১৬৩. দীপালোকে অতিমাত্র শোভাসম্পন্ন নৈশসমর

১৬৩তম অধ্যায়

দীপালোকে অতিমাত্র শোভাসম্পন্ন নৈশসমর

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! এইরূপে সেই ভয়ানক যুদ্ধ প্রবর্ত্তিত এবং অন্ধকার ধূলিপটলপ্রভাবে চতুর্দ্দিক সমাচ্ছাদিত হইলে ক্ষত্রিয়প্রধান যোধগণ পরস্পরকে আর নিরীক্ষণ করিতে সমর্থ হইলেন না। তখন তাহারা স্ব স্ব নাম কীৰ্ত্তন ও অনুমান দ্বারা যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। মহাবীর দ্রোণ, কর্ণ ও কৃপ এবং ভীম, ধৃষ্টদ্যুম্ন ও সাত্যকি—ইঁহারা উভয়পক্ষীয় সৈন্যগণকে ক্ষুভিত করিতে প্রবৃত্ত হইলে তাঁহারা চারিদিকে ধাবমান হইল এবং স্খলিতবুদ্ধি হইয়া পরস্পরকে বিনাশ করিতে লাগিল। সহস্র সহস্র মহারথও সেই ঘোরতর অন্ধকারে একান্ত বিমোহিত হইয়া পরস্পর সংহারে প্রবৃত্ত হইলেন। প্রধান প্রধান বীরগণ ও অন্যান্য প্রাণীগণ সেই ঘোরতর তিমিরপরিপূর্ণ সমরস্থলে নিতান্ত শঙ্কিত ও বিমোহিত হইতে লাগিলেন।”

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! পাণ্ডবগণ সেই অন্ধকারপ্রভাবে তোমাদিগকে এইরূপে আলোড়িত করিলে তোমরা হীনতেজাঃ হইয়া কি মনে করিতে লাগিলে? আর কিরূপেই বা সেই তিমিরাচ্ছন্ন প্রদেশে অস্মৎপক্ষীয় ও পাণ্ডবপক্ষীয় সৈন্যগণ দৃষ্টিগোচর হইল?”

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! ঐ সময়ে সেনাপতিগণ দ্রোণের আদেশানুসারে হতাবশিষ্ট সৈন্যসকল সংগ্রহ করিয়া ব্যূহ প্রস্তুত করিলেন। মহাবীর দ্রোণ উহার অগ্রে, শল্য পশ্চাদ্ভাগে এবং অশ্বত্থামা ও শকুনি পার্শ্বদেশে অবস্থান করিতে লাগিলেন। মহারাজ দুর্য্যোধন স্বয়ং সেই সৈন্যগণের তত্ত্বাবধারণ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। তিনি সমস্ত পদাতিদিগকে সান্ত্ববাদ প্রয়োগপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে পদাতিগণ! তোমরা অস্ত্রশস্ত্র পরিত্যাগ করিয়া প্রদীপসমুদয় গ্রহণ কর।’ পদাতিগণ তাঁহার আদেশানুসারে হৃষ্টমনে প্রদীপ গ্রহণ করিল। দেবর্ষি, গন্ধর্ব্ব, বিদ্যাধর, অপ্সর, নাগ, যক্ষ ও কিন্নরগণও কুতূহলসহকারে নভোমণ্ডলে অবস্থানপূর্ব্বক প্রদীপ গ্রহণ করিলেন। দিগ্‌দেবতারা এবং দেবর্ষি নারদ ও পর্ব্বত কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধসৌকর্য্যের জন্য সুগন্ধিতৈলসংযুক্ত প্রদীপসকল অন্তরীক্ষ হইতে নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। তখন সেই ঘোরতর যুদ্ধে প্রবৃত্ত সৈন্যসকল অগ্নিপ্রভা এবং মহার্হ আভরণ ও প্রহারার্থ নিক্ষিপ্ত মার্জিত দিব্যশস্ত্রপ্রভায় উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল। কৌরবগণ প্রতি রথে পাঁচ পাঁচ, প্রতি গজে তিন তিন ও প্রতি অশ্বে এক এক প্রদীপ প্রজ্বালিত করিলেন।। তখন সেই দীপমালা আপনার সৈন্যগণকে আলোক প্রদান করিতে লাগিল। সৈন্যগণ প্রদীপহস্ত পদাতিগণকর্ত্তৃক পরিশোভিত হইয়া নভোমণ্ডলস্থ বিদ্যুদ্দামমণ্ডিত মেঘমণ্ডলের ন্যায় নিরীক্ষিত হইল।

“এইরূপে সেই সৈন্যগণ প্রকাশিত হইলে হুতাশনসদৃশ তেজস্বী দ্রোণ তাহাদের মধ্যে গমন করিয়া মধ্যাহ্নকালীন প্রচণ্ড সূর্যের ন্যায় শোভা ধারণ করিলেন। প্রদীপপ্রভায় সুবর্ণময় আভরণ, নিষ্ক, বিশুদ্ধ তূণীর ও শস্ত্ৰসমুদয় প্রতিফলিত হইতে লাগিল এবং সৈক্য, গদা, শুভ্র পরিঘ ও শক্তিমধ্যে প্রতিফলিত হইয়া রশ্মিজালদ্বারা সমধিক আলোক বিস্তার করিল। তখন যোদ্ধাদিগের ছত্র, চামর, অসি, প্রদীপ্ত মহোল্কা ও দোদুল্যমান সুবর্ণমালা সমধিক শোভা পাইতে লাগিল। হে মহারাজ! এইরূপে সেই সমস্ত সৈন্য শস্ত্র, দীপ ও আভরণপ্রভায় সাতিশয় উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল। শোণিতসিক্ত শাণিত শস্ত্ৰসমুদয় বীরগণকর্ত্তৃক বিকম্পিত হইয়া বর্ষাকালীন বিদ্যুতের ন্যায় প্রভাজাল বিস্তার করিতে লাগিল। শত্ৰুসংহারার্থ মহাবেগে ধাবমান কম্পিতকলেবর মনুষ্যগণের মুখমণ্ডল সমীরণসঞ্চালিত অম্বুদের ন্যায় শোভা ধারণ করিল। পাদপদলসমাচ্ছন্ন অরণ্য অনলপ্রভাবে প্রদীপ্ত হইলে দিবাকরের প্রভা যেমন সমধিক হইয়া থাকে, তদ্রূপ সেই ভয়ঙ্করকালে কৌরবসৈন্যগণের প্রভা অপেক্ষাকৃত অধিক হইয়া উঠিল।

“তখন পাণ্ডবগণও কৌরবপক্ষীয় বলসমুদয় দীপমালায় শাভিত হইয়াছে অবগত হইয়া স্বীয় সৈন্যমধ্যে পদাতিগণকে প্রতিবোধিত করিয়া সেইরূপ কার্য্যের অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইলেন। তাঁহারা প্রতি গজে সাত সাত, প্রত্যেক রথে দশ দশ, প্রতি অশ্বের পৃষ্ঠে দুই দুই প্রদীপ প্রজ্বলিত করিলেন। ধ্বজ এবং সমস্ত সেনার পার্শ্ব, পশ্চাৎ, অগ্র ও মধ্যভাগে অসংখ্য প্রদীপ প্রজ্বলিত হইল। হে রাজন! এইরূপে সেই উভয়পক্ষীয় সৈন্যমধ্যে অসংখ্য দীপ প্রজ্বলিত হইতে লাগিল। হস্তী, অশ্ব ও রথের উপর এবং পতাদিগণের হস্তে অসংখ্য দীপ থাকাতে পাণ্ডবসেনা আলোকময় হইল। হে মহারাজ! সেই সমুদয় সৈন্য প্রদীপদ্বারা উদ্ভাসিত হইয়া দিবাকরাভিগুপ্ত [রৌদ্রতেজে বর্দ্ধিতরাগ] হুতাশনের ন্যায় সমধিক তেজস্বী হইয়া উঠিল। উভয়পক্ষীয় প্রদীপপ্রভা পৃথিবী, অন্তরীক্ষ ও দিক্‌সমুদয়ে অভিব্যাপ্ত হইলে আপনার ও পাণ্ডবগণের সৈন্যসমুদয় সুস্পষ্টরূপে লক্ষিত হইতে লাগিল। দেবতা, গন্ধর্ব্ব, যক্ষ, অঙ্গর ও সিদ্ধগণ নভোমণ্ডলগত আলোকপ্রভাবে উদ্বোধিত হইয়া তথায় সমাগত হইলেন। তখন সেই সংগ্রামস্থল দেব, গন্ধর্ব্ব, অঙ্গর ও সিদ্ধগণ এবং রণনিহত দেবলোক-প্রস্থানোদ্যত যোধগণে একান্ত সমাকুল হইয়া সুরলোকসদৃশ হইয়া উঠিল। ঐ সময়ে সেই রথ, অশ্ব ও নাগগণে সমাকুল, দীপসমুদয়ে প্রদীপ্ত, নিহত ও পলায়িত অশ্বকুলসঙ্কুল, সংবদ্ধ যোধগণে সমাকীর্ণ, অসংখ্য নর, নাগ ও অশ্বসম্পন্ন বলসমুদয় সুরাসুরব্যূহের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। ঐ যুদ্ধে শক্তিসকল প্রচণ্ড বায়ু, মেঘ, গজ ও অশ্বগণের গভীর গর্জ্জন মহা নির্ঘোষ ও রুধিরপ্রবাহ অম্বুধারাস্বরূপ [বৃষ্টিধারাসদৃশ] প্রতীয়মান হইল। হে মহারাজ! মধ্যাহ্নকালীন শারদ দিবাকর যেমন করজালে সকলকে সন্তপ্ত করিয়া থাকে, তদ্রূপ মহাবীর অশ্বত্থামা সেই অনলকল্প সংগ্রামে পাণ্ডবগণকে শরজালে নিতান্ত নিপীড়িত করিতে লাগিলেন।”