১৮৭. দ্রোণকর্ত্তৃক বিরাট ও দ্রুপদসংহার

১৮৭তম অধ্যায়

দ্রোণকর্ত্তৃক বিরাট ও দ্রুপদসংহার

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! ত্রিযামার [রাত্রির] এক ভাগ মাত্র অবশিষ্ট রহিয়াছে, এমন সময়ে কৌরব ও পাণ্ডবগণ পুনরায় হৃষ্টচিত্তে যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে সূৰ্য্যসারথি অরুণ শশধরকে ক্ষীণকান্তি ও নভোমণ্ডল তাম্রবর্ণ করিয়া গগনে সমুদিত হইলেন। সূৰ্য্যমণ্ডল অরুণকিরণে অরুণিত হইয়া তপ্তকাঞ্চননির্মিত চক্রের ন্যায় পূর্ব্বদিকে বিরাজিত হইতে লাগিল। তখন কৌরব ও পাণ্ডবপক্ষীয় যোদ্ধৃগণ সকলে রথ, অশ্ব ও নরযানসকল পরিত্যাগপূর্ব্বক দিবাকরের অভিমুখীন হইয়া। সন্ধ্যোপাসনার জন্য করপুটে দণ্ডায়মান হইলেন।

“হে মহারাজ! অনন্তর কৌরবসৈন্যসকল দ্বিধাবিভক্ত হইলে দ্রোণাচার্য্য রাজা দুৰ্য্যোধনকে পুরোবৰ্ত্তী করিয়া সোমক, পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণের অভিমুখে ধাবমান হইলেন। বাসুদেব তদ্দর্শনে অর্জ্জুনকে কহিলেন, ‘হে সব্যসাচিন! তুমি কৌরবগণকে বামভাগে ও দ্রোণকে দক্ষিণভাগে রাখিয়া সময়ে প্রবৃত্ত হও। মহাবীর ধনঞ্জয় বাসুদেবের নির্দেশানুসারে দ্রোণ ও কর্ণের বামভাগে অবস্থান করিলেন। ঐ সময় অরাতিনিপাতন ভীমসেন হৃষীকেশের অভিপ্রায় অবগত হইয়া সমরাঙ্গনমধ্যবর্তী অর্জ্জুনকে কহিলেন, ‘হে ভ্রাতঃ! আমার বাক্য শ্রবণ কর। ক্ষত্রিয়কামিনীরা যে কার্য্যসাধনের নিমিত্ত পুত্র প্রসব করে, এক্ষণে সেই কাৰ্য্যসাধনের সময় উপস্থিত হইয়াছে। অতএব যদি তুমি এ সময় আপনার বলবীর্য্যানুরূপ কাৰ্য্যানুষ্ঠান না কর, তাহা হইলে নিশ্চয়ই তোমার নিতান্ত নৃশংসের কাৰ্য্য করা হইবে। এক্ষণে তুমি দ্রোণসৈন্যগণকে দক্ষিণভাগে রাখিয়া শত্রু সংহারপূর্ব্বক সত্য, শ্রী, ধর্ম্ম ও যশের আনুণ্য লাভ কর।

“হে মহারাজ! মহাবীর অর্জ্জুন কেশব ও ভীমসেনকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া দ্রোণ ও কর্ণকে অতিক্রমপূর্ব্বক চারিদিকে অরাতিসৈন্য নিবারণ করিতে লাগিলেন। কৌরবপক্ষীয় ক্ষত্রিয়গণ সেই বর্দ্ধমান অনলসদৃশ ক্ষত্ৰদাহন মহাবলপরাক্রান্ত অর্জ্জুনকে আক্রমণ করিয়া নিবারণ করিতে পারিলেন না। তখন দুৰ্য্যোধন, কর্ণ ও শকুনি শরনিকরদ্বারা ধনঞ্জয়কে সমাচ্ছন্ন করিতে লাগিলেন। সুবিখ্যাত অস্ত্রবেত্তা জিতেন্দ্রিয় অর্জ্জুন হস্তলাঘব প্রদর্শনপূর্ব্বক শরবর্ষণ করিয়া তাঁহাদিগের সমুদয় অস্ত্র নিবারণপূর্ব্বক সকলকে দশ দশ বাণে বিদ্ধ করিলেন। ঐ সময় ধূলিপটল সমুদ্ত, চতুর্দ্দিক হইতে শরজাল সমাগত, ঘোরতর অন্ধকার আবির্ভূত ও ভীষণ শব্দ সমুত্থিত হইতে লাগিল। তখন কি ভূমণ্ডল, কি দিঙ্মমণ্ডল, কি আকাশমণ্ডল কিছুই বোধগম্য হইল না। ধূলিপটলপ্রভাবে সকলেই অন্ধ প্রায় হইল। আমাদের উভয়পক্ষীয় যোদ্ধৃগণ পরস্পর কেহ কাহাকে অবগত হইতে সমর্থ হইল না। তখন ভূপালগণ কেবল স্ব স্ব নাম গ্রহণ করিয়া যুদ্ধ করিতে আরম্ভ করিলেন। রথবিহীন রথীগণ মিলিত হইয়া পরস্পরের কেশ, কবচ ও ভুজে সংলগ্ন হইতে লাগিলেন। রথীগণ অশ্বসারথিবর্জিত নিচেষ্ট ও ভয়ার্দ্দিত হইয়া কেবল জীবনরক্ষা করিয়া সংগ্রামে সমুপস্থিত হইলেন। অশ্ব ও অশ্বারোহিগণ গতজীবিত হইয়া পর্ব্বতাকারে নিহত গজসমূহ আলিঙ্গন করিয়া রহিল।

“অনন্তর মহাবীর দ্রোণাচার্য্য রণক্ষেত্রের মধ্যস্থল হইতে উত্তরদিক গমনপূর্ব্বক প্রজ্বলিত বিধূম পাবকের ন্যায় অবস্থান করিতে লাগিলেন। পাণ্ডবসেনাগণ তেজঃপ্রজ্বলিত দ্রোণাচাৰ্য্যকে সংগ্রামক্ষেত্রের মধ্যস্থল হইতে একান্তে গমন করিতে দেখিয়া ভীত, কম্পিত ও বিচলিত হইয়া উঠিল। দানবগণ যেমন বাসবকে পরাজিত করিতে সাহসী হয় না, তদ্রূপ তাহারা সেই অরাতিনিপাতন মদমত্ত মাতঙ্গসদৃশ দ্রোণকে পরাভূত করিব বলিয়া কোনক্রমেই সাহস করিতে পারিল না। তখন কেহ কেহ বা নিরুৎসাহ, কেহ কেহ কোপাবিষ্ট ও কেহ কেহ বা বিস্ময়াপন্ন হইল। ভূপালগণমধ্যে কেহ কেহ করদ্বারা করা.নিষ্পেষণ, কেহ কেহ ক্রোধভরে ওষ্ঠদংশন, কেহ কেহ আয়ুধনিক্ষেপ ও কেহ কেহ ব ভুজমর্দ্দন করিতে লাগিলেন। তখন অনেক অসাধারণ তেজঃসম্পন্ন বীরপুরুষ দ্রোণের প্রতি ধাবমান হইলেন। ঐ সময় পাঞ্চালগণ দ্রোণবাণে নিতান্ত নিপীড়িত ও বেদনায় একান্ত অভিভূত হইয়া দ্রুপদরাজকে আশ্রয় করিল।

“তখন মহারাজ দ্রুপদ ও বিরাট সেই সমরচারী দুর্জ্জর দ্রোণের প্রতি ধাবমান হইলেন। তদ্দর্শনে দ্রুপদের তিন পৌত্র ও চেদিগণ দ্রোণের অভিমুখে আগমন করিলেন। মহাবীর দ্রোণ তিন নিশিতশরে দ্রুপদপৌত্রয়ের প্রাণসংহার করিলে তাঁহারা ভূতলে নিপতিত হইলেন। তৎপরে মহারথ দ্রোণাচাৰ্য্য যুদ্ধে চেদি, কৈকয়, সৃঞ্জয় ও মৎস্যগণকে পরাজয় করিলেন। দ্রুপদ ও বিরাটরাজ তদ্দর্শনে ক্রোধভরে দ্রোণের উপর শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন। ক্ষত্রিয়মর্দ্দন দ্রোণ অনায়াসে তাঁহাদের বাণবর্ষণ নিরাকৃত করিয়া তাঁহাদিগকে শরনিকরে সমাচ্ছন্ন করিলেন। দ্রুপদ ও বিরাটভূপতি দ্রোণশরে সমাচ্ছন্ন হইয়া ক্রোধভরে তাঁহাকে শরজালে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর দ্রোণ ক্রোধাবিষ্ট হইয়া সুতীক্ষ্ণভল্লদ্বারা বিরাট ও দ্রুপদের কার্মুকদ্বয় খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত বিরাট তদ্দর্শনে নিতান্ত ক্রোধপরবশ হইয়া দ্রোণের বধসাধনার্থ দশ তোমর ও দশ শর নিক্ষেপ করিলেন। রণবিশারদ দ্রুপদও ক্রোধভরে দ্রোণের রথাভিমুখে এক সুবর্ণখচিত ভুজগেন্দ্রোপম ভীষণ লৌহময় শক্তি নিক্ষেপ করিলেন। মহাবীর দ্রোণ সুতীক্ষ্ণ ভল্ল প্রয়োগপূর্ব্বক সেই বিরাটনিক্ষিপ্ত দশ তোমর ও নিশিত সায়কদ্বারা দ্রুপদের সেই শক্তি ছেদন করিয়া সুশাণিতভল্লদ্বয়দ্বারা বিরাট ও দ্রুপদকে যমরাজের রাজধানীতে প্রেরণ করিলেন।

“মনস্বী ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণের অস্ত্রবলে বিরাট, দ্রুপদ ও বিরাটের তিন পৌত্র এবং কৈকেয়, চেদি, মৎস্য ও পাঞ্চালগণকে নিহত দেখিয়া ক্রোধ ও দুঃখভরে মহারথগণের মধ্যে শপথ করিয়া কহিলেন, অদ্য দ্রোণ যদি আমার হস্ত হইতে মুক্তিলাভ বা আমাকে পরাভব করেন, তাহা হইলে যেন আমার ইষ্টাপূৰ্ত্ত বিনষ্ট এবং আমি ব্ৰহ্মতেজ ও ক্ষত্রিয়তেজ হইতে পরিভ্রষ্ট হই। হে মহারাজ! মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন এইরূপ শপথ করিয়া সৈন্যগণসমভিব্যাহারে দ্রোণাভিমুখে ধাবমান হইলেন। তখন একদিকে পাঞ্চালগণ ও অন্যদিকে অর্জ্জুন অবস্থানপূর্ব্বক দ্রোণকে প্রহার করিতে আরম্ভ করিলেন। মহারাজ দুৰ্য্যোধন, কর্ণ ও শকুনি এবং দুর্য্যোধনের ভ্রাতৃগণ তদ্দর্শনে দ্রোণাচাৰ্য্যকে রক্ষা করিতে লাগিলেন।

ভীমের উত্তেজনায় সমবেত দ্রোণ-আক্রমণ

“এইরূপে দ্রোণাচার্য্য সেই সমস্ত মহাত্মাদিগের প্রযত্নে রক্ষিত হইলে পাঞ্চালগণ তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিতেও সমর্থ হইল না। তখন ভীমসেন ক্রোধাবিষ্ট হইয়া ধৃষ্টদ্যুম্নকে অতি কঠোরবাক্য প্রয়োগপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে ক্ষত্রিয়সত্তম! কোন ব্যক্তি ক্ষত্রিয়াভিমানী দ্রুপদের কুলে উৎপন্ন হইয়া সম্মুখস্থ শত্রুকে উপেক্ষা করিয়া থাকে? কোন্ পুরুষ পিতৃবধ ও পুত্রবধ সহ্য এবং ভূপালগণসমক্ষে শপথ করিয়া শত্রুর প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করে? ঐ দেয়, মহাবীর দ্রোণ স্বীয় তেজঃপ্রভাবে প্রজ্বলিত হুতাশনের ন্যায় অবস্থানপূর্ব্বক ক্ষত্রিয়গণকে দগ্ধ করিতেছেন। উনি কিয়ৎক্ষণ মধ্যেই সমগ্র পাণ্ডবসৈন্য বিনষ্ট করিবেন। অতএব আমি সংগ্রামার্থ দ্রোণসন্নিধানে চলিলাম। তোমরা এই স্থানে অবস্থান করিয়া আমার অদ্ভুত কার্য্য নিরীক্ষণ কর।

“মহাবীর বৃকোদর এই বলিয়া ক্রোধভরে দ্রোণসৈন্যমধ্যে প্রবেশ করিয়া আকর্ণপূর্ণ শরনিকরদ্বারা তাহাদিগকে বিদ্রাবিত করিতে লাগিলেন; মহারথ ধৃষ্টদ্যুম্নও সৈন্যমধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া দ্রোণের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলেন। তখন উভয়পক্ষে ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হইল। হে মহারাজ! সেই সূর্য্যোদয়কালে যেরূপ যুদ্ধ হইয়াছিল, আমি কদাচ তদ্রূপ যুদ্ধ দর্শন বা শ্রবণ করি নাই। ঐ সময় সৈনাসকল অতিশয় ব্যাকুল হইয়া উঠিল। রথসমূহ পরস্পর সংশ্লিষ্ট হইয়া অবস্থান করিতে লাগিল। প্রাণীগণ নিহত ও ইতস্ততঃ বিশীর্ণ হইল। কোন কোন ব্যক্তি একস্থান হইতে অন্যত্র গমন করিয়া বিপক্ষগণকর্ত্তৃক বিদ্ৰাবিত হইতে লাগিল। যাহারা সমপরাঙ্মুখ হইয়া প্রস্থান করিতেছিল, অরাতিগণ কেহ কেহ তাহাদের পৃষ্ঠভাগে, কেহ কেহ বা পার্শ্বদেশে প্রহার করিতে আরম্ভ করিল। এইরূপে অতি নিদারুণ সংগ্রাম আরম্ভ হইলে ক্ষণকাল মধ্যে ভগবান্ মরীচিমালী সমুদিত হইলেন।”