১৯৭. অশ্বত্থামার নারায়ণাস্ত্রপ্রয়োগ—যুধিষ্ঠিরত্রাস

১৯৭তম অধ্যায়

অশ্বত্থামার নারায়ণাস্ত্রপ্রয়োগ—যুধিষ্ঠিরত্রাস

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! এইরূপে সেই নারায়ণাস্ত্র প্রাদুর্ভূত হইলে বিনা মেঘে বজ্রাঘাত, বৃষ্টিপাত ও মহাবেগে বায়ুসঞ্চার হইতে লাগিল। ঐ সময়ে ধরাতল কম্পিত, সাগরসকল সংক্ষুব্ধ, নদীসকল বিপরীত দিকে প্রবাহিত, গিরিশৃঙ্গসমুদয় বিদীর্ণ, দিণ্ডল তিমিরাচ্ছন্ন, দিনকর মলিন, মাংসলোলুপ প্রাণীগণ প্রহৃষ্টচিত্ত, সমাগত দেব, দানব ও গন্ধর্ব্বগণ শঙ্কিত ও কুরঙ্গগণ পাণ্ডবগণের দক্ষিণপার্শ্ব দিয়া ধাবমান হইল। সকলেই সেই তুমুল কাণ্ড দর্শনে পরস্পরকে তাহার কারণ জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল এবং ভূপতিগণ অশ্বত্থামার সেই ভীষণাস্ত্র সন্দর্শনে ভীত ও ব্যথিত হইয়া উঠিলেন।”

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! শোকসন্তপ্ত দ্রোণনন্দন পিতৃবধ অসহ্য বোধ করিয়া সৈনিকগণকে নিবৰ্ত্তিত করিলে পাণ্ডবগণ কৌরবসৈন্যগণকে সমাগত দেখিয়া ধৃষ্টদ্যুম্নের রক্ষাৰ্থ কিরূপ পরামর্শ নির্ধারিত করিলেন, তাহা আমার নিকট কীৰ্ত্তন কর।”

সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ। যুধিষ্ঠির প্রথমতঃ আপনার দুৰ্য্যোধন প্রভৃতি পুত্রগণকে পলায়ন করিতে দেখিয়াছিলেন, কিন্তু এক্ষণে পুনরায় যুদ্ধ উপস্থিত হইয়াছে শুনিয়া অর্জ্জুনকে কহিলেন, ‘হে ধনঞ্জয়। দেবরাজ বজ্ৰধারণপূর্ব্বক যেরূপ বৃত্রাসুরের প্রাণসংহার করিয়াছিলেন, তদ্রূপ ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণকে নিপাতিত করিলে কৌরবগণ আত্মপরিত্রাণার্থ জয়াশা পরিত্যাগপূর্ব্বক পলায়ন করিয়াছিলেন। বিপক্ষপক্ষীয় কিয়ৎসংখ্যক ভূপতি বিচেতন হইয়া হতপাঞ্জি, হতসারথি, পতাকা, ধ্বজ ও ছত্রবিহীন, ভগ্নকূবর, ভগ্ননীড় রথে আরোহণ, কেহ কেহ ভীত হইয়া স্বয়ং পদাঘাতে রথা পরিচালন, কেহ কেহ ভয়াতুর হইয়া ভগ্নাক্ষ, ভগ্নযুগ ও ভগ্নচক্র রথে আরোহণ, কেহ কেহ অশ্বপৃষ্ঠে অৰ্দ্ধ, স্বলিত আসনে উপবেশনপূর্ব্বক পলায়ন করিয়াছিল। উহাদের মধ্যে অনেকে নারাচদ্বারা গজস্কন্ধের সহিত গ্রথিত হইয়া মাতঙ্গগণকর্ত্তৃক অপনীত, অনেকে অস্ত্র ও কবচবিহীন হইয়া বাহন হইতে ক্ষিতিতলে নিপতিত ও হস্তী, অশ্ব ও রথচক্ৰদ্বারা নিষ্পেষিত এবং অনেকে মোহবশতঃ পরস্পরকে অবগত না । হইয়া ‘হা ভ্রাতঃ! হা পুত্র।’ বলিয়া চীৎকার করিয়া ভয়ে পলায়নপর হইয়াছে, আর অনেকে দৃঢ় বিক্ষত পিতা, পুত্র, ভ্রাতা ও মিত্রদিগকে উত্তোলনপূর্ব্বক বৰ্মনির্ম্মক্ত করিয়া তাহাদের গাত্রে জলসেক করিয়াছে। ধনঞ্জয়! দ্রোণাচাৰ্য্য নিহত হইলে কৌরবসৈন্যগণ এইরূপ দুরবস্থাপন্ন হইয়াছিল, কিন্তু এক্ষণে প্রতিনিবৃত্ত হইতেছে। যদি তুমি তাহাদিগের আভ্যাগমনের [অভিমুখে আসার] কারণ পরিজ্ঞাত থাক, তবে আমার নিকট কীৰ্ত্তন কর। এক মিলিত তুরঙ্গের হ্রেষারব, মাতঙ্গের বৃংহিতধ্বনি ও রথনেমির গভীরনিঃস্বনে বারংবার তুমুলশব্দ সমুত্থিত হওয়াতে আমার সেনাগণ কম্পিত হইয়াছে; এক্ষণে যেরূপ ললামহর্ষণ তুমুলশব্দ শ্রবণগোচর হইতেছে, বোধ হয়, উহা দেবেন্দ্রসমবেত ত্রিভুবন গ্রাস করিতে পারে। বোধ হয় দ্রোণাচাৰ্য্য নিহত হওয়াতে সুররাজ বাসব কৌরবগণের হিতার্থে ভীষণ নিনাদ করিয়া সমরাঙ্গনে প্রত্যাগমন করিয়াছেন। মহারথগণ এই ভয়ঙ্কর শব্দ শ্রবণে রোমাঞ্চিতগাত্র ও নিতান্ত শঙ্কিত হইয়াছে। অতএব হে ধনঞ্জয়! এক্ষণে কোন্ মহারথ সুররাজের ন্যায় সমরে অবস্থানপূর্ব্বক সেই পলায়মান কৌরবগণকে যুদ্ধার্থ প্রতিনিবৃত্ত করিয়াছেন?

অশ্বত্থামার শৌবিষয়ে অর্জ্জুনের সখেদ উক্তি

“অর্জ্জুন কহিলেন, ‘হে মহারাজ। কৌরবগণ যাঁহার বলবীৰ্য্য আশ্রয় করিয়া ধৈৰ্য্যাবলম্বনপূর্ব্বক উগ্ৰকার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়া শঙ্খবাদন করিতেছেন এবং আপনি, দ্রোণাচাৰ্য্য ন্যস্তশস্ত্র হইয়া দেহত্যাগ করিলে কোন ব্যক্তি দুর্য্যোধনের সহায় হইয়া ভীষণ নিনাদ করিতেছে, এই মনে করিয়া যাঁহার প্রতি সংশয়ারূঢ় হইয়াছেন, সেই মত্তমাতঙ্গগামী কুরুকুলের অভয়প্রদ মহাত্মার বিবরণ কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। হে মহারাজ! যে বীর জন্মগ্রহণ করিলে দ্রোণাচাৰ্য্য ব্রাহ্মণগণকে সহস্র গোধন দান করিয়াছিলেন, যে বীর জাতমাত্র উচ্চৈঃশ্রবার ন্যায় হ্রেষারব পরিত্যাগ করিলে ত্রিলোক কম্পিত হওয়াতে ‘ইহার নাম অশ্বত্থামা হইল’ বলিয়া দৈববাণী হইয়াছিল, আজ সেই বীরপুরুষ সমরে সিংহনাদ করিতেছেন। হে রাজন্‌। অদ্য পাঞ্চালতনয় ধৃষ্টদ্যুম্ন অতিনৃশংস কার্য্যানুষ্ঠানপূর্ব্বক যাঁহাকে অনাথের ন্যায় নিহত করিয়াছেন, এক্ষণে সেই মহাত্মা দ্রোণের নাথস্বরূপ অশ্বত্থামা সমরে অবস্থান করিতেছেন। দ্রুপদকুমার আমার গুরু দ্রোণাচার্য্যের কেশপাশ ধারণ করিয়াছিল; অতএব গুরুপুত্র কখনই তাহাকে ক্ষমা করিয়া পৌরুষপ্রকাশে ক্ষান্ত হইবেন না।

‘হে ধর্ম্মরাজ! আপনি ধর্ম্মজ্ঞ হইয়াও রাজ্যলোভে গুরুর নিকট মিথ্যাবাক্য প্রয়োগ করিয়া ঘোরতর অধর্মে পতিত হইলেন। বালিবধে শ্রীরামের যেরূপ অকীৰ্ত্তি হইয়াছিল, দ্রোণাচার্য্যের নিধনে ত্রৈলোক্যমধ্যে আপনারও তদ্রূপ চিরস্থায়িনী অকীৰ্ত্তি হইল। দ্রোণাচাৰ্য্য আপনাকে শিষ্য ও সত্যধর্ম্মপরায়ণ বলিয়া জানিতেন; সুতরাং তাঁহার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, আপনি কখনই মিথ্যাবাক্য প্রয়োগ করিবেন না; কিন্তু আপনি অশ্বত্থামা নিহত হইয়াছেন, এই কথা স্পষ্টাভিধানে ও কুঞ্জরশব্দ অব্যক্তরূপে উচ্চারণ করিয়া গুরুর নিকট সত্যাচ্ছাদিত মিথ্যাকথা কহিয়াছেন। হে মহারাজ! দ্রোণাচাৰ্য্য আপনার বাক্যশ্রবণেই শস্ত্র পরিত্যাগপূর্ব্বক নির্ম্মম ও গতচেতন হইয়া আপনার সমক্ষে বিহ্বল হইয়া পড়িলেন। এইরূপে আপনি দ্রোণের শিষ্য হইয়া সত্যধৰ্ম পরিত্যাগপূর্ব্বক তাঁহাকে পুত্রশোকসন্তপ্ত করিয়া নিপাতিত করিলেন। হে ধর্ম্মরাজ! আপনি তৎকালে অধর্ম্মাচরণপূর্ব্বক গুরুর বধসাধন করিয়াছেন, এক্ষণে যদি সমর্থ হন, তবে অমাত্যগণে পরিবৃত হইয়া ধৃষ্টদ্যুম্নকে অশ্বত্থামার হস্ত হইতে রক্ষা করুন। অদ্য আমরা সকলেই পিতৃনিধনে রোষিত গুরুপুত্র হইতে দ্রুপদনন্দনকে পরিত্রাণ করিতে অক্ষম হইব। যিনি অলৌকিক ভাব অবলম্বনপূর্ব্বক সকল লোকের সহিত সৌহার্দ্য করিয়া থাকেন, অদ্য সেই মহাবীর পিতার কেশগ্রহণবৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়াছেন; অতএব সংগ্রামে আমাদিগকে ধ্বংস করিবেন। হে মহারাজ! আমি আচার্য্যের জীবনরক্ষাৰ্থ আপনাকে মিথ্যাকথা কহিতে বারংবার নিষেধ করিয়াছিলাম, কিন্তু আপনি স্বধর্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া তাঁহাকে সংহার করিলেন। আমাদিগের বয়ঃক্রম অধিকাংশই অতীত হইয়াছে, অল্পমাত্র অবশিষ্ট আছে। এক্ষণে এই অধর্ম্মাচরণ হওয়াতে সেই অম্লাবশিষ্ট জীবিতকাল বিকৃত হইল। দ্রোণাচাৰ্য্য সৌহার্দ্যবশতঃ ও ধর্ম্মানুসারে আমাদের পিতার তুল্য ছিলেন। আপনি অল্পকালস্থায়ী রাজ্যের নিমিত্ত তাঁহার প্রাণনাশ করিলেন। দেখুন, ধৃতরাষ্ট্র ভীষ্মদেব ও দ্রোণাচাৰ্য্যকে নিজের পুত্রগণের সহিত এই সসাগরা পৃথিবী প্রদান করিয়াছিলেন; কিন্তু আচার্য্য তাদৃশ বৃত্তিলাভ করিয়া এবং কৌরবগণকর্ত্তৃক তদ্রূপ সকৃত হইয়াও আমাকে সতত পুত্ৰাপেক্ষা সমধিক স্নেহ করিতেন। হে রাজ! গুরু কেবল আপনার বাক্যেই ন্যস্তশস্ত্র হইয়া নিহত হইয়াছেন; তিনি যুদ্ধ করিলে ইন্দ্রও তাঁহাকে বিনাশ করিতে পারিতেন না। হায়! আমরা রাজ্যলালসায় লঘুচিত্ত ও অনাৰ্য্য হইয়া সেই নিত্যোপকারী বৃদ্ধ আচার্য্যের প্রাণসংহার করিলাম। তুচ্ছ রাজ্যলোভে গুরুহত্যা করিয়া মহৎপাপে লিপ্ত হইলাম! আচাৰ্য্য নিশ্চয় জানিতেন যে, অর্জ্জুন আমার নিমিত্ত আপনার জীবন, পুত্র, কলত্র, পিতা ও ভ্রাতৃগণকে পরিত্যাগ করিতে পারে; কিন্তু আমি সেই মহাত্মার নিধনসময়ে উপেক্ষা করিয়া রহিলাম; অতএব নিশ্চয়ই আমাকে পরলোকে অবাক্‌শিরাঃ হইয়া নরকভোগ করিতে হইবে। আজি যখন আমরা মৌনব্রতাবলম্বী বৃদ্ধব্রাহ্মণ আচাৰ্য্যকে রাজ্যার্থে নিহত করিয়াছি, তখন আমাদের জীবনে কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই; মরণই শ্রেয়।”