১৭৬. কর্ণ-ঘটোৎকচের ঘোরতর যুদ্ধ

১৭৬তম অধ্যায়

কর্ণ-ঘটোৎকচের ঘোরতর যুদ্ধ

সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! মহাবলপরাক্রান্ত ঘটোৎকচ লোহিতনেত্ৰ মহাকায়, মহাবাহু, মহাশীৰ্ষ, শঙ্কুকর্ণ, নির্নতোদর [আঁটসাঁট পেট], নীলকলেবর ও বিকৃতাকার। উঁহার মুখমণ্ডল তাম্রবর্ণ, শ্মশ্রুজাল হরিদ্‌বর্ণ, হনুদ্বয় সুপ্রশস্ত, বোমরাজি ঊৰ্দ্ধমুখ, আস্যদেশ আকৰ্ণবিদারিত[মুখের হাঁ কৰ্ণ পৰ্য্যন্ত বিস্তীর্ণ], দশনপংক্তি সুতীক্ষ্ণ, জিহ্বা ও ওষ্ঠ তাম্রবর্ণ ও সুদীর্ঘ, ভ্রূযুগল আয়ত, নাসিকা স্থূল, গ্রীবাদেশ লোহিতবর্ণ, কলেবর পর্ব্বতপ্রমাণ, কেশকলাপ বিকটাকারে উদ্বদ্ধ, কটিদেশ স্থূল, নাভি গূঢ় এবং ললাট প্রান্ত শিখাকলাপে মণ্ডিত। সেই মহামায়াসম্পন্ন রাক্ষস ভুজদণ্ডে কটক ও অঙ্গদ, অচলসদৃশ বক্ষঃস্থলে হুতাশনতুল্য নিষ্ক, মস্তকে সুবর্ণময় তোরণপ্রতিম বিচিত্র শুভ্র কিরীট, কর্ণে নবোদিত দিবাকরপ্রতিম কুণ্ডলযুগল, গলদেশে সুবর্ণময়ী মালা ও গাত্রে বিপুল কাংস্যময় কবচ ধারণপূর্ব্বক কিঙ্কিণীজালনির্ঘোষযুক্ত, রক্তবর্ণ ধ্বজপটমণ্ডিত, ঋক্ষচর্ম্মপরিবৃত, নল্ব-পরিমিত, বিবিধ আয়ুধসম্পন্ন, অষ্ট্রচক্রবিশিষ্ট, মেঘ গম্ভীরনিঃস্বন মহারথে আরোহণ করিয়া সমস্থলে সমুপস্থিত হইলেন। মত্তমাতঙ্গবিক্রম, লোহিতলোচন, নানাবর্ণ, জিতশ্রম বিপুলজটাজালমণ্ডিত, মহাবল, কামচারী অশ্বসকল মুহুর্মুহু হ্রেষারব পরিত্যাগপূর্ব্বক মহাবেগে উঁহাকে বহন করিতে লাগিল। বিকটলোচন, প্রদীপ্তবদন, ভাস্করকুণ্ডল এক রাক্ষস সূৰ্য্যরশ্মিসদৃশ অশ্ববল্‌গা গ্রহণপূর্ব্বক উহার অশ্বগণকে সঞ্চালিত করিতে আরম্ভ করিল। রাক্ষসরাজ ঘটোৎকচ সেই সারথির সহিত সমবেত হইয়া অরুণসারথি দিবাকরের ন্যায় সমরস্থলে অবস্থান করিতে লাগিলেন। প্রকাণ্ড অভ্রখণ্ডে সংযুক্ত উত্তুঙ্গ পর্ব্বতের ন্যায় উঁহার রথোপরি সমুচ্ছ্রিত রক্তমস্তক ভীষণাকার গৃধ্রসংযুক্ত গগনস্পর্শ ধ্বজদণ্ড শোভমান হইল।

“হে মহারাজ! অনন্তর রাক্ষস ঘটোৎকচ দ্বাদশ অরত্নি বিস্তৃত, চারিশত হস্ত দীর্ঘ, সুদৃঢ় জ্যাসম্পন্ন বজ্রনির্ঘোষ শরাসন আকর্ষণ ও রথা পরিমিত শরনিকরদ্বারা চতুর্দ্দিক সমাচ্ছন্ন করিয়া সেই বীরবিনাশিনী রজনীযোগে মহাবীর কর্ণের প্রতি ধাবমান হইলেন। উহার শাসনশব্দ অশনিনির্ঘোষের ন্যায় শ্রুতিগোচর হওয়াতে আপনার সৈন্যগণ নিতান্ত ভীত হইয়া সাগরতরঙ্গের ন্যায় কম্পিত হইতে লাগিল। তখন মহাবীর কর্ণ সেই বিকটলোচন অতি ভীষণ নিশাচরকে আগমন করিতে দেখিয়া সত্বর গর্ব্ব প্রকাশপূর্ব্বক তাঁহার নিবারণে প্রবৃত্ত হইলেন এবং মাতঙ্গ যেমন প্রতিদ্বন্দ্বী মাতঙ্গের প্রতি গমন করে, যূথপতি বৃষ যেমন অন্য বৃষভের প্রতি ধাবমান হয়, তদ্রূপ তিনি শরনিকর বর্ষণপূর্ব্বক তাঁহার নিকট গমন করিলেন। তখন দেবরাজ ইন্দ্র ও শম্বুরাসুরের ন্যায় মহাবীর কর্ণ ও ঘটোৎকচের ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হইল। সেই দুই মহাবীর ভীমনিঃস্বন শরাসনদ্বয় গ্রহণপূর্ব্বক শরনিকরে পরস্পরের কলেবর ক্ষতবিক্ষত করিয়া পরস্পরকে সমাচ্ছন্ন করিয়া ফেলিলেন এবং আকর্ণপূর্ণ শর পরিত্যাগপূর্ব্বক পরস্পর কাংস্যনির্মিত বর্ম্ম ভেদ করিয়া পরস্পরকে বিদীর্ণ করিতে আরম্ভ করিলেন। যেমন শার্দুলদ্বয় নখদ্বারা ও মাতঙ্গদ্বয় দন্তদ্বারা পরস্পরকে প্রহার করিয়া থাকে, তদ্রূপ সেই বীরদ্বয় রথ, শক্তি ও শরনিকরদ্বারা পরস্পরকে প্রহার করিতে লাগিলেন। এইরূপে তাঁহারা কখন পরস্পর কলেবরচ্ছেদন, কখন সায়কসন্ধান ও কখন বা পরস্পরকে শরানলে দহন করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। তৎকালে কেহই তাঁহাদিগকে নিরীক্ষণ করিতে সমর্থ হইল না। তাঁহারা শরজালে ক্ষতবিক্ষত ও রুধিরধারায় পরিপ্লুত হইয়া গৈরিকধাতুধারাস্রাবী অঞ্চলের ন্যায় শোভা ধারণ করিলেন। ঐ সময় তাঁহারা পরম যত্নসহকারে শরনিকরে পরস্পরের দেহ ভেদ করিয়াও কিছুতেই পরস্পরকে বিচলিত করিতে সমর্থ হইলেন না। এইরূপে সেই নিশাকালে উক্ত মহাবীরদ্বয় প্রাণপণে ঘোরতর যুদ্ধ করিলেন। রণস্থলস্থিত সমস্ত ব্যক্তিই ঘটোৎকচের কার্মুকনির্ঘোষে সাতিশয় ভীত হইল। কর্ণ তাঁহাকে কোনক্রমে অতিক্রম করিতে সমর্থ না হইয়া পরিশেষে দিব্যাস্ত্র বিস্তার করিতে আরম্ভ করিলেন। তদ্দর্শনে মহাবীর ঘটোৎকচ রাক্ষসী মায়া পরিগ্রহ করিয়া শূল, শৈল ও মুদ্গরধারী ভয়ঙ্কর রাক্ষসসেনায় পরিবৃত হইলেন। মহীপালগণ সেই দণ্ডধারী ভূতান্তক কৃতান্তের ন্যায় ঘটোৎকচকে শস্ত্র উদ্যত করিয়া আগমন করিতে দেখিয়া নিতান্ত ব্যথিত হইলেন। মাতঙ্গগণ উঁহার সিংহনাদে একান্ত ভীত হইয়া মূত্র পরিত্যাগ করিতে লাগিল এবং সৈন্যসকল সাতিশয় উদ্বিগ্ন হইল।

“অনন্তর সেই রাক্ষসগণ অর্দ্ধরাত্রিপ্রভাবে সমধিক বীৰ্য্যশালী হইয়া চতুর্দ্দিকে শিলাবৃষ্টি করিতে আরম্ভ করিল। লৌহময় চক্র, ভূশণ্ডী, তোমর, শূল, শতঘ্নী ও পট্টিশ সকল অনবরত নিপতিত হইতে লাগিল। তখন আপনার আত্মজ ও যোদ্ধৃগণ সেই ভয়ঙ্কর যুদ্ধদর্শনে নিতান্ত ব্যথিত হইয়া ইতস্ততঃ ধাবমান হইলেন। কেবল অস্ত্রবলশ্লাঘী একমাত্র কর্ণ তৎকালে ব্যথিত না হইয়া শরনিকরে সেই রাক্ষসকৃত মায়া নিরাকৃত করিলেন। মহাবীর ঘটোৎকচ মায়া বিফল হইল দেখিয়া একান্ত ক্রোধাবিষ্টচিত্তে সূতপুত্রের সংহারার্থ শরজাল বিস্তার করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। রাক্ষসনিক্ষিপ্ত শরসমুদয় কর্ণের কলেবর ভেদপূর্ব্বক রুধিরলিপ্ত হইয়া ক্রুদ্ধ ভুজঙ্গের ন্যায় ধরণীতলে প্রবেশ করিতে লাগিল। তখন সূতপুত্র ক্রোধাবিষ্ট হইয়া বলবীর্য্যে ঘটোৎকচকে অতিক্রম করিয়া দশশরে তাঁহাকে বিদ্ধ করিলেন। মহাবীর ঘটোৎকচ কর্ণপ্রহিত শরনিকরে মর্ম্মদেশে বিদ্ধ হইয়া ব্যথিতমনে কর্ণসংহারার্থ এক সহস্র অরসম্পন্ন, নবোদিত দিবাকরসদৃশ, মণিরত্ন-বিভূষিত, ক্ষুরধার, দিব্যচক্র গ্রহণপূর্ব্বক তাঁহার উপর নিক্ষেপ করিলেন। মহাবীর কর্ণ সেই রাক্ষসনিক্ষিপ্ত চক্র শরনিকরে খণ্ড খণ্ড করাতে উহা হতভাগ্য পুরুষের মনোরথের ন্যায় নিষ্ফল হইয়া ভূতলে নিপতিত হইল। ঘটোৎকচ তদ্দর্শনে ক্রোধাবিষ্ট হইয়া, রাহু যেমন দিবাকরকে আচ্ছন্ন করিয়া থাকে, তদ্রূপ শরনিকরে কর্ণকে সমাচ্ছন্ন করিতে লাগিল। রুদ্র, ইন্দ্র ও উপেন্দ্রের তুল্য বিক্রমশালী মহাবীর কর্ণও অসম্ভ্রান্ত হইয়া সত্বর শরনিকর বিস্তারপূর্ব্বক ঘটোৎকচের রথ সমাচ্ছন্ন করিলেন। তখন ঘটোৎকচ তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া এক হেমাঙ্গদ বিভূষিত গদা নিক্ষেপ করিলেন। মহাবীর কর্ণ উহা শরনিকরদ্বারা ভ্রমণ করাইয়া ভূতলে নিপাতিত করিলেন। অনন্তর মহাবীর ঘটোৎকচ অন্তরীক্ষে উত্থিত হইয়া কৃষ্ণমেঘের ন্যায় গভীর গর্জ্জনপূর্ব্বক বৃক্ষবৃষ্টি করিতে লাগিলেন।

“তখন মহাবীর কর্ণ সূর্য্যরশ্মি যেমন জলদজাল বিদ্ধ করে, তদ্রূপ নভঃস্থিত [আকাশস্থিত] মায়াবী ভীমসেনতনয়কে বিদ্ধ করিলেন। তৎপরে তাঁহার অশ্বগণকে বিনাশ ও রথ শতধা চূর্ণ করিয়া ধারাবর্ষী জলধরের ন্যায় তাঁহার উপর শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন। ঐ সময় ঘটোৎকচের গাত্রে কর্ণশরে অনির্ভিন্ন অঙ্গুলিত্রয় মাত্রও স্থান রহিল না। তাঁহাকে তৎকালে লোমযুক্ত শল্লকীর ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। ঐ মহাবীর কর্ণের শরজালে এরূপ সমাচ্ছন্ন হইয়াছিলেন যে, উহার কলেবর, অশ্ব, রথ বা ধ্বজ কিছুই লক্ষিত হইল না। তখন মায়াবী ঘটোৎকচ স্বীয় অস্ত্রদ্বারা কর্ণের দিব্যাস্ত্র দূরীকৃত করিয়া তাঁহার সহিত মায়াযুদ্ধ আরম্ভ করিলেন। আকাশমণ্ডল হইতে অলক্ষিতরূপে শরজাল নিপতিত হইতে লাগিল। রাক্ষস মায়াবলে স্বয়ং বিকৃতাকার হইয়া কৌরবসৈন্যগণকে মুগ্ধ করিয়া বিচরণপূর্ব্বক প্রথমতঃ বিকটকার মুখব্যাদানপূর্ব্বক সূতপুত্রের দিব্যাস্ত্রনিকর গ্রাস করিলেন এবং তৎপরেই শতধা সম্ভিন্নদেহ [ভগ্নগাত্র] গতাসুর ন্যায় নিশ্চেষ্ট হইয়া ভূতলে নিপতিত হইলেন। তদ্দর্শনে সমস্ত কুরুপুঙ্গবেরা তাঁহাকে নিহত বোধে সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর ভীমতনয় অনতিবিলম্বেই আবার দিব্য নূতন দেহ ধারণ করিয়া চতুর্দ্দিকে ভ্রমণপূর্ব্বক কখন মৈনাকপর্ব্বতের ন্যায় শতশীর্ষ, শতোদর ও বৃহদাকার ধারণ ও কখন বা অঙ্গুলি প্রমাণ রূপ ধারণপূর্ব্বক উদ্ধৃত বীচিমালার ন্যায় বক্রভাবে উর্ধ্বে অবস্থান, কখন বসুধা বিদারণপূর্ব্বক সলিলপ্রবেশ, কখন অন্যস্থানে নিমগ্ন হইয়া পুনরায় যথাস্থানে উত্থান করিতে লাগিলেন।

“পরে বর্ম্মধারী হিড়িম্বাতনয় পুনরায় সুবর্ণমণ্ডিত রথে আরোহণ এবং পৃথিবী, আকাশ ও দিঙ্মণ্ডল ভ্রমণ করিয়া কর্ণসমীপে গমনপূর্ব্বক নির্ভীকচিত্তে কহিলেন, ‘হে সূতপুত্র! এই স্থানে অবস্থান কর। জীবিতাবস্থায় আমার হস্ত হইতে বিমুক্ত হইবে না। আজই তোমার রণকুণ্ডু [রণলিপ্সা] নিরাকৃত করিব।’ ক্রুরপরাক্রম রাক্ষসেন্দ্র এই বলিয়া রোষকষায়িতলোচনে আকাশমার্গে উত্থিত হইয়া অট্ট অট্ট হাস্য করিতে লাগিলেন এবং কেশরী যেমন গজেন্দ্রকে আঘাত করে, তদ্রূপ মহাবীর কর্ণকে রথাক্ষসদৃশ শরনিকরে বিদ্ধ করিতে আরম্ভ করিলেন। এইরূপে ঘটোৎকচ কর্ণের উপর বারিধারার ন্যায় শরধারা বর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলে মহাবীর কর্ণ দূর হইতেই সেই শরনিকর ছেদন করিয়া ফেলিলেন।

“হিড়িম্বাতনয় সেই মায়া নিহত [নিষ্ফল] হইল দেখিয়া পুনরায় মায়াপ্রভাবে অন্তর্হিত হইয়া অবিলম্বে উত্তুঙ্গশৃঙ্গ ও তরুনিচয়সমাযুক্ত উন্নতপর্ব্বতরূপ ধারণ করিলেন। অসংখ্য শূল, প্রাস, অসি ও মূষল উহার প্রস্রবণস্বরূপ হইল। মহাবীর কর্ণ সেই উগ্র আয়ুধপ্রপাতযুক্ত [অস্ত্রধারা] মহীধর দর্শনে কিছুমাত্র ক্ষুব্ধ হইলেন না, প্রত্যুত দিব্যাস্ত্র প্রয়োগপূর্ব্বক সেই শৈলেন্দ্রকে বিনষ্ট করিলেন। অনন্তর ঘটোৎকচ আকাশমার্গে গমনপূর্ব্বক ইন্দ্রায়ুধসম্বলিত নীলমেঘরূপ ধারণ করিয়া সূতপুত্রের উপর প্রস্তরবৃষ্টি করিতে লাগিলেন। তখন অস্ত্রবিদ্‌গণের অগ্রগণ্য কৰ্ণ বায়ব্য-অস্ত্র সন্ধানপূর্ব্বক সেই কৃষ্ণমেঘরূপ নিশাচরকে আহত করিয়া শরনিকরে দশদি সমাচ্ছন্ন করিয়া তন্নিক্ষিপ্ত অস্ত্রসমুদয় সংহার করিয়া ফেলিলেন। তখন মহাবলপরাক্রান্ত ভীমসেনকুমার হাস্য করিয়া মহারথ কর্ণের নিকট মহামায়া প্রকাশ করিলেন। সেই মায়াভাবে মহাবীর কর্ণ সিংহশালসদৃশ, মত্তমাতঙ্গবিক্রম, বর্ম্মাস্ত্রধারী রাক্ষসগণে পরিবেষ্টিত ঘটোৎকচকে দেবগণপরিবৃত দেবরাজের ন্যায় আগমন করিতে দেখিয়া তাঁহার সহিত যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। রাক্ষস পাঁচবাণে কর্ণকে বিদ্ধ করিয়া কৌরবপক্ষীয় ভূপালগণের ভয় উৎপাদনপূর্ব্বক ভীষণ শব্দ করিয়া পুনর্ব্বার অঞ্জলিকদ্বারা কর্ণের শরজাল ও করস্থ শরাসন ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তখন কর্ণ সমুচ্ছ্রিত ইন্দ্রায়ুধসদৃশ অন্য ভারসহ শরাসন গ্রহণ করিয়া আকর্ষণপূর্ব্বক আকাশচর নিশাচরদিগের প্রতি সুবর্ণপুঙ্খ শত্রুঘাতন শরনিকর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। রাক্ষসগণ কর্ণের তীক্ষ্ণসায়কে সিংহার্দ্দিত গজযূথের ন্যায় নিতান্ত নিপীড়িত হইল। যুগান্ত সময়ে হুতাশন। যেমন জীবগণকে দগ্ধ করিয়া থাকে, তদ্রূপ মহাবীর সূতনন্দন অশ্ব, সারথি ও গজসমবেত রাক্ষসগণকে শরানলে দগ্ধ করিতে লাগিলেন। পূর্ব্বকালে মহেশ্বর ত্রিপুরাসুরকে সংহার করিয়া যেমন শোভা পাইয়াছিলেন, মহাবীর সূতনন্দন সেই রাক্ষসীসেনা সংহার করিয়া তদ্রূপ শোভমান হইলেন। পাণ্ডবপক্ষীয় সহস্র সহস্র নৃপগণমধ্যে ভীমপরাক্রম, ক্রুদ্ধ, অন্তকসদৃশ, রাক্ষসেন্দ্র ঘটোৎকচ ভিন্ন আর কেহই কর্ণকে নিরীক্ষণ করিতে সমর্থ হইল না। দুই মহোল্কা [বড় মশাল] হইতে যেমন অগ্নিযুক্ত তৈলবিন্দু নিপতিত হয়, তদ্রূপ ক্রুদ্ধ ভীমতনয়ের নেত্রদ্বয় হইতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হইতে লাগিল। তখন তিনি করতলশব্দ ও অধরদংশনপূর্ব্বক গজসদৃশ গর্দ্দভসংযুক্ত, মায়ানির্মিত রথে আরোহণ করিয়া সারথিকে কহিলেন, ‘হে সারথে! তুমি শীঘ্র আমাকে কর্ণনিকটে লইয়া চল।’

“হে মহারাজ! ভীমকুমার এইরূপে ঘোররূপ রথে আরোহণপূর্ব্বক পুনর্ব্বার কর্ণের সহিত দ্বৈরথযুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া তাঁহার প্রতি শিবনির্মিত অষ্টচক্র অশনি নিক্ষেপ করিলেন। মহাবীর কর্ণ তদ্দর্শনে তৎক্ষণাৎ রথে শরাসনসন্ধানপূর্ব্বক ভূতলে অবতীর্ণ হইয়া সেই অশনি ধারণ করিয়া তাঁহার উপরেই পরিত্যাগ করিলেন। নিশাচর তৎক্ষণাৎ রথ হইতে ভূতলে নিপতিত হইলেন। তখন সেই জ্যোতির্ম্ময়-অশনি ঘটোৎকচের অশ্ব, সারথি ও ধ্বজসমবেত রথ ভষ্মীকৃত করিয়া বসুধা ভেদপূর্ব্বক পাতালতলে প্রবেশ করিল। দেবগণ তদ্দর্শনে সাতিশয় বিষ্ময়াপন্ন হইলেন। মহাবীর কর্ণ দেবসৃষ্ট মহাশনি ধারণ করিয়াছেন বলিয়া সকলেই তাঁহাকে প্রশংসা করিতে লাগিল। হে মহারাজ! মহাবীর কর্ণ সেই দুষ্কর কর্ম্ম সমাধান করিয়া পুনরায় স্বীয় রথে আরোহণপূর্ব্বক শরবর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলেন। সেই ভীমদর্শন সংগ্রামে তিনি যেরূপ অদ্ভুত কাৰ্য্য করিলেন, অন্য কোন ব্যক্তি তাহা করিতে সমর্থ নহে।

“তখন সেই বিপুলকলেবর ভয়ঙ্কর রাক্ষস কর্ণনিক্ষিপ্ত নারাচনিকরে সমাচ্ছন্ন হইয়া বারিধারাচ্ছন্ন পর্ব্বতের ন্যায় শোভা ধারণপূর্ব্বক পুনরায় অন্তর্হিত হইয়া মায়া ও লঘুহস্ততাপ্রভাবে কর্ণের দিব্যাস্ত্রসমূহ সংহার করিতে লাগিলেন। এইরূপে রাক্ষসের মায়াপ্রভাবে অস্ত্রসমুদয় বিনষ্ট হইলে কর্ণ অসম্ভ্রান্তচিত্তে তাঁহার সহিত যুদ্ধ করিতে আরম্ভ করিলেন। বলবান্ ভীমতনয় তদ্দর্শনে কোপাবিষ্ট হইয়া মহারথীগণকে ভীত করিয়া স্বয়ং অসংখ্য রূপ ধারণ করিতে লাগিলেন। তখন নানা দিক হইতে সিংহ, ব্যাঘ্র, তরক্ষু, অগ্নিজিহ্ব ভুজঙ্গম ও অয়োমুখ বিহঙ্গমগণ সমরাঙ্গনে আগমন করিতে আরম্ভ করিল। হিমালয়সদৃশ নিশাচর কর্ণচাপচ্যুত শরনিকরে সমাচ্ছন্ন হইয়া সেই স্থানেই অন্তর্হিত হইলেন। ঐ সময় অসংখ্য রাক্ষস, পিশাচ, শালাবৃক [বিড়াল বানর-শৃগাল কুকুর প্রভৃতি] ও বিকৃত্যানন বৃকগণ কর্ণকে ভক্ষণ করিবার নিমিত্ত মহাবেগে আগমনপূর্ব্বক উগ্ররবে তাঁহাকে ভীত করিতে লাগিল। তখন মহাবীর কর্ণ শোণিতোক্ষিত বিবিধ আয়ুধদ্বারা তাঁহাদিগের প্রত্যেককে বিদ্ধ করিয়া দিব্যাস্ত্রে রাক্ষসীমায়া সংহারপূর্ব্বক নতপর্ব্বশরজালে ঘটোৎকচের অশ্বসমূহ সমাহত করিলেন। অশ্বগণ কর্ণের শরাঘাতে ভগ্ন, বিকৃতাঙ্গ ও ছিন্নপৃষ্ঠ হইয়া ঘটোৎকচের সমক্ষেই ধরাতলে নিপতিত হইল। তখন সেই নিশাচর এইরূপে সেই মায়া বিফল হইল দেখিয়া কর্ণকে ‘এই তোমার মৃত্যুবিধান করিতেছি’ বলিয়া তৎক্ষণাৎ অন্তর্হিত হইলেন।”