১৯৪. নারায়ণাস্ত্রমোক্ষপর্ব্বাধ্যায়—কৌরবপলায়ন

১৯৪তম অধ্যায়

নারায়ণাস্ত্রমোক্ষপর্ব্বাধ্যায়—কৌরবপলায়ন

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! এইরূপে মহাবীর দ্রোণ নিহত ও বহুসংখ্যক বীর নিপাতিত হইলে কৌরবগণ শস্ত্রনিপীড়িত ও শোকে একান্ত কাতর হইলেন এবং শত্রুগণের অভ্যুদয়দর্শনে দীনবদন ও অপূর্ণ লোচন হইয়া বারংবার বিকম্পিত হইতে লাগিলেন। তাঁহাদিগের চেতনা ও উৎসাহ বিনষ্ট হইয়া গেল এবং মোহাবেশপ্রভাবে তেজও প্রতিহত হইল। তখন তাহারা হিরণ্যাক্ষ বিনাশকাতর দৈত্যগণের ন্যায় ধূলিধূসরিতকলেবর হইয়া অশ্রুকণ্ঠে আর্ত্তস্বর পরিত্যাগপূর্ব্বক দশ দিক্‌ নিরীক্ষণ করিয়া আপনার আত্মজ দুৰ্য্যোধনকে পরিবেষ্টিত করিলেন। রাজা দুর্য্যোধন ক্ষুদ্র মৃগসমূহের ন্যায় নিতান্ত ভীত সেই কৌরবগণকর্ত্তৃক পরিবৃত হইয়া আর তথায় অবস্থান করিতে সমর্থ হইলেন না। তিনি সমর পরিত্যাগপূর্ব্বক পলায়নে সমুদ্যত হইলে আপনার পক্ষীয় যোধগণ দিবাকরের করজালে সাতিশয় সন্তপ্ত হইয়া যেন ক্ষুৎপিপাসায় একান্ত কাতর ও নিতান্ত বিমনায়মান হইলেন। কৌরবগণ সুৰ্য্যের পতনের ন্যায়, সমুদ্রশোষণের ন্যায়, সুমেরুপরিবর্ত্তনের ন্যায় ও দেবরাজ ইন্দ্রের পরাজয়ের ন্যায় দ্রোণাচার্য্যের নিধন নিরীক্ষণ করিয়া ভীতমুখে পলায়ন করিতে লাগিলেন। গান্ধাররাজ শকুনি ভয়বিহুল রথীগণের সহিত এবং সূতপুত্র কর্ণ পলায়মান সেনাগণের সহিত ভীত হইয়া মহাবেগে প্রস্থান করিতে আরম্ভ করিলেন। মদ্ররাজ শল্য রথ, অশ্ব ও মাতঙ্গকুল সঙ্কুল বহুল সৈন্যসমভিব্যাহারে ভয়ে চতুর্দ্দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া পলায়ন করিতে লাগিলেন। কৃপাচার্য্য হতভূয়িষ্ঠ হস্তী ও পদাতিগণে পরিবৃত হইয়া বারংবার ‘কি কষ্ট! কি কষ্ট!’ বলিতে বলিতে রণস্থল পরিত্যাগপূর্ব্বক গমন করিলেন। মহাবীর কৃতবর্ম্মা বহুসংখ্যক বেগগামী অশ্ব এবং হতাবশিষ্ট কলিঙ্গ, অরট্ট, বাত্নীক ও ভোজসৈন্যদিগের সহিত, মহাবীর উলুক পদাতিগণের সহিত এবং মহাবলপরাক্রান্ত প্রিয়দর্শন দুঃশাসন গজসৈন্যের সহিত সাতিশয় উদ্বিগ্ন হইয়া ধাবমান হইলেন। বৃষসেন অযুত রথ ও তিনসহস্র হস্তী, মহারাজ দুর্য্যোধন অসংখ্য গজ, অশ্ব ও পদাতি এবং সুশর্ম্মা হতাবশিষ্ট সংশপ্তকগণকে লইয়া অনতিবিলম্বে প্রস্থান করিলেন।

“হে মহারাজ! এইরূপে সকলেই দ্রোণাচাৰ্য্যকে নিহত নিরীক্ষণ করিয়া হস্তী, অশ্ব ও রথে আরোহণপূর্ব্বক চতুর্দ্দিকে ধাবমান হইলেন। কৌরবগণমধ্যে কেহ কেহ পিতা, কেহ কেহ ভ্রাতা ও মাতুল, কেহ কেহ পুত্র ও বয়স্য, কেহ কেহ সম্বন্ধী এবং কেহ কেহ সৈন্যগণ ও স্বস্রীয়গণকে পলায়নে ত্বরান্বিত করিয়া মহাবেগে গমন করিতে লাগিলেন। উহাদের কেশকলাপ বিকীর্ণ এবং তেজ ও উৎসাহ এককালে বিনষ্ট হইয়া গেল। উহারা, কৌরবসৈন্য নিঃশেষিত হইয়াছে বিবেচনা করিয়া নিতান্ত ভীত হইয়া দুইজনে একদিকে গমন করিতে সমর্থ হইলেন না। কতকগুলি বীর কবচপরিত্যাগপূর্ব্বক দ্রুতপদসঞ্চারে গমন করিতে লাগিলেন। সৈনিকপুরুষেরা পরস্পরকে গমনে নিষেধ করিল; কিন্তু কেহই রণস্থলে অবস্থান করিতে সমর্থ হইল না। যোধগণ সুসজ্জিত রথসকল পরিত্যাগ করিয়া অবিলম্বে অশ্বে আরোহণ ও পদদ্বারা সঞ্চালন করিতে লাগিলেন।

অশ্বত্থামার অভিযান

এইরূপে সৈন্যগণ ভীতমনে ধাবমান হইলে একমাত্র দ্রোণাত্মজ অশ্বত্থামা স্রোতের প্রতিকুলগামী গ্রাহের ন্যায় শত্রুগণের প্রতি ধাবমান হইলেন। তখন প্রভদ্রক, পাঞ্চাল, চেদি ও কেকয়গণ এবং শিখণ্ডীপ্রমুখ বীরবর্গের সহিত তাঁহার ঘোরতর যুদ্ধ উপস্থিত হইল। তিনি পাণ্ডবগণের বহুবিধ সেনা বিনষ্ট করিয়া অতিকষ্টে সেই সঙ্কট হইতে বিমুক্ত হইলেন। তৎপরে তিনি সৈন্যগণকে পলায়ন করিতে দেখিয়া রাজা দুৰ্য্যোধনসন্নিধানে গমনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে মহারাজ। এই সমস্ত সৈন্য কি নিমিত্ত ভীতমনে ধাবমান হইতেছ? তুমিই বা কেন ইহাদিগকে নিবারণ করিতেছ না? আর আমিও তোমাকে পূর্ব্ববৎ প্রকৃতিস্থ দেখিতেছি না। এক্ষণে বল, কি নিমিত্ত তোমার সৈন্যগণ এইরূপ অবস্থাপন্ন হইয়াছে? কর্ণপ্রমুখ মহারথগণ আর যুদ্ধে অবস্থান করিতেছেন না। সৈন্যগণ অন্য কোন সংগ্রামে এইরূপ ধাবমান হয় নাই, এক্ষণে তোমার সৈন্যগণের কি কোন অনিষ্টঘটনা হইয়াছে?’

‘অনন্তর রাজা দুর্য্যোধন দ্রোণপুত্রের বাক্য শ্রবণ করিয়া তাঁহাকে তাঁহার পিতৃবিনাশরূপ ঘোরতর অপ্রিয় সংবাদ প্রদান করিতে সমর্থ হইলেন না। তিনি রথারূঢ় অশ্বত্থামাকে নিরীক্ষণপূর্ব্বক বাষ্পকুল লোচনে ভগ্ননৌকার ন্যায় শোকসাগরে নিমগ্ন হইয়া লজ্জাবনতমুখে কৃপাচাৰ্য্যকে কহিলেন, ‘হে শারদ্বত! সৈন্যগণ যে নিমিত্ত ধাবমান হইতেছে, তুমিই অগ্রে তাহা গুরুপুত্রকে বিজ্ঞাপিত কর। তখন কৃপাচার্য্য অপ্রিয় সংবাদ প্রদান করিতে হইবে বলিয়া বারংবার সাতিশয় দুঃখ অনুভবপূর্ব্বক পরিশেষে অশ্বত্থামার সমক্ষে দ্রোণাচার্য্যের নিধনবৃত্তান্ত কীৰ্ত্তন করিতে সমুদ্যত হইয়া কহিতে লাগিলেন।

অশ্বত্থামার নিকট পিতৃবধবৃত্তান্তজ্ঞাপন

“হে আচাৰ্য্যতনয়! আমরা অদ্বিতীয় রথী মহাবীর দ্রোণকে অগ্রসর করিয়া কেবল পাঞ্চালগণের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম। ঐ সময় কৌরব ও সোমকগণ মিলিত হইয়া পরস্পরের প্রতি তর্জ্জনগর্জ্জনপূর্ব্বক পরস্পরকে বিনাশ করিতে লাগিলেন। তখন তোমার পিতা কৌরবপক্ষীয় বহুসংখ্যক সৈন্যের নিধনদর্শনে ক্রোধাবিষ্ট হইয়া ব্রাহ্ম-অস্ত্র আবিষ্কৃত করিয়া ভল্লাস্ত্রে বহুসংখ্যক সৈন্যের প্রাণসংহার করিলেন। পাঞ্চাল, কেকয়, মৎস্য ও পাণ্ডবসৈন্যগণ কালপ্রেরিত হইয়া দ্রোণসন্নিধানে আগমনপূর্ব্বক বিনষ্ট হইতে লাগিল। সেই পঞ্চাশীতিবর্ষবয়স্ক আকর্ণপলিত মহারথ দ্রোণ ব্রহ্মাস্ত্রপ্রভাবে সহস্র মনুষ্য ও দ্বিসহস্র হস্তী বিনাশ করিয়া বৃদ্ধাবস্থাতেও যোড়শবর্ষীয়ের ন্যায় রণস্থলে পরিভ্রমণ করিতে লাগিলেন। এইরূপে বিপক্ষ সৈন্যগণ একান্ত ক্লিষ্ট ও ভূপালগণ বিনষ্ট হইলে পাঞ্চালেরা নিতান্ত ক্রোধাবিষ্ট ও সমরে পরাঙ্মুখ হইল। তখন অরাতিনিপাতন দ্রোণাচার্য্য দিব্যাস্ত্র বিস্তারপূর্ব্বক পাণ্ডবদিগের মধ্যে মধ্যাহ্নকালীন প্রচণ্ড মাৰ্ত্তণ্ডের ন্যায় নিতান্ত দুর্নিরীক্ষা হইয়া উঠিলেন। পাঞ্চালগণ দ্রোণশরে একান্ত সন্তপ্ত, হতবীৰ্য্য ও উৎসাহশূন্য হইয়া বিচেতন হইয়া রহিল।

“বিজয়াভিলাষী বাসুদেব তদ্দর্শনে পাণ্ডবগণকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে পাণ্ডবগণ! অন্যের কথা দুরে থাকুক, সাক্ষাৎ দেবরাজ ইন্দ্রও দ্রোণাচাৰ্য্যকে পরাজিত করিতে সমর্থ নহেন। অতএব তোমরা ধর্ম্মপরিত্যাগপূর্ব্বক বিজয়লাভ কর। দ্রোণাচাৰ্য্য যেন তোমাদিগকে সমূলে উন্মলন করিতে সমর্থ হয়েন। আমার বোধ হইতেছে, ইনি অশ্বত্থামা বিনষ্ট হইয়াছেন জানিতে পারিলে আর যুদ্ধ করিবেন না। অতএব কোন ব্যক্তি মিথ্যাবাক্য প্রয়োগপূর্ব্বক অশ্বত্থামা নিহত হইয়াছে, এই কথা আচার্য্যের কর্ণগোচর করুক।’ হে দ্রোণনন্দন! মহাত্মা ধনঞ্জয় কৃষ্ণের বাক্য শ্রবণানন্তর কোনক্রমেই তাহাতে অনুমোদন করিলেন না। অন্যান্য ব্যক্তিগণ উহাতে সম্মত হইলেন। ধর্ম্মপুত্র যুধিষ্ঠির অতিকষ্টে কৃষ্ণের বাক্যে অঙ্গীকার করিলেন। অনন্তর ভীমসেন লজ্জাবনতবদনে দ্রোণসন্নিধানে সমুপস্থিত হইয়া তাঁহাকে তোমার মিথ্যানিধনবৃত্তান্ত কহিল; কিন্তু তোমার পিতা তাঁহার বাক্য মিথ্যা জ্ঞান করিয়া ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে উহা সত্য কি মিথ্যা জিজ্ঞাসা করিলেন। তখন ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির বিজয়বাসনা ও মিথ্যাভয়ে যুগপৎ অভিভূত হইলেন। তিনি পরিশেষে মালবরাজ ইন্দ্রবর্ম্মার এক অচলসদৃশকলেবর অশ্বত্থামা নামে করিবারকে ভীমশরে নিহত দেখিয়া দ্রোণসন্নিধানে গমনপূর্ব্বক মুক্তকণ্ঠে কহিলেন, ‘হে আচাৰ্য্য! আপনি যাঁহার নিমিত্ত অস্ত্রধারণ করিতেছেন এবং যাঁহার মুখাবলোকনপূর্ব্বক জীবিত রহিয়াছেন, আপনার সেই প্রিয়তম পুত্র অশ্বত্থামা নিহত হইয়া অরণ্যশায়ী সিংহশিশুর ন্যায় ভূমিশয্যায় শয়ান রহিয়াছেন। হে আচাৰ্য্যকুমার! ধর্ম্মরাজ মিথ্যাবাক্যের দোষ সম্যক অবগত ছিলেন, এই নিমিত্ত তিনি মুক্তকণ্ঠে অশ্বত্থামা নিহত হইয়াছে বলিয়া অস্পষ্টাক্ষরে কুঞ্জর শব্দ উচ্চারণ করিলেন। তখন তোমার পিতা তোমাকে সংগ্রামে নিহত অবধারণ করিয়া শোকসন্তপ্তমনে দিব্যাসমুদয় উপসংহার করিয়া আর পূর্ব্ববৎ সংগ্রাম করিলেন না। ঐ সময় নিতান্ত ক্রূরকর্ম্মা ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁহাকে একান্ত উদ্বিগ্ন ও শোকসন্তাপে অভিভূত দেখিয়া তাঁহার প্রতি ধাবমান হইলেন। লোকতত্ত্ববিশারদ মহাবীর দ্রোণ তাঁহাকে আপনার মৃত্যুস্বরূপ অবলোকন করিয়া দিব্যাস্ত্র পরিত্যাগপূর্ব্বক প্রায়োপবেশন করিলেন। তখন ধৃষ্টদ্যুম্ন বামহস্তে তাঁহার কেশ গ্রহণ করিয়া শিরচ্ছেদনে সমুদ্যত হইলেন। তদ্দর্শনে সকলেই চতুর্দ্দিক হইতে ‘সংহার করিও না, সংহার করিও না’ বলিয়া দ্রুপদতনয়কে নিবারণ করিতে লাগিল। মহাবীর অর্জ্জুনও সত্বর রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া বাহুদ্বয় উদ্যত করিয়া ‘হে ধৃষ্টদ্যুম্ন! তুমি আচাৰ্য্যকে বধ করিও না, উহাকে জীবিতাবস্থায় আনয়ন কর, বারংবার এই কথা বলিয়া তাঁহার প্রতি ধাবমান হইলেন; কিন্তু নৃশংস ধৃষ্টদ্যুম্ন কৌরবগণ ও অর্জ্জুনের বাক্যে কর্ণপাত না করিয়া তোমার পিতার শিরচ্ছেদন করিল। হে বৎস! এই নিমিত্তই সৈন্যগণ নিতান্ত ভীত হইয়া ধাবমান হইতেছে এবং আমরাও এককালে উৎসাহশূন্য হইয়াছি।

“হে মহারাজ! এইরূপে মহাবীর অশ্বত্থামা পিতার নিধনবার্তা শ্রবণ করিয়া পাদাহত ভূজঙ্গের ন্যায় ও ইন্ধনসংযুক্ত বহ্নির ন্যায় রোষানলে প্রজ্বলিত হইয়া উঠিলেন এবং করে করনিষ্পেষণ ও দশনপীড়ন করিয়া আরক্তলোচন হইয়া ভুজঙ্গের ন্যায় দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন।”