘোরতর রজনীযোগে পাণ্ডবগণের সহিত কৌরবগণের যমরাজ্যবর্দ্ধন তুমুল সংগ্রাম আরম্ভ হইল।”