১৭১. ধৃষ্টদ্যুম্নকর্ত্তৃক দ্রুমসেনবধ

১৭১তম অধ্যায়

ধৃষ্টদ্যুম্নকর্ত্তৃক দ্রুমসেনবধ

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! এইরূপে অতি ভীষণ তুমুল সংগ্রাম সমুপস্থিত হইলে, মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন সুদৃঢ় শরাসন ধারণপূর্ব্বক বারংবার জ্যা আকর্ষণ করিয়া দ্রোণাচার্য্যের সুবৰ্ণবিভূষিত রথের অভিমুখে ধাবমান হইলেন। পাঞ্চাল ও পাণ্ডবগণ ধৃষ্টদ্যুম্নকে দ্রোণাচার্য্যের বধসাধনে সমুদ্যত দেখিয়া দ্রুপদতনয়ের সাহায্যার্থ তাঁহাকে পরিবেষ্টন করিলেন। তদ্দর্শনে আপনার পুত্রেরাও পরম যত্নসহকারে দ্রোণকে রক্ষা করিতে লাগিলেন। এইরূপে সেই রজনীযোগে উভয়পক্ষীয় সেনা সমবেত হইলে তাহাদিগকে বাতাহত, ক্ষুব্ধসত্ত্ব, অতি ভীষণ সমুদ্রদ্বয়ের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। অনন্তর মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন আচার্য্যের বক্ষঃস্থলে পাঁচশর নিক্ষেপ করিয়া সিংহনাদ করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন দ্রোণাচাৰ্য্য পঞ্চবিংশতিশরে দ্রুপদতনয়কে বিদ্ধ করিয়া একভল্লে তাঁহার ভাস্বর শরাসন ছেদন করিয়া ফেলিলেন। দ্রোণশরবিদ্ধ প্রবলপ্রতাপ ধৃষ্টদ্যুম্ন সমরে সেই ছিন্নকার্মুক পরিত্যাগপূর্ব্বক ক্রোধে ওষ্ঠাধর দংশন করিয়া আচার্য্যের বিনাশবাসনায় অন্য এক শরাসন গ্রহণ ও আকর্ণ আকর্ষণ করিয়া দ্রোণের প্রতি এক জীবিতান্তকারী শর নিক্ষেপ করিলেন। সেই ধৃষ্টদ্যুম্নবিক্ষিপ্ত শর উদিত দিবাকরের ন্যায় সৈন্যসমুদয়কে উদ্ভাসিত করিতে লাগিল। দেব, দানব ও গন্ধর্ব্বগণ সেই ঘোরতর শর সন্দর্শন করিয়া দ্রোণাচার্য্যের মঙ্গল হউক, এই কথা বারংবার কহিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর কর্ণ সেই ধৃষ্টদ্যুম্ননির্মুক্ত শর আচাৰ্য্যরথসমীপে না আসিতে আসিতেই দ্বাদশখণ্ডে ছেদন করিয়া ফেলিলেন। মহাবীর কর্ণ এইরূপে শরনিকরে ধৃষ্টদ্যুম্নের শরচ্ছেদন করিয়া তাঁহাকে শাণিত শরজালে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। তখন মহারথ অশ্বত্থামা পাঁচ, দ্রোণ পাঁচ, শল্য নয়, দুঃশাসন তিন, দুর্য্যোধন বিংশতি ও শকুনি পাঁচভল্লে ধৃষ্টদ্যুম্নকে বিদ্ধ করিলেন। মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন এইরূপে দ্রোণের পরিত্রাণার্থী সাত মহারথীর শরে বিদ্ধ হইয়া তাঁহাদের প্রত্যেককে তিন তিন শরে প্রতিবিদ্ধ করিলেন। তাঁহারা ধৃষ্টদ্যুম্নের শরনিকরে নিতান্ত নিপীড়িত ও সকলে সমবেত হইয়া ভীষণ নিনাদ করিয়া তাঁহাকে বিদ্ধ করিতে আরম্ভ করিলেন।

“হে মহারাজ! ঐ সময়ে মহাবীর দ্রুমসেন সাতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া ধৃষ্টদ্যুম্নকে ‘থাক্‌ থাক্‌’ বলিয়া শরাঘাত করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর দ্রুপদতনয় দ্রুমরাজের প্রতি অতিতীক্ষ্ণ সুবর্ণপুঙ্খ প্রাণনাশক তিনশর নিক্ষেপ করিয়া একভল্পে তাঁহার উজ্জ্বল সুবর্ণকুণ্ডলালকৃত মস্তক ছেদন করিলেন। পরিপক্ক তালফল যেমন বাতাহত হইয়া ভূতলে নিপতিত হয়, তদ্রূপ সেই দ্রুমসেনের দংশিতাধর মুণ্ড ভূতলে নিপতিত হইল। তখন মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন পুনরায় বীরগণকে নিশিতশরনিকরে নিপীড়িত করিয়া একভল্লে বিচিত্ৰযোদ্ধা কর্ণের শরাসন ছেদন করিয়া ফেলিলেন। মহাবীর কর্ণ সিংহ যেমন লাঙ্গুলচ্ছেদন সহ্য করিতে অসমর্থ হয়, তদ্রূপ স্বীয় শরাসনচ্ছেদন সহ্য করিতে না পারিয়া রোষকষায়িতলোচনে নিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া সত্বর অন্য শরাসন গ্রহণ ও শরবর্ষণপূর্ব্বক মহাবলপরাক্রান্ত ধৃষ্টদ্যুম্নের প্রতি ধাবমান হইলেন। ঐ সময় অন্য ছয় মহারথ কর্ণকে ক্রুদ্ধ নিরীক্ষণ করিয়া পাঞ্চালপুত্রের বিনাশবাসনায় তাঁহাকে বেষ্টন করিলেন। মহারাজ! এইরূপে ধৃষ্টদ্যুম্ন কৌরবপক্ষীয় ছয়জন যোদ্ধার মধ্যে অবস্থিত হইলে যোধগণ তাঁহাকে কালকবলে নিপতিত বলিয়া বোধ করিতে লাগিলেন। ঐ সময়ে মহাবীর সাত্যকি ধৃষ্টদ্যুম্নের সাহায্যার্থ শরবর্ষণপূর্ব্বক তাঁহার সমীপে ধাবমান হইলেন। কর্ণ যুদ্ধদুর্ম্মদ যুযুধানকে আগমন করিতে দেখিয়া দশবাণে তাঁহাকে বিদ্ধ করিলেন। তখন মহাবীর সাত্যকি শুরগণের সমক্ষে কর্ণকে দশশরে বিদ্ধ করিয়া ‘পলায়ন করিও না, ঐ স্থানে অবস্থান কর’ বলিয়া আস্ফালন করিতে লাগিলেন। অনন্তর বলি ও বাসবের ন্যায় বলবান্ সাত্যকি ও মহাত্মা কর্ণের ঘোরতর সংগ্রাম আরম্ভ হইল। ক্ষত্রিয় প্রধান সাত্যকি রথনির্ঘোষে ক্ষত্রিয়গণকে ভীত করিয়া রাজীবলোচন রাধানন্দনকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন, মহাবলপরাক্রান্ত কর্ণও শরাসনশব্দে বসুধা কম্পিত করিয়া যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া বিপাট, কর্ণি, নারাচ, বৎসদন্ত ও ক্ষুরপ্র প্রভৃতি শত শত অস্ত্ৰদ্বারা সাত্যকিকে বিদ্ধ করিলেন। বৃষ্ণিপ্রবীর যুযুধানও কর্ণের উপর শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন। তৎকালে তাঁহাদের উভয়েরই যুদ্ধ সমভাব হইল। তখন আপনার পুত্রগণ কর্ণকে সম্মুখে রাখিয়া নিশিতশরনিকরে সাত্যকিকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। মহাবীর সাত্যকি স্বীয় অস্ত্রদ্বারা তাঁহাদিগকে ও কর্ণের অস্ত্রজাল নিবারণ করিয়া বৃষসেনের বক্ষঃস্থল বিদ্ধ করিতে আরম্ভ করিলেন। বলবীৰ্য্যশালী বৃষসেন সাত্যকির বাণে বিদ্ধ হইয়া শরাসন পরিত্যাগপূর্ব্বক রথোপরি নিপতিত হইলেন। মহারথ কর্ণ তদ্দর্শনে বৃষসেনকে নিহত বোধ করিয়া পুত্রশোকাকুলিতচিত্তে সাত্যকিকে নিপীড়িত করিতে লাগিলেন; মহারথ যুযুধানও কর্ণশরে নিপীড়িত হইয়া তাঁহাকে বিবিধ বাণে বারংবার বিদ্ধ করিলেন। অনন্তর তিনি দশবাণে কর্ণকে ও পাঁচবাণে বৃষসেনকে বিদ্ধ করিয়া অবিলম্বে উভয়ের শরমুষ্টি ও শরাসন ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তখন মহাবীর কর্ণ ও বৃষসেন সত্বর অতি ভীষণ অন্য শরাসনদ্বয় গ্রহণ ও জ্যারোপণ করিয়া চতুর্দ্দিক হইতে নিশিত শরনিকর বর্ষণপূর্ব্বক সাত্যকিকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন।

ধৃষ্টদ্যুম্ন-সাত্যকিবধে কর্ণের কূটকল্পনা

“হে মহারাজ! সেই অসংখ্য বীরনিপাতন ভয়ঙ্কর সংগ্রামসময়ে গাণ্ডীবের ভীষণ নিঃস্বন অনবরত শ্রবণগোচর হইতে লাগিল। মহাবীর কর্ণ রথনির্ঘোষ ও গাণ্ডীবনিঃস্বন শ্রবণ করিয়া রাজা দুর্য্যোধনকে কহিলেন, ‘হে মহারাজ! ধনঞ্জয় প্রধান প্রধান বীর ও কৌরবসৈন্যগণকে সংহার করিয়া গাণ্ডীবধ্বনি করিতেছে; অর্জ্জুনের পর্জ্জন্যনির্ঘোষসদৃশ রথনির্ঘোষও শ্রুতিগোচর হইতেছে; অতএব বোধ হয়, ধনঞ্জয় স্বকাৰ্য্যসাধনে সমুদ্যত হইয়াছে। ঐ দেখুন, কৌরবসৈন্যগণ অর্জ্জুনশরে বিদীর্ণ ও ইতস্ততঃ বিকীর্ণ হইতেছে। উহারা কোনক্রমেই একস্থানে অবস্থান করিতে সমর্থ হইতেছে না। সমীরণ যেমন জলদজাল ছিন্নভিন্ন করিয়া থাকে, তদ্রূপ অর্জ্জুন শরজাল বিস্তারপূর্ব্বক উহাদিগকে ছিন্নভিন্ন করিতেছে। এক্ষণে উহারা অর্জ্জুনকে প্রাপ্ত হইয়া মহাসাগরে নিপতিত নৌকার ন্যায় বিদীর্ণ হইতেছে। মহারাজ! ঐ দেখুন, যোদ্ধৃগণ গাণ্ডীবনির্মুক্ত শরনিকরে নিপাতিত এবং কেহ কেহ ইতস্ততঃ ধাবমান হইয়াছে। উহাদিগের কোলাহল এবং অর্জ্জুনের রথসন্নিধানে নভোমণ্ডলে মেঘগর্জ্জনের ন্যায় দুন্দুভিনির্ঘোষ, হাহাকার শব্দ ও সিংহনাদ শ্রুতিগোচর হইতেছে। ঐ দেখুন, সাত্যকি আমাদিগের মধ্যস্থলে অবস্থান করিতেছে। আর পাঞ্চালরাজপুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণাচার্য্যের সহিত সমরে প্রবৃত্ত হইয়া আপনার সহোদরগণকর্ত্তৃক পরিবৃত হইয়াছে। এক্ষণে যদি ধৃষ্টদ্যুম্ন ও সত্যকিকে বিনাশ করিতে পারি, তাহা হইলে নিশ্চয়ই আমাদিগের জয়লাভ হইবে। অতএব হে মহারাজ! আমরা সকলে সমবেত হইয়া অভিমন্যুকে যেরূপে সংহার করিয়াছি, ঐ বীরদ্বয়কেও সেইরূপে সংহার করা আমাদের কর্ত্তব্য। ঐ দেখুন, ধনঞ্জয় সাত্যকিকে বহুসংখ্যক কৌরবগণের সহিত সমরে প্রবৃত্ত জানিয়া দ্রোণসৈন্যাভিমুখে আগমন করিতেছে। অতএব আপনি সাত্যকিসন্নিধানে বহুসংখ্যক রথীগণকে প্রেরণ করুন। সাত্যকি অসংখ্য মহারথপরিবৃত হইলে ধনঞ্জয় আর তাহাকে জ্ঞাত হইতে সমর্থ হইবে না। এক্ষণে বীরগণ সাত্যকিকে বিনাশ করিবার নিমিত্ত অনবরত শরনিকর বর্ণ করিতে আরম্ভ করুন।’

“হে মহারাজ। অনন্তর আপনার আত্মজ রাজা দুর্য্যোধন কর্ণের অভিপ্রায় অবগত হইয়া শকুনিকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে মাতুল! তুমি দশসহস্র হস্তী ও দশসহস্র রথে পরিবৃত হইয়া ধনঞ্জয়সন্নিধানে গমন কর। দুঃশাসন, দুর্বিসহ, সুবাহু ও দুৰ্ম্মর্ষণ—ইঁহারা বহুসংখ্যক পদাতিসৈন্যপরিবৃত হইয়া তোমার অনুগমন করিবেন। তুমি এক্ষণে ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জ্জুন, নকুল, সহদেব ও বাসুদেবকে সংহার কর। হে মাতুল! দেবগণ যেমন দেবরাজকে আশ্রয় করিয়া জয়াশা করিয়াছিলেন, তদ্রূপ আমি তোমারই উপর নির্ভর করিয়া জয়াশা করিয়া থাকি। পূর্ব্বে মহাবীর কার্ত্তিকেয় যেমন অসুরগণকে সংহার করিয়াছিলেন, তদ্রূপ তুমি এক্ষণে পাণ্ডবগণকে বিনাশ কর। হে মহারাজ! মহাবল সুবলনন্দন রাজা দুর্য্যোধনের আদেশানুসারে তাঁহারই প্রিয়ানুষ্ঠানার্থ বহুসংখ্যক সৈন্য ও আপনার পুত্রগণের সমভিব্যাহারে পাণ্ডবসংহারার্থ যাত্রা করিলেন। এইরূপে সুবলনন্দন পাণ্ডবসৈন্যমধ্যে প্রবিষ্ট হইলে উভয়পক্ষে ঘোরতর সংগ্রাম আরম্ভ হইল। তখন মহাবীর কর্ণ অসংখ্য সৈন্যসমভিব্যাহারে অনবরত শরনিকর বর্ষণ করিয়া সাত্যকির প্রতি ধাবমান হইলেন; আপনার পক্ষীয় অন্যান্য বীরগণও সমবেত হইয়া সাত্যকিকে পরিবেষ্টন করিলেন। ঐ সময় মহাবীর দ্রোণ ধৃষ্টদ্যুম্নের প্রতি গমন করিয়া তাঁহার ও পাঞ্চালগণের সহিত ঘোরতর যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন।”