১৮৪. কৌরবগণকর্ত্তৃক পাণ্ডবসৈন্যনিপীড়ন

১৮৪তম অধ্যায়

কৌরবগণকর্ত্তৃক পাণ্ডবসৈন্যনিপীড়ন

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! কর্ণ, দুর্য্যোধন ও শকুনিপ্রমুখ বীরগণের বিশেষতঃ তোমার অতিশয় নীতিবিরুদ্ধ কাৰ্য্য দেখিতেছি। তোমরা সকলে ত অবগত ছিলে যে, সেই বাসবদত্ত শক্তি একজনকে অবশ্যই সংহার করিতে পারে এবং ইন্দ্রাদি দেবগণের মধ্যেও কেহ উহা সহ্য বা নিবারণ করিতে সমর্থ নহেন; তবে কর্ণ কি নিমিত্ত একাল পর্য্যন্ত সেই একপুরুষঘাতিনী শক্তি দেবকীপুত্র বা অর্জ্জুনের প্রতি প্রয়োগ করেন নাই?”

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! আমরা প্রতিদিন সমরাঙ্গন হইতে প্রত্যাগমনপূর্ব্বক রজনীযোগে পরামর্শ করিয়া কর্ণকে কহিতাম, হে কর্ণ! কল্য প্রভাতেই তুমি এই একপুরুষঘাতিনী শক্তি হয় কেশব, না হয় অর্জ্জুনের প্রতি নিক্ষেপ করিবে; কিন্তু দৈবের কি বিড়ম্বনা, পরদিন প্রভাতেই কি কৰ্ণ, কি অন্যান্য যোধগণ সকলেই উহা বিস্মৃত হইত। হে মহারাজ! দৈবই সর্ব্বাপেক্ষা প্রধান; তাহার প্রভাবে সূতনন্দন হতবুদ্ধি হইয়া দেবকীপুত্রের বা ইন্দ্রপরাক্রম অর্জ্জুনের প্রতি সেই কালরাত্রিস্বরূপিণী বাসবীশক্তি নিক্ষেপ করেন নাই।”

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! তোমরা স্ব স্ব বুদ্ধি, দৈব ও কেশবের প্রভাবে বিনষ্ট হইলে। বাসবদত্ত শক্তি তৃণতুল্য ঘটোৎকচকে বিনাশ করিয়া ব্যর্থ হইল। মহাবীর কর্ণ, আমার পুত্রগণ ও অন্যান্য ভূপালসমুদয় এই নীতিবহির্ভূত কাৰ্য্যনিবন্ধনই শমনভবনে গমন করিবেন। যাহা হউক, হিড়িম্বাতনয় নিহত হইলে কৌরব ও পাণ্ডবগণের পুনরায় কিরূপ যুদ্ধ উপস্থিত হইল, কীৰ্ত্তন কর। যে যে পাঞ্চালেরা সৃঞ্জয়গণের সহিত দ্রোণের অভিমুখে ধাবমান হইয়াছিল, তাহারা কি প্রকারে যুদ্ধ করিতে লাগিল? মহাবীর দ্রোণাচার্য্য, ভূরিশ্রবা ও সিন্ধু রাজ জয়দ্রথের, বিনাশনিবন্ধন অতিশয় রোষাবিষ্ট হইয়া জৃম্ভমান শার্দুলের ন্যায় ও ব্যাদিতাস্য কৃতান্তের ন্যায় প্রাণপণে অরাতিসৈন্যমধ্যে প্রবেশপূর্ব্বক শরবর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলে পাণ্ডব ও সৃঞ্জয়গণ কিরূপে তাঁহার সম্মুখীন হইল? দুৰ্য্যোধন, অশ্বত্থামা ও কৃপাচার্য্য প্রমুখ যে যে বীরগণ আচার্য্যের রক্ষায় নিযুক্ত ছিলেন তাঁহারা সংগ্রামস্থলে কি করিলেন? আমাদের পক্ষীয় বীরগণ দ্রোণাচাৰ্য্যবধার্থী ধনঞ্জয় ও বৃকোদরের উপর কিরূপ বাণবৃষ্টি করিল? কৌরবগণ জয়দ্রথের ও পাণ্ডবগণ ঘটোৎকচের বিনাশে সাতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়াছিল, তাহারা সেই রাত্রিতে পরস্পর কিরূপ যুদ্ধ করিতে লাগিল? এই সমুদয় বৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত কীৰ্ত্তন কর।”

ঘটোৎকচশোকে কৃষ্ণের যুধিষ্ঠিরসান্ত্বনা

সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! সেই ঘোর রজনীতে মহাবীর কর্ণ ঘটোৎকচকে নিহত করিলে কৌরবপক্ষীয় যোধগণ পরমাহ্লাদে সিংহনাদ পরিত্যাগপূর্ব্বক বেগে আগমন করিয়া পাণ্ডবসৈন্যসমুদয় বিনাশ করিতে আরম্ভ করিলে, রাজা যুধিষ্ঠির অতি দীনভাবে ভীমসেনকে কহিলেন, ‘হে ভ্রাতঃ! তুমি শীঘ্র কৌরবসৈন্যগণকে নিবারণ কর। আমি ঘটোৎকচের নিধনে বিমোহিতপ্রায় হইয়াছি। ধর্ম্মরাজ ভীমসেনকে এই কথা বলিয়াই অপূর্ণমুখে স্বীয় রথে আসীন হইয়া কর্ণের বিক্রম সন্দর্শনপূর্ব্বক বারংবার দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া মহামোহে অভিভূত হইলেন। মহাত্মা হৃষীকেশ যুধিষ্ঠিরকে নিতান্ত ব্যথিত অবলোকন করিয়া কহিলেন, ‘হে ধর্ম্মরাজ! প্রাকৃতজনের ন্যায় শোক প্রদর্শন করা আপনার কর্ত্তব্য নহে; অতএব আপনি শোকসংবরণপূর্ব্বক গাত্রোত্থান করিয়া সমরভার বহন করুন। আপনি এরূপ শোকপরবশ হইলে বিজয়লাভে সংশয় উপস্থিত হইবে।’

“হে কুরুরাজ! ধর্ম্মপুত্র যুধিষ্ঠির বাসুদেবের বাক্য শ্রবণানন্তর পাণিতলদ্বারা নেত্রদ্বয় পরিমার্জিত করিয়া কহিলেন, “হে মহাবাহো! ধর্ম্মপথ কিছুই আমার অবিদিত নাই। অকৃতজ্ঞ ব্যক্তি ব্রহ্মহত্যা পাপে লিপ্ত হয়। দেখ, অর্জ্জুন অস্ত্রশিক্ষার্থ গমন করিলে মহাত্মা হিড়িম্বাতনয় বালক হইয়াও আমাদিগের অনেক সাহায্য করিয়াছিল। ঐ মহাধনুর্দ্ধর কাম্যকবনে আমার শুশ্রুষা করিত এবং ধনঞ্জয়ের অনুপস্থিতকাল পর্য্যন্ত আমাদিগের সহিত একত্র বাস করিয়াছিল। ঐ যুদ্ধাভিজ্ঞ মহাবীর গন্ধমাদনগমনকালে আমাদিগকে দুর্গম স্থান হইতে উদ্ধার ও পরিশ্রান্তা পাঞ্চালীকে পৃষ্ঠে পৃষ্ঠে বহন করিয়াছিল। মহাবীর ভীমতনয় আমার নিমিত্ত এইরূপ অনেক দুষ্কর কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াছে। হে জনার্দ্দন! সহদেবে আমার যেরূপ স্বাভাবিক স্নেহ আছে, রাক্ষসেন্দ্র ঘটোৎকচের প্রতি তদপেক্ষা দ্বিগুণ ছিল। ভীমতনয় আমার অতিশয় ভক্ত ও প্রিয়ষ্কর ছিল; তজ্জন্যই আমি শোকসন্তপ্ত ও মোহপ্রাপ্ত হইতেছি। হে বার্ষ্ণেয়! ঐ দেখ, কৌরবেরা আমাদিগের সৈন্যসমুদয় বিদ্রাবিত করিতেছে। মহারথ দ্রোণাচাৰ্য্য ও কর্ণ পরমযত্নসহকারে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া মত্তমাতঙ্গদ্বয় যেমন নলবন প্রমথিত করে, তদ্রূপ পাণ্ডবসৈন্যগণকে মর্পিত করিতেছেন। কৌরবেরা ভীমসেনের ভুজবলে ও অর্জ্জুনের বিবিধ অস্ত্রশিক্ষায় অবজ্ঞা প্রদর্শনপূর্ব্বক বিক্রম প্রকাশ করিতেছে। ঐ দেখ, দ্রোণ, কর্ণ ও দুর্য্যোধন ঘটোৎকচের নিধননিবন্ধন আহ্লাদসাগরে নিমগ্ন হইয়াছে। হে জনার্দ্দন! তুমি এবং আমরা জীবিত থাকিতে সূতপুত্র কিরূপে সর্ব্বসমক্ষে মহলাবলপরাক্রান্ত ভীমতনয়ের বিনাশ সাধন করিল? যখন দুরাত্মা ধৃতরাষ্ট্রতনয়েরা অভিমন্যুকে বিনাশ করে, সে সময়ে মহারথ ধনঞ্জয় রণস্থলে উপস্থিত ছিল না; আমরাও সকলে সিন্ধুরাজকর্ত্তৃক রুদ্ধ ছিলাম। দ্রোণাচার্য্যই পুত্রসমভিব্যাহারে অভিমন্যুবিনাশের কারণ হইয়াছিলেন। তিনি তাহার বুধোপায় উদ্ভাবন করিয়া দেন, অশ্বত্থামা তাহার অসিদণ্ড দ্বিখণ্ড করিয়া ফেলে। নৃশংস কৃতবর্ম্মা বিপন্ন বালকের অশ্বগণকে পার্ঞ্চি ও সারথির সহিত নিহত করে এবং অন্যান্য ধনুর্দ্ধরেরা তাহার বিনাশসাধন করেন। হে যাদবশ্রেষ্ঠ! অভিমন্যুবধ জয়দ্রথের অতি সামান্য অপরাধ ছিল, তন্নিমিত্ত অর্জ্জুন জয়দ্রথকে বিনাশ করাতে আমি অধিক আহ্লাদিত হই নাই। এক্ষণে যদি শত্রুবিনাশ করা আমাদিগের অবশ্য কর্ত্তব্য হইয়া থাকে, তাহা হইলে আমার মতে অগ্রে দ্রোণ ও কর্ণকে বিনাশ করা কর্ত্তব্য। ঐ দুইজনই আমাদিগের দুঃখের আদি কারণ; উঁহাদের সাহায্যেই দুৰ্য্যোধন আশ্বাসযুক্ত হইয়াছে। হে মাধব! যে সংগ্রামে দ্রোণ ও কর্ণকে অনুচরগণের সহিত বিনাশ করা কর্ত্তব্য, অর্জ্জুন সেই যুদ্ধে মহাবীর জয়দ্রথকে বিনাশ করিয়াছে। যাহা হউক, এক্ষণে সূতপুত্রকে নিগ্রহ করা আমার অবশ্য কর্ত্তব্য হইয়াছে, অতএব আমি তাহার সহিত সংগ্রাম করিবার নিমিত্ত চলিলাম। ঐ দেখ ভীমপরাক্রম ভীমসেন দ্রোণসৈন্যগণের সহিত সমরে প্রবৃত্ত হইয়াছে।

শোকক্রুদ্ধ যুধিষ্ঠিরের অভিমান—ব্যাসসান্ত্বনা

“হে কুরুরাজ! রাজা যুধিষ্ঠির এই বলিয়া ভীষণ শরাসন বিস্ফারিত ও শঙ্খ প্রধ্নাপিত করিয়া সত্বর কর্ণের অভিমুখে ধাবমান হইলেন। ঐ সময়ে শিখণ্ডী অসংখ্য রথ, তিনশত হস্তী, পাঁচশত অশ্ব ও তিনসহস্র প্রভদ্ৰকসৈন্যপরিবেষ্টিত হইয়া ধর্ম্মরাজের অনুগমন করিলেন। পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণ ভেরী ও শঙ্খধ্বনি করিতে লাগিলেন। তখন মহাবাহু বাসুদেব ধনঞ্জয়কে কহিলেন, ‘হে অর্জ্জুন! ঐ দেখ, ধর্ম্মরাজ ক্রোধাবিষ্ট হইয়া সূতপুত্রের বিনাশবাসনায় গমন করিতেছেন। অতএব উঁহার উপর নির্ভর করিয়া নিশ্চিন্ত থাকা আমাদের কর্ত্তব্য নহে। মহাত্মা হৃষীকেশ এই বলিয়া সত্বর রথসঞ্চালনপূর্ব্বক দূরগত ধর্ম্মপুত্রের অনুগমনে প্রবৃত্ত হইলেন।

“হে মহারাজ! ঐ সময় মহর্ষি বেদব্যাস শোকবিমূঢ় সন্তপ্তচিত্ত যুধিষ্ঠিরকে সূতপুত্রের বিনাশবাসনায় সহসা গমন করিতে দেখিয়া তাঁহার সমীপে আগমনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে রাজন! অর্জ্জুন সৌভাগ্যক্রমে সমরাঙ্গনে সূতপুত্রের হস্তে পরিত্রাণ পাইয়াছে। মহাবীর কর্ণ ধনঞ্জয়ের নিধনকামনায় বাসবদত্ত শক্তি রক্ষা করিয়াছিল। ভাগ্যক্রমে ধনঞ্জয় কর্ণের সহিত দ্বৈরথযুদ্ধে প্রবৃত্ত হয় নাই। অর্জ্জুন কর্ণের সহিত সমরে প্রবৃত্ত হইলে অবশ্যই ঐ বীরদ্বয় পরস্পরের প্রতি দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ করিতেন। অর্জ্জুনের অস্ত্রে কর্ণের অস্ত্র ছিন্ন হইলে সূতপুত্র নিশ্চয়ই তাঁহার উপর বাসবদত্ত শক্তি নিক্ষেপ করিতেন। তাহা হইলে তোমার নিদারুণ ব্যসন উপস্থিত হইত। ভাগ্যক্রমে সূতপুত্র তাহা না করিয়া সেই শক্তিদ্বারা ঘটোৎকচকে বিনাশ করিয়াছে। হে ভরতবংশাবতংস! দৈবই তোমার মঙ্গলের নিমিত্ত রাক্ষসকে নিহত করিয়াছে; পুরন্দরপ্রদত্ত শক্তি কেবল নিমিত্তমাত্র। অতএব তুমি এক্ষণে ক্রোধ ও শোক সংবরণ কর। জীবমাত্রেরই সংহার আছে। এক্ষণে তুমি ভ্রাতৃগণ ও মহাত্মা নরপতিগণসমভিব্যাহারে কৌরবগণের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও। আজ হইতে পঞ্চমদিবসে বসুন্ধরা তোমার হস্তগত হইবে। তুমি নিরন্তর ধর্ম্মানুষ্ঠানে তৎপর হও; পরম প্রীতমনে অনৃশংসতা, তপ, দান, ক্ষমা ও সত্যের অনুষ্ঠান কর। যে স্থানে ধর্ম্ম, সেই স্থানেই জয়।’ হে কুরুরাজ! মহর্ষি বেদব্যাস যুধিষ্ঠিরকে এই বলিয়া সেই স্থানেই অন্তর্হিত হইলেন।”

ঘটোৎকচবধপর্ব্বাধ্যায় সমাপ্ত