১৭৫. ঘটোৎকচবধার্থ দুঃশাসনসহ অলম্বলনিয়োগ

১৭৫তম অধ্যায়

ঘটোৎকচবধার্থ দুঃশাসনসহ অলম্বলনিয়োগ

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! ঐ সময় রাজা দুর্য্যোধন ঘটোৎকচকে সূতপুত্রের বিনাশবাসনায় গমন করিতে দেখিয়া দুঃশাসনকে কহিলেন, ‘হে ভ্রাতঃ! ঐ দেখ, রাক্ষসেন্দ্র ঘটোৎকচ কর্ণের বিক্রম দর্শন করিয়া উহার প্রতি ধাবমান হইতেছে; অতএব মহাবলপরাক্রান্ত কর্ণ যে স্থলে ঘটোৎকচের সহিত যুদ্ধার্থ প্রস্তুত হইয়াছেন, তুমি সসৈন্য তথায় গমনপূর্ব্বক যত্নসহকারে তাঁহাকে রক্ষা কর। ভীমতনয় যেন কর্ণকে প্রমাদকালে [রাক্ষসীমায়ায় উদ্ভূত ভ্রান্তিসময়ে] সংহার করিতে সমর্থ না হয়।’ হে মহারাজ! দুর্য্যোধন দুঃশাসনকে এই কথা কহিতেছেন, ইত্যবসরে মহাবলপরাক্রান্ত বীরাগ্রগণ্য জটাসুরতনয় অলম্বল তাঁহার নিকট আগমন করিয়া কহিল, ‘হে রাজন! আমি আপনার বিখ্যাত শত্রু যুদ্ধদুর্ম্মদ পাণ্ডবদিগকে অনুচরগণের সহিত বিনাশ করিতে বাসনা করি, আপনি অনুগ্রহপূর্ব্বক অনুজ্ঞা প্রদান করুন। পূর্ব্বে ক্ষুদ্রাশয় কুন্তীপুত্রেরা আমার পিতা রাক্ষসপ্রধান জটাসুরকে নিপাতিত করিয়াছিল। অতএব আপনি অনুজ্ঞা প্রদান করিলে আজ আমি শত্রুগণের শোণিত ও মাংসদ্বারা তাঁহাকে পূজা করিয়া তাঁহার ঋণ হইতে বিমুক্ত হইব।’

“হে মহারাজ! রাজা দুর্য্যোধন জটাসুরতনয়ের বাক্য শ্রবণে অতিশয় প্রীত হইয়া বারংবার তাহাকে কহিতে লাগিলেন,—‘হে রাক্ষসে! আমি দ্রোণাচাৰ্য্য ও কর্ণপ্রমুখ মহাবীরগণের সাহায্যে অনায়াসে পাণ্ডববিনাশে সমর্থ হইব। এক্ষণে তোমাকে অনুমতি প্রদান করিতেছি যে, তুমি শীঘ্র ঘটোৎকচকে বিনাশ কর। ঐ মানুষসম্ভূত দুরাত্মা রাক্ষস অতি ক্রূরকর্ম্মা এবং নিরন্তর পাণ্ডবগণের হিতসাধনে তৎপর। ঐ দুরাত্মা আকাশমার্গে অবস্থানপূর্ব্বক আমাদিগের হস্তী, অশ্ব ও রথসকল চূর্ণ করিতেছে; অতএব উহাকে যমরাজপুরে প্রেরণ কর।

“অনন্তর মহাকায় জটাসুরতনয় দুর্য্যোধনের বাক্য স্বীকার করিয়া ভীমপুত্ৰ ঘটোৎকচকে আহ্বানপূর্ব্বক তাঁহার উপর নানাপ্রকার শরনিক্ষেপ করিতে লাগিল। তখন হিড়িম্বাতনয় একাকী প্রবল বাত্যা যেমন মেঘমণ্ডলকে ছিন্নভিন্ন করিয়া ফেলে, তদ্রূপ অলম্বল, কর্ণ ও বহুসংখ্যক কুরুসৈন্যগণকে মথিত করিতে আরম্ভ করিলেন। মহাবীর অলম্বল ঘটোৎকচের মায়াবল নিরীক্ষণপূর্ব্বক তাঁহাকে নানা লক্ষণসমাযুক্ত শরনিকরে বিদ্ধ করিয়া পাণ্ডবসৈন্যগণকে বিভ্রাবিত করিতে লাগিল। পাণ্ডবসৈন্যগণ সমীরণসঞ্চালিত জলদজালের ন্যায় চতুর্দ্দিকে ছিন্নভিন্ন হইয়া পড়িল। এদিকে আপনার সৈন্যগণও ঘটোৎকচের শরে ক্ষতবিক্ষত হইয়া প্রদীপ পরিত্যাগপূর্ব্বক সেই অন্ধকারে পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল। তখন মহাবীর অলম্বল রোষপরবশ হইয়া, হস্তিপক যেমন অঙ্কুশদ্বারা মাতঙ্গকে বিদ্ধ করে, তদ্রূপ ঘটোৎকচকে শরনিকরে বিদ্ধ করিতে লাগিল। মহাবীর ঘটোৎকচ তদ্দর্শনে ক্রুদ্ধ হইয়া অলম্বলের রথ, সারথি ও সমস্ত আয়ুধ খণ্ড খণ্ড করিয়া অট্ট অট্ট হাস্যপূর্ব্বক মেঘ যেমন সুমেরুপর্ব্বতোপরি বারি বর্ষণ করে, তদ্রূপ কর্ণ, অলম্বল ও কৌরবগণের উপর শরধারা বর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলেন। হে মহারাজ! আপনার চতুরঙ্গ বল হিড়িম্বাতনয়ের শরনিকরে নিপীড়িত ও সাতিশয় ক্ষুব্ধ হইয়া পরস্পরকে মর্দ্দিত করিতে লাগিল। তখন রথ ও সারথিবিহীন জটামুরতনয় ক্রোধভরে ঘটোৎকচকে মুষ্টিপ্রহার করিল। মহাবীর ঘটোৎকচ সেই জটাসুরতনয়ের মুষ্টিপ্রহারে আহত হইয়া ভূমিকম্পকালীন বৃক্ষ, তৃণ ও গুল্মসমাযুক্ত অচুলের ন্যায় বিচলিত হইলেন এবং অর্গলপ্রতিম বাহু সমুদ্যত করিয়া অগ্রসর হইয়া তাহার উপর মুষ্টিপ্রহার করিলেন; পরে ভুজযুগলদ্বারা তাহাকে আকর্ষণপূর্ব্বক ভূতলে নিক্ষেপ করিয়া নিষ্পিষ্ট করিতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে অলম্বল ঘটোৎকচের হস্ত হইতে মুক্ত হইয়া গাত্রোত্থানপূর্ব্বক পুনরায় তাঁহার প্রতি ধাবমান হইল এবং তাঁহাকে উৎক্ষেপণপূর্ব্বক ভূতলে নিক্ষেপ করিয়া নিষ্পিষ্ট করিতে আরম্ভ করিল। এইরূপে সেই বৃহদাকার বীরদ্বয়ের লোমহর্ষণ তুমুল যুদ্ধ উপস্থিত হইল।

ঘটোৎকচকর্ত্তৃক অলম্বলবধ

“অনন্তর তাহারা মায়াজাল বিস্তারপূর্ব্বক পরস্পরকে অতিশয়িত করিয়া ইন্দ্র ও বলীর ন্যায় ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ করিল। সেই বীরদ্বয় পরস্পর বধার্থী হইয়া কখন পাবক ও অম্বুনিধি, কখন গরুড় ও তক্ষক, কখন মহামেঘ ও প্রবল বায়ু, কখন বজ্র ও ভূধর, কখন কুঞ্জর ও শার্দুল এবং কখন বা রাহু ও ভাস্করের রূপ ধারণপূর্ব্বক বিবিধ মায়া প্রদর্শন করিয়া অতি আশ্চর্য্য যুদ্ধ করিতে লাগিল। তাহারা পরস্পরের উপর পরিঘ, গদা, প্রাস, মুদগর, পট্টিশ, মুষল ও পর্ব্বতশৃঙ্গ নিক্ষেপ এবং কখন রথারোহণে, কখন বা পাচারে পরিভ্রমণপূর্ব্বক পরস্পরের উপর অশ্ব ও গদা প্রহার করিতে লাগিল। অনন্তর মহাবীর ঘটোৎকচ অলম্বলের বিনাশবাসনায় উর্ধ্বে উত্থিত হইয়া শ্যেনপক্ষীর ন্যায় তাহার উপর নিপতিত হইলেন এবং অবিলম্বে তাহাকে ভূতলে নিপাতনপূর্ব্বক খড়্গপ্রহারে তাহার অতি ভীষণ রবসংযুক্ত বিকৃতদর্শন মস্তক ছেদন করিয়া ময়দানবনিপাতন মধুসূদনের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। হে মহারাজ! ভীমতনয় এইরূপে অলম্বলকে বিনাশ করিয়া কেশাকর্ষণপূর্ব্বক তাহার সেই রক্তাক্ত মস্তক লইয়া দুর্য্যোধনের নিকট গমন করিলেন এবং গর্বিতভাবে সেই বিকৃত মস্তক তাঁহার রথে নিক্ষেপপূর্ব্বক বর্ষাকালীন জলধরের ন্যায় ভীষণ গৰ্জন করিয়া কহিলেন, ‘হে ধৃতরাষ্ট্রতনয়! এই ত’ তোমার বলবিক্রমশালী বন্ধুকে বিনাশ করিলাম। এইরূপে কর্ণকে এবং তোমাকেও শমনভবনে প্রেরণ করিব। আমি যতক্ষণ কর্ণকে বিনাশ না করিতেছি, ততক্ষণ তুমি প্রীতমনে অবস্থান কর।’ হে মহারাজ! মহাবীর ভীমনন্দন এই বলিয়াই কর্ণসমীপে গমনপূর্ব্বক তাঁহার মস্তকে সুতীক্ষ্ণ শরনিকর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। অনন্তর কর্ণের সহিত ঘটোৎকচের বিস্ময়কর অতি ভীষণ যুদ্ধ আরম্ভ হইল।”

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! সেই নিশীথকালে মহাবীর কর্ণ ও ঘটোৎকচের কিরূপ যুদ্ধ হইল? আর সেই ভয়ঙ্কর রাক্ষসের আকার, রথ, অশ্ব ও আয়ুধসকল কি প্রকার? অশ্ব, ধ্বজ ও কার্মুকের প্রমাণ কিরূপ এবং উহার বর্ম্ম ও শিরস্ত্রাণই বা কি প্রমাণ? হে সঞ্জয়! তুমি সমস্তই অবগত আছ, এক্ষণে আমার নিকট কীৰ্ত্তন কর।”