১৯২. দ্রোণাচার্য্যের আত্মজীবনে হতাশা

১৯২তম অধ্যায়

দ্রোণাচার্য্যের আত্মজীবনে হতাশা

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! ঐ সময় পাঞ্চালরাজকুমার ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণাচাৰ্য্যকে অতিশয় উদ্বিগ্ন ও শোকে বিচেতন প্রায় দেখিয়া তাঁহার প্রতি ধাবমান হইলেন। মহাত্মা দ্রুপদরাজ দ্রোণবিনাশার্থ মহাযজ্ঞে প্রজ্বলিত হুতাশন হইতে তাঁহাকে প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। মহাবীর দ্রুপদতনয়, দ্ৰোণজিঘাংসু হইয়া সুদৃঢ় মৌৰ্ব্বীসম্পন্ন, জলদগভীরনিঃস্বন, জয়শীল, দিব্যশরাসন গ্রহণপূর্ব্বক তাহাতে প্রদীপ্ত অনলের ন্যায় ও আশীবিষের ন্যায় শর সংযোজন করিলেন। সেই ধৃষ্টদ্যুম্নের শরাসনমণ্ডলস্থ শর শরৎকালীন পরিবেষমধ্যস্থ দিবাকরের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। সৈনিকগণ সেই প্রজ্বলিত শরাসন ধৃষ্টদ্যুম্নকর্ত্তৃক আকৃষ্ট দেখিয়া অন্তকাল উপস্থিত হইয়াছে বলিয়া বোধ করিল। ঐ সময় প্রতাপশালী ভারদ্বাজও দ্রুপদপুত্রের শরসন্ধান সন্দর্শনপূর্ব্বক আপনার আসন্নকাল সমাগত বলিয়া বোধ করিতে লাগিলেন। তিনি ধৃষ্টদ্যুম্নকে নিবারণ করিতে বিশেষরূপে যত্ন করিলেন, কিন্তু তাঁহার অস্ত্রজাল আর প্রাদুর্ভুত হইল না। ঐ বীরপুরুষ চারিদিন ও একরাত্রি ক্রমাগত বাণবর্ষণ করিয়াছিলেন, তথাপি তাঁহার শরক্ষয় হয় নাই। এক্ষণে ঐ পঞ্চম দিবসের তৃতীয়াংশ অতীত হইলে তাঁহার শরনিকর নিঃশেষিত হইল।

“তখন তেজঃপুঞ্জশরীর দ্রোণাচার্য্য পুত্রশোক ও দিব্যাস্ত্রসমুদয়ের অবসন্নতাবশতঃ নিতান্ত বিমনায়মান হইয়া বিপ্রগণের বাক্যপ্রতিপালনার্থ অস্ত্র পরিত্যাগ করিবার বাসনায় আর পূর্ব্বের ন্যায় যুদ্ধ করিলেন না। কিয়ৎক্ষণ পরে তিনি মহর্ষি অঙ্গিরার প্রদত্ত দিব্যশরাসন গ্রহণপূর্ব্বক ধৃষ্টদ্যুম্নের প্রতি ব্ৰহ্মদণ্ডসদৃশ শরনিকর পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। দ্রুপদনন্দন তাঁহার শরবর্ষণে সমাচ্ছন্ন ও ক্ষতবিক্ষত হইলেন। তখন ভারদ্বাজ পুনরায় নিশিতশরনিকর বর্ষণ করিয়া দ্রুপদতনয়ের শরাসন, ধ্বজ ও শরসমুদয় শতধা ছেদনপূর্ব্বক সারথিকে নিপাতিত করিলেন। মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন তদ্দর্শনে সহাস্যমুখে পুনরায় অন্য শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক নিশিতশরদ্বারা তাঁহার বক্ষঃস্থল বিদ্ধ করিলেন। মহাধনুৰ্ধর দ্রোণ দ্রুপদতনয়ের শরে বিদ্ধ ও সম্ভ্রন্ত হইয়া শিতধারভল্লদ্বারা পুনরায় তাঁহার শরাসন ছেদন করিয়া ফেলিলেন এবং তৎপরে তাঁহার গদা ও খড়্গ ব্যতীত অন্য সমুদয় অস্ত্রশস্ত্র এবং শরাসন ছেদন করিয়া তাঁহাকে সুতীক্ষ্ণ নয়বাণে বিদ্ধ করিলেন।

দ্রোণ পরাভবে ধৃষ্টদ্যুম্নের কৌশল

“অনন্তর মহারথ ধৃষ্টদ্যুম্ন ব্রাহ্ম-অস্ত্র মন্ত্রপূত করিয়া স্বীয় অশ্বগণের সহিত দ্রোণের অশ্বগণকে মিশ্রিত করিয়া দিলেন। দ্রোণের বায়ুবেগগামী পারাবতসবর্ণ অশ্বসকল ধৃষ্টদ্যুম্নের শোণবর্ণ অশ্বের সহিত মিলিত হইয়া বিদ্যুদ্দামমণ্ডিত গভীর গর্জ্জনশীল জলপটলের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। তখন মহাবীর দ্রোণ ধৃষ্টদ্যুম্নের ঈষাবন্ধ, চক্রবন্ধ ও রথবন্ধ ছেদন করিয়া ফেলিলেন। এইরূপে ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণশরে ছিন্নকার্মুক, বিরথ, হতাশ্ব ও হতসারথি হইয়া সেই ঘোরতর বিপদ্‌কালে তাঁহার উপর এক গদা নিক্ষেপ করিলেন। দ্রোণাচাৰ্য্য তদ্দর্শনে ক্রোধাবিষ্ট হইয়া নিশিতশরনিকরে সেই ধৃষ্টদ্যুম্ননিক্ষিপ্ত গদা খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন স্বীয় গদা নিষ্ফল দেখিয়া দ্রোণকে বধ করাই শ্রেয়ঃকল্প বিবেচনা করিলেন এবং বিমল খড়্গ ও অতি ভাস্বর চর্ম্ম গ্রহণপূর্ব্বক আপনার রথেষা অবলম্বন করিয়া দ্রোণের রথে গমনপূর্ব্বক তাঁহার বক্ষঃস্থল বিদীর্ণ করিতে অভিলাষ করিলেন। তৎকালে তিনি কখন যুগমধ্যে, কখন যুগসন্নহনে ও কখন বা শোণবর্ণ অশ্বসমুদয়ের নিতম্বদেশে অবস্থান করিতে লাগিলেন। সৈন্যগণ তদ্দর্শনে তাঁহার ভূয়সী প্রশংসা করিতে আরম্ভ করিল। তৎকালে দ্রোণাচার্য্য কোনক্রমেই তাঁহাকে প্রহার করিবার উপযুক্ত অবসর প্রাপ্ত হইলেন না। তদ্দর্শনে সকলেই বিস্ময়াবিষ্ট হইল। আমিষলোলুপ গৃধ্রুদ্বয়ের যেরূপ যুদ্ধ হইয়া থাকে, দ্রোণ ও ধৃষ্টদ্যুম্নের তদ্রূপ যুদ্ধ হইতে লাগিল।

“অনন্তর মহাবীর দ্রোণ ক্রোধাবিষ্ট হইয়া রথশক্তিদ্বারা ধৃষ্টদ্যুম্নের পারাবতসবর্ণ অশ্বগণকে ক্রমে ক্রমে বিনাশ করিলেন। এইরূপে ধৃষ্টদ্যুম্নের অশ্বগণ নিহত ও নিপতিত হইলে দ্রোণাচার্য্যের শোণবর্ণ অশ্বসমুদয় রথবন্ধ হইতে বিমুক্ত হইল। ধৃষ্টদ্যুম্ন তদ্দর্শনে একান্ত অধীর হইয়া খড়্গগ্রহণপূর্ব্বক রথ পরিত্যাগ করিয়া পতগরাজ গরুড় যেমন ভুজঙ্গের প্রতি ধাবমান হয়, তদ্রূপ দ্রোণের প্রতি ধাবমান হইলেন। পূর্ব্বে হিরণ্যকশিপুর সংহারকালে বিষ্ণু যেরূপ বিগ্রহ [শরীর] পরিগ্রহ করিয়াছিলেন, এক্ষণে দ্রোণসংহারে প্রবৃত্ত ধৃষ্টদ্যুম্নেরও সেইরূপ আকার হইয়া উঠিল। তখন তিনি খড়্গ ও চর্ম্ম ধারণ করিয়া ভ্রান্ত, উদভ্রান্ত, আবিদ্ধ, আপ্লুত, প্রসূত, সৃত, পরিবৃত, নিবৃত্ত, সম্পাত, সমুদ্দীৰ্ণ, ভারত, কৈশিক ও সাত্যত প্রভৃতি একবিংশতি প্রকার গতি প্রদর্শনপূর্ব্বক দ্রোণকে বিনাশ করিবার বাসনায় সমরে বিচরণ করিতে লাগিলেন। তখন সমুদয় যোদ্ধা ও সমাগত দেবগণ ধৃষ্টদ্যুম্নের সেই বিচিত্র গতিসন্দর্শনে একান্ত বিস্ময়াপন্ন হইলেন। দ্রোণাচার্য্য ঐ সময় সহস্ৰশরদ্বারা ধৃষ্টদ্যুম্নের খড়্গ ও শতচন্দ্রবিভূষিত চর্ম্ম ছেদন করিয়া ফেলিলেন। দ্রোণাচার্য্য এক্ষণে যেসকল বাণ লইয়া যুদ্ধ করিতেছিলেন, তৎসমুদয় বিতস্তিপ্রমাণ। সমীপবর্তী বিপক্ষের সহিত সংগ্রাম করিবার সময় ঐ সকল শরের বিশেষ আবশ্যক হয়। ঐরূপ বাণ কেবল দ্রোণ, কৃপ, অর্জ্জুন, কর্ণ, প্রদ্যুম্ন ও যুযুধান ভিন্ন আর কাহারও নাই; অর্জ্জুনতনয় মহাবীর অভিমন্যুরও ঐরূপ শরসমুদয় ছিল। হে মহারাজ! অনন্তর দ্রোণাচাৰ্য্য মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্নের বিনাশার্থ এক বেগবান্ বিতস্তি প্রমাণ সুদৃঢ় শর পরিত্যাগ করিলেন। তখন শিনিপুঙ্গব সাত্যকি নিশিতদশশরে সেই শরাসন ছেদন করিয়া মহাত্মা দুর্য্যোধন ও কর্ণের সমক্ষে ধৃষ্টদ্যুম্নকে আচার্য্যের হস্ত হইতে মুক্ত করিলেন। মহাত্মা কৃষ্ণ ও অর্জ্জুন সত্যবিক্রম সাত্যকিকে দ্রোণ ও কৃপের সমীপে অবস্থানপুর্ব্বক রথমার্গে বিচরণ ও যোধগণের দিব্যাস্ত্রসকল ধ্বংস করিতে দেখিয়া তাঁহাকে ভূয়োভূয়ঃ সাধুবাদ প্রদান করিতে লাগিলেন। অনন্তর অর্জ্জুন কৃষ্ণসমভিব্যাহারে সৈম্যগণের অভিমুখে ধাবমান হইয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে কেশব! ঐ দেখ, শত্রুনাশন সাত্যকি দ্রোণাচার্য্যপ্রমুখ মহারথগণের সমক্ষে শিক্ষা প্রদর্শনপূর্ব্বক বিচরণ করিয়া আমাকে ও আমার ভ্রাতৃগণকে আনন্দিত করিতেছে। সমুদয় সিদ্ধ ও সৈনিকগণ বিস্ময়াপন্ন হইয়া বৃষ্ণিকুলের কীৰ্ত্তিবৰ্ধন যুযুধানকে প্রশংসা করিতেছে।’ হে মহারাজ! অনন্তর উভয়পক্ষীয় যোধগণ সমরে অপরাজিত সাত্যকির অলোকসামান্য কার্য্য দর্শন করিয়া তাঁহাকে বারংবার সাধুবাদ প্রদান করিতে লাগিলেন।”