১৮২. জরাসন্ধাদির বিনাশকৌশলপ্রকাশ

১৮২তম অধ্যায়

জরাসন্ধাদির বিনাশকৌশলপ্রকাশ

“অর্জ্জুন কহিলেন, ‘হে কৃষ্ণ! তুমি আমাদিগের হিতসাধনের নিমিত্ত কিরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া জরাসন্ধপ্রমুখ ভূপালগণকে নিপাতিত করিলে, তাহা কীৰ্ত্তন কর।’

“বাসুদেব কহিলেন, ‘হে অর্জ্জুন! মহাবলপরাক্রান্ত জরাসন্ধ, চেদিরাজ ও নিষাদরাজ পূর্ব্বে নিহত না হইলে এক্ষণে নিতান্ত ভয়ঙ্কর হইয়া উঠিত। সেই মহারথগণ জীবিত থাকিলে দুৰ্য্যোধন অবশ্যই তাহাদিগকে সমরকার্য্যে বরণ করিত। সেই সমুদয় অমরোপম কৃতার্থ যুদ্ধদুর্ম্মদ মহাবীর আমাদের চিরবিদ্বেষ্টা ছিল; তাহারা অবশ্যই কৌরবপক্ষ অবলম্বনপূর্ব্বক দুৰ্য্যোধনকে রক্ষা করিত। সূতপুত্র, জরাসন্ধ, চেদিরাজ ও নিষাদরাজ—ইহারা সমবেত হইয়া দুৰ্য্যোধনকে আশ্রয় করিলে, এই সমুদয় পৃথিবীও পরাজয় করিতে সমর্থ হইত। হে পার্থ! আমি যেরূপ উপায় করিয়া তাহাদিগকে বিনাশ করিয়াছি, তাহা শ্রবণ কর। উপায় ব্যতীত সুরগণও তাহাদিগকে পরাজিত করিতে সমর্থ নহেন। তাহারা প্রত্যেকে সমরে লোকপালরক্ষিত সমস্ত দেবসেনার সহিত সংগ্রাম করিতে সমর্থ ছিল। জরাসন্ধ বলদেবকর্ত্তৃক তাড়িত হইয়া ক্রোধভরে আমাদিগের বিনাশার্থ এক পাবকতুল্য প্রভাসম্পন্ন, সর্ব্বসংহারক্ষম, অশনিসদৃশ গদা ক্ষেপণ করিয়াছিল। জরাসন্ধনির্মুক্ত গদা আকাশমণ্ডল সীমন্তিত করিয়াই যেন আমাদের প্রতি ধাবমান হইল। মহাবীর বলদেব সেই গদা দর্শন করিয়া তাহার প্রতিঘাতার্থ স্থূণাকর্ণনামক অস্ত্র পরিত্যাগ করিলেন। গদা বলদেবের অস্ত্রে প্রতিহত হইয়া ভূতলে পতিত হওয়াতে বোধ হইল যেন, অবনী বিদীর্ণ ও ভূধরসকল কম্পিত হইয়া উঠিল। হে ধনঞ্জয়! মহাবীর জরাসন্ধ দুই মাতার গর্ভে জন্মগ্রহণ করে; উহার মাতৃদ্বয় উহার কলেবরে এক এক অর্দ্ধ প্রসব করিয়াছিল। জরানামে এক রাক্ষসী উহার সেই অর্দ্ধ কলেবরদ্বয় যযাজিত করে। এই নিমিত্তই ঐ বীর জরাসন্ধনামে বিখ্যাত হইয়াছিল। সেই নিশাচরী জরা সেই গদা ও স্থূণাকর্ণনামক অস্ত্রের আঘাতে পুত্র ও বান্ধবগণের সহিত হতজীবিত হইয়া ভূতলে পতিত হইল। হে ধনঞ্জয়! মহাবীর জরাসন্ধ এইরূপে গদাবিহীন হইয়াছিল বলিয়া মহাবীর ভীমসেন তোমার সমক্ষেই তাঁহাকে নিপাতিত করিয়াছেন। যদি সেই প্রবলপ্রতাপশালী জরাসন্ধ গদাহস্তে অবস্থান করিত, তাহা হইলে ইন্দ্রাদি দেবগণও তাহাকে বিনাশ করিতে অসমর্থ হইতেন।

‘হে ধনঞ্জয়! মহাত্মা দ্রোণাচাৰ্য্য তোমার হিতের নিমিত্তই ছদ্মবেশে আচাৰ্য্যত্ব প্রদর্শনপূর্ব্বক নিষাদরাজ একলব্যের অঙ্গুষ্ঠ ছেদন করিয়াছিলেন। অভিমানী দৃঢ়বিক্রমশালী নিষাদাধিপতি অঙ্গুলিত্রাণ ধারণপূর্ব্বক বনে বনে ভ্রমণ করিয়া দ্বিতীয় পরশুরামের ন্যায় শোভা পাইতেন। একলব্যের অঙ্গুষ্ঠ থাকিলে সমুদয় উরগ, রাক্ষস, দেব ও দানবগণও তাঁহাকে পরাজিত করিতে পারিতেন না, মনুষ্যগণও তাঁহাকে দর্শন করিতে অসমর্থ হইত; কিন্তু সেই দৃঢ়মুষ্টিসম্পন্ন, দিবারাত্র বাণনিক্ষেপসমর্থ, কৃতী নিষাদরাজ অঙ্গুষ্ঠবিহীন হইলে আমি তোমার হিতসাধনার্থ সমরে তাহাকে নিপাতিত করিয়াছি। হে পার্থ! আমি তোমার সমক্ষেই চেদিরাজকে সংহার করিয়াছি। ঐ বীরও সমরে সমস্ত সুরাসুরের অপরাজিত ছিল। আমি তোমার সাহায্যে চেদিরাজ ও অন্যান্য অসুরের বিনাশসাধন এবং অখিললোকের হিতবর্দ্ধনের নিমিত্তই জন্মগ্রহণ করিয়াছি। হে ধনঞ্জয়! ভীমসেন দশাননসদৃশ বলশালী, ব্রাহ্মণগণের যজ্ঞবিঘাতক, নিশাচর হিড়িম্ব, বক ও কির্মীরকে বিনাশ করিয়াছে। মহাবীর ঘটোৎকচ অলায়ুধকে নিপাতিত করিয়াছে। এক্ষণে উপায়প্রভাবে কর্ণের শক্তিদ্বারা ঘটোৎকচেরও প্রাণবিয়োগ হইল। যদি সূতপুত্র বাসবদত্ত শক্তিদ্বারা ঘটোৎকচকে নিহত না করিত, তাহা হইলে আমাকেই বৃকোদরের পুত্রকে বধ করিতে হইত। আমি কেবল তোমাদিগের মঙ্গলসাধনের নিমিত্তই পূর্ব্বে উহার জীবননাশ করি নাই। ঐ নিশাচর ব্রাহ্মণদ্বেষী, যজ্ঞনাশক, ধর্ম্মলোপ্তা ও পাপাত্ম; এই নিমিত্তই, কৌশলক্রমে নিপাতিত হইল। ঐ রাক্ষসের বিনাশে কর্ণের ইন্দ্রদত্তশক্তিও নিঃশেষিত হইয়াছে। হে অর্জ্জুন! আমি ধর্ম্মসংস্থাপনের নিমিত্ত এই দৃঢ়তর প্রতিজ্ঞা করিয়াছি যে, যাহারা ধৰ্মনাশক, তাহাদিগকে অবশ্যই সংহার করিব। আমি শপথ করিয়া কহিতেছি, যে স্থানে ব্রহ্ম, সত্য, দম, শৌচ, ধর্ম্ম, শ্ৰী, লজ্জা, ক্ষমা ও ধৈৰ্য্য অবস্থান করে, আমি সেই স্থানেই সর্ব্বদা বর্ত্তমান থাকি। হে পার্থ! তুমি কর্ণসংহারের নিমিত্ত চিন্তা করিও না। আমি তোমাকে এরূপ উপদেশ প্রদান করিব যে, তুমি তদনুসারে কাৰ্য্য করিলে অবশ্য তাহাকে বিনাশ করিতে পারিবে। মহাবীর বৃকোদর যেরূপ সমরে দুৰ্য্যোধনকে নিপাতিত করিবেন, আমি তাহারও উপায় করিয়া দিব। যাহা হউক, এক্ষণে শত্রুসৈন্যগণ তুমুল শব্দ করিতেছে; তোমার সেনাগণও দশদিকে পলায়ন করিতে আরম্ভ করিয়াছে, লব্ধলক্ষ্য কৌরবগণ ও সংগ্রামবিশারদ দ্রোণাচাৰ্য্য অস্মৎপক্ষীয় সেনাসংহারে প্রবৃত্ত হইয়াছেন।”