১৫৪. পাণ্ডবগণের সমবেত দ্রোণাক্রমণ

১৫৪তম অধ্যায়

পাণ্ডবগণের সমবেত দ্রোণাক্রমণ

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! মহাবলপরাক্রান্ত দ্রোণ মূঢ় দুৰ্য্যোধনকে সেই কথা বলিয়া রোষভরে পাণ্ডবমধ্যে প্রবেশ করিলে পাণ্ডবগণ তাঁহাকে ইতস্ততঃ সঞ্চরণ করিতে নিরীক্ষণ করিয়া কিরূপে নিবারণে প্রবৃত্ত হইল? যখন দ্রোণ শত্ৰুসংহারে প্রবৃত্ত হইলেন, তৎকালে অস্মৎপক্ষীয় কোন্ কোন্ বীর তাঁহার দক্ষিণচক্র ও কোন্ কোন্ বীরই বা তাঁহার বামচক্র রক্ষা করিল? কোন্ কোন্ রথী তাঁহার পৃষ্ঠবর্তী ও কাহারাই বা তাঁহার সর্মুখবর্তী হইলেন? এক্ষণে স্পষ্টই বোধ হইতেছে যে, সৰ্বাস্ত্রবিশারদ মহাবীর দ্রোণ রথমার্গে নৃত্য করিয়া পাঞ্চালগণমধ্যে প্রবেশ করিলে তাহারা শিশিরসময়ে গোসমুদয় যেমন কম্পিত হয়, তদ্রূপ মহাভয়ে কম্পিত হইয়াছিল। যাহা হউক, সেই সর্ব্বশস্ত্রবেত্তা মহাবীর দ্রোণ হুতাশনসদৃশ স্বীয় প্রভাবে পাঞ্চালসৈন্যগণকে দগ্ধ করিয়া কিরূপে কালগ্রাসে নিপতিত হইলেন?”

সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! মহাবীর অর্জ্জুন সায়াহ্নে জয়দ্রথবিনাশানন্তর ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের সহিত সাক্ষাৎকার করিয়া সাত্যকি সমভিব্যাহারে দ্রোণাভিমুখে ধাবমান হইলেন। তখন অসংখ্য সৈন্যপরিবৃত ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির, ভীমসেন, মহাবীর নকুল, ধীমান্ সহদেব, সসৈন্য ধৃষ্টদ্যুম্ন, কেকয়গণসমবেত বিরাট, অসংখ্য সেনাপরিবৃত মৎস্য ও শাল্বগণ, পাঞ্চালগণপরিরক্ষিত মহারাজ দ্রুপদ, দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র ও সসৈন্য রাক্ষস ঘটোৎকচ, শিখণ্ডিপুরঃসর ষট্‌সহস্র পাঞ্চাল ও প্রভদ্রকগণ এবং একত্র সমবেত অন্যান্য অসংখ্য মহারথ আচার্য্যের অভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন। ঐ সমস্ত মহাবীরেরা যুদ্ধার্থ গমন করিলে ভীরুজনভয়বৰ্দ্ধিনী ঘোররজনী সমুপস্থিত হইল। ঐ রজনীতে বহুতর কুঞ্জর ও যোদ্ধাদিগের প্রাণনাশ হইয়াছিল।

“হে মহারাজ! ঐ ভীষণ বিভাবরীতে শিবাগণ গ্রাসম্পন্ন জ্বালাকরাল মুখব্যাদানপূর্ব্বক লোকের অন্তঃকরণে ভয়সঞ্চার করিয়া ঘোরতর চীৎকার করিতে আরম্ভ করিল। ভয়ঙ্কর উলুকসকল কৌরবসৈন্যগণকে শঙ্কিত, করিয়া ভৈরব রব পরিত্যাগ করিতে লাগিল। তখন সৈন্যমধ্যে তুমুল কোলাহল উপস্থিত হইল। ভেরী ও মৃদঙ্গের বিপুল শব্দ, করিনিকরের বৃংহিতধ্বনি, অশ্বগণের হ্রেষারব ও খুরশব্দে রণস্থল তুমুল হইয়া উঠিল। ঐ সময় মহাবীর দ্রোণের সহিত সৃঞ্জয়গণের ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হইল। দিঙ্মণ্ডল গাঢ়তর তিমিরে সমাচ্ছন্ন ও সৈন্যগণের চরণসমুত্থিত ধূলিজাল নভোমণ্ডলে উড্ডীন হইলে আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হইল না। কিয়ৎক্ষণ পরে মনুষ্য, অশ্ব ও মাতঙ্গগণের রুধিরপ্রবাহে ধূলিপটল তিরোহিত হইয়া গেল। নিশাকালে পর্ব্বতোপরি দহ্য বংশবনের ন্যায় প্রক্ষিপ্ত শস্ত্রসমুদয়ের ঘোরতর চটচটা শব্দ হইতে লাগিল। মৃদঙ্গ, আনক, ঝল্লীর ও পটহশব্দ এবং অশ্বসকলের চীৎকারে সমুদয় রণস্থল একান্ত আকুল হইয়া উঠিল। তখন আমরা মোহে অভিভূত হইলাম। কাহারও আত্মপর বিবেচনা রহিল না। সকলে উন্মত্তের ন্যায় হইল। অনন্তর ধূলিপটল শোণিতপ্রবাহে উচ্ছিন্ন হইলে সুবর্ণময় বর্ম্ম ও ভূষণপ্রভায় অন্ধকার নিরাকৃত হইল। তখন সেই শক্তিধ্বজসমাকুল মণি ও সুবর্ণময় অলঙ্কারে অলঙ্কৃত ভারতীসেনাসকল নিশাকালে নক্ষত্ৰসাৰ্থসঙ্কুল নভোমণ্ডলের ন্যায় অপূর্ব্ব শোভা ধারণ করিল। ঐ সৈন্যমধ্যে গোমায়ু ও কাকগণ অনবরত কোলাহল, করিসমুদয় বৃংহিতধ্বনি এবং সৈন্যগণ সিংহনাদ ও উৎক্রোশধ্বনি করিতে লাগিল।

“অনন্তর সমরাঙ্গনে মহেন্দ্রের বজ্রনির্ঘোষসদৃশ লোমহর্ষণ তুমুল শব্দ সমুত্থিত হইয়া এককালে দিঙ্মণ্ডল পরিপূর্ণ করিল। মহারাজ! সেই অন্ধকারকালে অঙ্গদ, কুণ্ডল ও নিষ্ক প্রভৃতি বিবিধ স্বর্ণালঙ্কারে বিভূষিত অসংখ্য রথ ও হস্তিসম্পন্ন সেই কৌরবসৈন্য বিদ্যুদ্দামমণ্ডিত জলপটলের ন্যায় লক্ষিত হইল। চতুর্দ্দিকে অসি, শক্তি, গদা, খড়, মুষল, প্রাস ও পট্টিশ প্রভৃতি অস্ত্রসকল বিক্ষিপ্ত হওয়াতে বোধ হইতে লাগিল যেন, অগ্নিবৃষ্টি হইতেছে। হে মহারাজ! দুৰ্য্যোধন আপনার সেই সৈন্যমেঘের পুরোবৰ্ত্তী বায়ু, রথ ও নাগ উহার বকপংক্তি; বাদিধ্বনি নির্ঘোষ; দ্রোণাচাৰ্য্য ও পাণ্ডব পর্জ্জন্য; খড়্গ, শক্তি ও গদা অশনি; শরবৃষ্টি বারিধারা এবং অস্ত্র উহার পবনস্বরূপ শোভা পাইতে লাগিল।

‘যুদ্ধার্থী বীরগণ সেই বিস্ময়কর অতি ভয়াবহ ভারতীসেনামধ্যে প্রবেশ করিল। এইরূপে সেই প্রদোষসময়ে মহাশব্দসঙ্কুল, ভীরুগণের ভয়বর্দ্ধন, শূরগণের হর্ষজনন, ঘোরর যুদ্ধ উপস্থিত হইলে পাণ্ডব ও সৃঞ্জয়গণ সমবেত হইয়া ক্রোধভরে দ্রোণের অভিমুখে ধাবমান হইলেন। হে মহারাজ! ঐ সময় যে যে বীর আচার্য্যের সমক্ষে সমুপস্থিত হইয়াছিলেন, মহাবীর দ্রোণ তাঁহাদের মধ্যে অনেককে বিমুখ ও অনেককে নিহত করিলেন। সেই সময়ে তিনি একাকীই সহস্র হস্তী, অযুত রথ, অযুত পদাতি এবং অর্ব্বদ অশ্বকে নারাচাস্ত্রে বিদীর্ণ করিয়া ফেলিলেন।”