১৬০. অশ্বত্থামার অভিযান

১৬০তম অধ্যায়

অশ্বত্থামার অভিযান

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! যুদ্ধদুর্ম্মদ দ্রোণনন্দন অশ্বত্থামা দুর্য্যোধনকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া দেবরাজ দৈত্যবধে যেরূপ যত্ন করিয়াছিলেন, তদ্রূপ অরাতিনিপাতনে যত্নবান হইলেন এবং আপনার পুত্র মহাবীর দুর্য্যোধনকে কহিলেন, “হে মহাবাহো! পাণ্ডবেরা যে আমার পিতার নিতান্ত প্রিয় এবং আমরা পিতাপুত্রও যে তাঁহাদিগের প্রীতিভাজন, তাহাতে সন্দেহ নাই; কিন্তু সংগ্রামসময়ে সেরূপ হওয়া নিতান্ত অসম্ভব। আমি কর্ণ, শল্য, কৃপ ও হার্দ্দিক্যের সহিত মিলিত হইয়া নিঃশঙ্কচিত্তে প্রাণপণে যুদ্ধ করিয়া নিমেষমধ্যে পাণ্ডবসেনাগণকে সংহার করিতে পারি। আর যদি আমরা সংগ্রামে উপস্থিত না থাকি, তাহা হইলে পাণ্ডবগণও দ্রোণ নিমেষমধ্যে কৌরবসেনা নিঃশেষিত করিতে পারে; কিন্তু আমরা উভয়পক্ষেই সাধ্যানুসারে যুদ্ধ করিতেছি বলিয়া পরস্পরের তেজঃপ্রভাবে পরস্পরের তেজঃ প্রশমিত হইতেছে। যাহা হউক, আমি নিশ্চয় কহিতেছি, পাণ্ডবগণ জীবিত থাকিতে বলপূর্ব্বক বিপক্ষসেনা পরাজিত করা নিতান্ত দুঃসাধ্য। বলবীৰ্য্যশালী পাণ্ডুপুত্রগণ আপনাদের নিমিত্ত যুদ্ধ করিতেছে; অতএব তাহারা কেন না তোমার সৈন্যগণকে বিনষ্ট করিবে? তুমি নিতান্ত লুব্ধ, নিকৃতিপরতন্ত্র, সর্ব্ববিষয়ে শঙ্কিত, অভিমানী ও পাপাত্মা; এই নিমিত্তই সতত আমাদিগের প্রতি আশঙ্কা করিয়া থাক। যাহা হউক, আমি জীবিতাশা পরিত্যাগপূর্ব্বক যত্নবান হইয়া তোমার নিমিত্ত সংগ্রামে গমন করিতেছি। অদ্য আমি তোমার হিতসাধনার্থ পাঞ্চাল, সোমক, কেকয় ও পাণ্ডবগণের সহিত যুদ্ধ করিয়া অনেক শত্রুর প্রাণসংহার করিব। অদ্য চেদি, পাঞ্চাল ও সোমকগণ আমার শরে দগ্ধ হইয়া সিংহার্দ্দিত গোসমূহের ন্যায় চতুর্দ্দিকে ধাবমান হইবে। অদ্য আমি সংগ্রামে এরূপ পরাক্রম প্রকাশ করিব যে, ধর্ম্মনন্দন রাজা যুধিষ্ঠির ও সোমকগণ ইহলোক দ্রোণপুত্রময় অবলোকন করিবে। ধর্ম্মনন্দন পাঞ্চাল ও সোমকগণকে আমার বাণে সংগ্রামে নিহত দেখিয়া যারপরনাই বিষণ্ন হইবে। ফলতঃ অদ্য যে যে বীর আমার সহিত সংগ্রামে সমাগত হইবে, তাহাদের সকলকেই সংহার করিব। তাহারা কদাচ আমার হস্ত হইতে পরিত্রাণ পাইবে না।

ধৃষ্টদ্যুম্নসহ অশ্বত্থামার যুদ্ধ

“হে মহারাজ! মহাবাহু অশ্বত্থামা আপনার পুত্র দুর্য্যোধনকে এইরূপ কহিয়া তাহার হিতের নিমিত্ত ধনুর্দ্ধরদিগকে বিদ্রাবণপূর্ব্বক রণক্ষেত্রে আগমন করিতে লাগিলেন এবং কৈকেয় ও পাঞ্চালগণকে কহিলেন, ‘হে মহারথগণ! তোমরা স্থিরচিত্তে যুদ্ধ করিয়া হস্তলাঘবপ্রদর্শনপূর্ব্বক আমাকে প্রহার কর। বীরগণ দ্রোণপুত্ৰকৰ্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া বারিধারাবর্ষী জলধরের ন্যায় সকলেই তাঁহার উপর অবিরল শরবৃষ্টি করিতে লাগিল। তখন মহাবীর অশ্বত্থামা ধৃষ্টদ্যুম্ন ও পাণ্ডুতনয়দিগের সমক্ষেই তাহাদিগকে শরনিকরে নিপীড়িত করিয়া তাহাদের দশজনকে ভূমিসাৎ করিলেন। পাঞ্চাল ও সোমকগণ অশ্বত্থামার শরে তাড়িত হইয়া তাঁহাকে পরিত্যাগপূর্ব্বক চারিদিকে পলায়ন করিতে লাগিল। মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন তাহাদিগকে পলায়ন করিতে দেখিয়া মেঘগম্ভীরনিঃস্বন সুবর্ণলঙ্কারভূষিত সমরে অপরাঙ্মুখ একশত রথারোহীসৈন্যে পরিবেষ্টিত হইয়া দ্রোণপুত্রের প্রতি। গমনপূর্ব্বক তাঁহাকে কহিতে লাগিলেন, ‘হে নির্বোধ আচাৰ্য্যপুত্র! সামান্য যোধগণকে বিনাশ করিলে কি হইবে? যদি বীরপুরুষ হও, তবে আমার সহিত যুদ্ধ আরম্ভ কর, আমি অবিলম্বেই তোমার প্রাণসংহার করিব; তুমি ক্ষণকাল অবস্থান কর।’ প্রবলপ্রতাপশালী ধৃষ্টদ্যুম্ন এই বলিয়া অশ্বত্থামার প্রতি মর্ম্মভেদী সুতীক্ষ্ণ শর নিক্ষেপ করিলেন। মধুলোলুপ ভ্রমরগণ যেমন শ্রেণীবদ্ধ হইয়া পুষ্পিতবৃক্ষে গমন করে, তদ্রূপ সেই ধৃষ্টদ্যুম্ননিক্ষিপ্ত সুবর্ণপুঙ্খ শরসকল শ্রেণীবদ্ধ হইয়া অশ্বত্থামার শরীরে প্রবেশ করিল। তখন শরপাণি মহাবীর দ্রোণপুত্র এইরূপে অতিমাত্র বিদ্ধ হইয়া পদাহত পন্নগের ন্যায় ক্রোধভরে অসন্ত্রস্তচিত্তে কহিতে লাগিলেন, হে ধৃষ্টদ্যুম্ন! তুমি স্থির হইয়া মুহূর্ত্তকাল অপেক্ষা কর; আমি অবিলম্বেই নারাচদ্বারা তোমাকে যমরাজের রাজধানীতে প্রেরণ করিব।’

“অরাতিনিপাতন অশ্বত্থামা ধৃষ্টদ্যুম্নকে এইরূপ কহিয়া তাঁহাকে একেবারে শরনিকরে সমাচ্ছন্ন করিলেন। যুদ্ধদুর্ম্মদ পাঞ্চালতনয়। দ্রোণপুত্রের শরনিকরে এইরূপে সমাচ্ছন্ন হইয়া তাঁহাকে তর্জ্জন করিয়া কহিলেন, “হে বিপ্রতনয়! তুমি আমার প্রতিজ্ঞা ও উৎপত্তির বিষয় অবগত নহ! আমি অগ্রে দ্রোণকে নিহত করিয়া পশ্চাৎ তোমাকে বিনাশ করিব বলিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়াছি; তন্নিমিত্ত দ্রোণ জীবিত থাকিতে তোমাকে বিনাশ করিলাম না। আমার অভিপ্রায় এই যে, এই রজনী সুপ্রভাত হইলে অগ্রে তোমার পিতাকে বিনাশ করিয়া পশ্চাৎ তোমাকে শমনসদনে প্রেরণ করিব; অতএব এই সময়ে স্থিরচিত্তে পাণ্ডবগণের প্রতি শেষ বিদ্বেষবুদ্ধি ও কৌরবগণের প্রতি ভক্তি প্রদর্শন কর। তুমি জীবিত থাকিতে কখনই আমার নিকট পরিত্রাণ পাইবে না। হে নরাধম! যে ব্রাহ্মণ ব্রহ্মানুষ্ঠান পরিত্যাগপূর্ব্বক ক্ষাত্রধর্ম্মানুষ্ঠানে তৎপর হয়, তোমার ন্যায় সে ক্ষত্রিয়েরই বধ্য হইয়া থাকে।’

“হে মহারাজ! ধৃষ্টদ্যুম্ন এইরূপে কটুবাক্য প্রয়োগ করিলে দ্বিজোত্তম অশ্বত্থামা তাঁহাকে ‘তিষ্ঠ তিষ্ঠ’ বলিয়া ক্ৰোধারুণলোচনে দগ্ধ করিয়াই যেন ভীষণ ভুজঙ্গের ন্যায় নিশ্বাসপরিত্যাগপূর্ব্বক শরনিকরে সমাচ্ছন্ন করিতে লাগিলেন। পাঞ্চালসেনাপরিবৃত মহারথ ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণপুত্রের শরনিপাতে নিপীড়িত হইয়া কিছুমাত্র কম্পিত হইলেন না; প্রত্যুত স্বীয় ভুজবল অবলম্বন করিয়া অশ্বত্থামার উপর শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন। এইরূপে সেই রোষপরায়ণ মহাধনুর্দ্ধর বীরদ্বয় প্রাণপণে পরস্পর শরসন্নিপাত নিবারণ ও চারিদিকে বাণবৃষ্টি করিতে আরম্ভ করিলেন। সিদ্ধচারণ প্রভৃতি আকাশগামীগণ অশ্বত্থামা ও ধৃষ্টদ্যুম্নের এইরূপ ঘোরতর ভয়ানক যুদ্ধ দর্শন করিয়া তাঁহাদের প্রশংসা করিতে লাগিলেন। তখন সেই পরস্পরবধার্থী বিকটবেশ বীরদ্বয় শরনিকরে দশদিক্‌ সমাচ্ছন্ন করিয়া অলক্ষিতরূপে অতি সুন্দর যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। তৎকালে বোধ হইল যেন, তাঁহারা কার্মুক মণ্ডলীকৃত করিয়া নৃত্য করিতেছেন। এইরূপে তাঁহারা পরস্পর বধে কৃতসঙ্কল্প হইয়া অত্যাশ্চর্য্য ঘোরতর যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। যোধগণ তাঁহাদিগকে অরণ্যমধ্যস্থ মাতঙ্গদ্বয়ের ন্যায় যুদ্ধে প্রবৃত্ত মহা দেখিয়া সবিশেষ প্রশংসা করিতে আরম্ভ করিলেন। হে মহারাজ! সেই ভীরুজনের ভয়জনক তুমুল যুদ্ধকালে উভয়পক্ষীয় সৈন্যগণ একান্ত হৃষ্ট হইয়া সিংহনাদ পরিত্যাগ, শঙ্খধ্বনি ও নানাবিধ বাদ্য বাদন করিতে লাগিল। ঐ যুদ্ধে কিয়ৎক্ষণ কাহারও জয়পরাজয় লক্ষিত হইল না।

‘অনন্তর মহাবীর অশ্বত্থামা মহাত্মা ধৃষ্টদ্যুম্নের কোদণ্ড, ধ্বজদণ্ড, ছত্র, অশ্বচতুষ্টয়, পার্শ্বরক্ষকদ্বয় ও সারথিকে ছেদন করিয়া সন্নতপর্ব্ব শরনিকর বিস্তারপূর্ব্বক সহস্র সহস্র পাঞ্চালসৈন্য বিদ্রাবিত করিতে লাগিলেন। পাণ্ডবসৈন্যগণ দেবরাজ ইন্দ্রের ন্যায় অশ্বত্থামার সেই অদ্ভুতকার্য্য নিরীক্ষণ করিয়া একান্ত ব্যথিত হইল। তখন অশ্বত্থামা এককালে এক এক শত শরে এক এক শত পাঞ্চালকে ও সুশাণিত তিন তিন শরে তিন তিন মহাবীরকে সংহার করিয়া ধৃষ্টদ্যুম্ন ও অর্জ্জুনের সমক্ষেই বহুসংখ্যক পাঞ্চালকে বিনাশ করিলেন। ঘোরতর যুদ্ধে অভিনিবিষ্ট পাঞ্চাল ও সৃঞ্জয়গণ অশ্বত্থামার শরনিকরে নিতান্ত নিপীড়িত তাঁহাকে পরিত্যাগপূর্ব্বক ইতস্ততঃ ধাবমান হইল। তাঁহাদিগের রথধ্বজসমুদয় ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হইতে লাগিল।

“হে মহারাজ! এইরূপে মহারথ অশ্বত্থামা শত্রুগণকে পরাজিত করিয়া বর্ষাকালীন নীরদের ন্যায় গভীর গর্জ্জন করিতে আরম্ভ করিলেন। হুতাশন যেমন যুগান্তকালে ভূতসমুদয়কে ভস্মসাৎ করিয়া সংহার করিয়া থাকে, তদ্রূপ দ্রোণমুক্ত বহুসংখ্যক বীরগণকে সংহার করিয়া ফেলিলেন। তখন কৌরবগণ সেই অরাতিনিপাতন সুররাজসদৃশ দ্রোণপুত্রকে যথোচিত প্রশংসা করিতে লাগিলেন।”