১৮৬. দ্রোণাচার্য্যের দুৰ্য্যোধনতিরস্কার

১৮৬তম অধ্যায়

দ্রোণাচার্য্যের দুৰ্য্যোধনতিরস্কার

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! অনন্তর রাজা দুৰ্য্যোধন দ্রোণসন্নিধানে গমনপূর্ব্বক ক্রোধাবিষ্ট হইয়া তাঁহার হর্ষ ও তেজ সন্ধুক্ষিত [উদ্দীপিত] করিয়া কহিতে লাগিলেন, ‘হে আচাৰ্য্য! দীনমনাঃ শ্ৰমাপনোদনপ্রবৃত্ত অরাতিগণকে ক্ষমা করা লব্ধলক্ষ্য বীরপুরুষদিগের কর্ত্তব্য নহে। আমরা আপনার প্রিয়কার্য্য অনুষ্ঠান করিবার নিমিত্ত পাণ্ডবগণকে ক্ষমা করিয়াছিলাম, উহারা সেই অবসরে সমুদয় সমর-পরিশ্রম অপনোদন করিয়াছে। যাহা হউক, আপনি উহাদিগকে রক্ষা করিতেছেন বলিয়াই বারংবার উহাদিগের অভ্যুদয়লাভ হইতেছে এবং আমরা ক্রমশঃ তেজ ও বলবীর্য্যপরিশূন্য হইতেছি। হে ব্ৰহ্মন! আপনি ব্রহ্মাস্ত্র ও দিব্যাস্ত্র সমস্ত সম্যক অবগত আছেন। আমি সত্যই কহিতেছি, কি পাণ্ডবগণ, কি কৌরবগণ, কি অন্যান্য ধনুর্দ্ধরগণ, কেহই যুদ্ধকালে আপনার সদৃশ পরাক্রম প্রদর্শন করিতে সমর্থ নহে। আপনি দিব্যাস্ত্রজাল বিস্তার করিয়া দেব, দানব ও গন্ধর্ব্ব প্রভৃতি সমুদয় লোক উচ্ছিন্ন করিতে পারেন, সন্দেহ নাই। পাণ্ডবগণ আপনার পরাক্রমদর্শনে নিতান্ত ভীত হইয়াছে; কিন্তু তাহারা আপনার শিষ্য, এই বলিয়াই হউক বা আমার ভাগ্যদোষেই হউক আপনি তাহাদিগকে উপেক্ষা করিতেছেন।’

“হে মহারাজ! মহাবীর দ্রোণ আপনার আত্মজ দুৰ্য্যোধনকর্ত্তৃক এইরূপে তিরস্কৃত হইয়া ক্রোধভরে কহিলেন, ‘হে দুৰ্য্যোধন! আমি বৃদ্ধ হইয়াও সাধ্যানুসারে যুদ্ধ করিতেছি; আমি অস্ত্রবেত্তা, কিন্তু এই সমস্ত বীর অস্ত্রবিদ্যায় তাদৃশ সুনিপুণ নহে। বিজয়াভিলাষে এই সকলকে সংহার করিতে হইলে আমাকে নিতান্ত ক্ষুদ্রজনের ন্যায় কার্য্যানুষ্ঠান করিতে হইবে। যাহা হউক, এক্ষণে তুমি যাহা বিবেচনা করিতেছ, তাহা ভালই হউক বা মন্দই হউক, আমি তোমার বাক্যানুসারে তদনুরূপ কাৰ্য্য করিব, সন্দেহ নাই। আমি আয়ুধ স্পর্শ করিয়া শপথ করিতেছি যে রণস্থলে পরাক্রম প্রকাশপূর্ব্বক পাঞ্চালগণকে বিনাশ করিয়া কবচ পরিত্যাগ করিব। হে রাজন! তুমি মহাবীর ধনঞ্জয়কে পরিশ্রান্ত বিবেচনা করিতেছ; কিন্তু আমি তাহার প্রকৃত বলবীর্য্যের বিষয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। অর্জ্জুন রণস্থলে ক্রোধাবিষ্ট হইলে দেবতা, গন্ধর্ব্ব, যক্ষ বা রাক্ষসগণ তাহার বলবীৰ্য্য সহ্য করিতে সমর্থ নহেন। ঐ মহাবীর খাণ্ডবদাহসময়ে সুররাজ ইন্দ্রের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া শরনিকরবর্ষণপূর্ব্বক তাঁহাকে নিবারিত এবং বলদৃপ্ত যক্ষ, নাগ ও দানবদলকে দলিত করিয়াছিল, ইহা কিছুই তোমার অবিদিত নাই। ঐ মহাবীর তোমাদের ঘোষযাত্রাকালে চিত্রসেন প্রভৃতি গন্ধর্ব্বগণকে পরাজিত করিয়া তোমাদিগকে তাহাদের হস্ত হইতে বিমুক্ত করিয়াছিল। ঐ মহাবীর সুরগণেরও অজেয় নিবাতকবচ। ও হিরণ্যপুরবাসী সহস্র সহস্র দানবদিগকে পরাজিত করিয়াছে। অতএব সামান্য মনুষ্য কিরূপে মহাবলপরাক্রান্ত ধনঞ্জয়কে পরাজিত করিবে? হে রাজন্! তোমার সৈন্যসকল আমাদের বহুপ্রযত্নে সুরক্ষিত হইলেও ধনঞ্জয় তাহাদিগকে যেরূপে বিনাশ করিতেছে, তুমি তৎসমুদয় অবলোকন করিতেছ।

“হে মহারাজ! রাজা দুৰ্য্যোধন এইরূপে দ্রোণাচার্য্যকে অর্জ্জুনের প্রশংসাবাদে প্রবৃত্ত দেখিয়া ক্রোধভরে পুনরায় কহিলেন, ‘হে ব্ৰহ্মন্! আজ আমি, দুঃশাসন, কর্ণ ও মাতুল শকুনি, আমরা সৈন্যগণকে দুইভাগে বিভক্ত করিয়া অর্জ্জুনকে বিনাশ করিব।’ মহাত্মা দ্রোণাচার্য্য দুর্য্যোধনের বাক্যশ্রবণানন্তর হাস্যমুখে তাহাতে অনুমোদন করিয়া কহিতে লাগিলেন, ‘হে রাজন্ কোন্ ক্ষত্রিয় স্বীয় তেজঃপ্রভাবে প্রদীপ্ত ক্ষত্রিয়প্রধান অক্ষয় ধনঞ্জয়কে বিনাশ করিতে সমর্থ হইবে? ধনাধিপতি কুবের, দেবরাজ ইন্দ্র, জলেশ্বর বরুণ ও লোকান্তকর কৃতান্ত এবং অসুর, উরগ ও রাক্ষসগণও আয়ুধধারী অর্জ্জুনকে বিনাশ করিতে সমর্থ নহেন। হে বৎস! তুমি অর্জ্জুনকে লক্ষ্য করিয়া যাহা কহিলে, মূর্খেরাই ঐরূপ বাক্য প্রয়োগ করিয়া থাকে। মহাবীর অর্জ্জুনের সহিত সমরে প্রবৃত্ত হইয়া নির্ব্বিঘ্নে গৃহে প্রস্থান করা কাহারও সাধ্য নহে। হে রাজন! তুমি অতিশয় নিষ্ঠুর ও পাপস্বভাব। যাহারা তোমার শ্রেয়স্কর কাৰ্য্যে প্রবৃত্ত হইয়াছে, সন্দিহান হইয়া তাহাদিগকেই তিরস্কার করিতেছ। যাহা হউক, তুমি সৎকুলসম্ভূত ক্ষত্রিয় এবং সমরপ্রার্থী; অতএব এক্ষণে স্বীয় কাৰ্য্য সংসাধনার্থ অর্জ্জুনের সমীপে গমনপূর্ব্বক তাহাকে নিবারণ কর। তুমি এই শত্রুতার মূল কারণ, অতএব এক্ষণে অর্জ্জুনের সন্নিধানে গমন করিয়া যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও। তুমি কি নিমিত্ত বিনা অপরাধে এই সমস্ত ক্ষত্রিয়দিগকে বিনাশ করিতেছ? হে গান্ধারীনন্দন! তোমার এই মাতুল শকুনি অক্ষক্রীড়ায় সুনিপুণ, প্রতারণাপরতন্ত্র ও কুটিল হৃদয়; এক্ষণে ইনি ক্ষত্রিয়ধর্ম্মানুসারে অর্জ্জুনের সহিত সমরে প্রবৃত্ত হউন। আমার বোধ হয়, এই মহাবীরই পাণ্ডবগণকে বিনাশ করিবেন! তুমি কর্ণসমভিব্যাহারে মোহাবিষ্ট, শূন্যহৃদয়, শুশ্রুষাপরবশ রাজা ধৃতরাষ্ট্রের সমক্ষে হৃষ্টান্তঃকরণে বারংবার গর্ব্বপ্ৰকাশপূর্ব্বক কহিয়াছ, ‘হে মহারাজ! আমি, কর্ণ ও ভ্রাতা দুঃশাসন আমরা সমবেত হইয়া পাণ্ডবগণকে সংহার করিব।’ আমি প্রতিসভায় তোমার মুখে এইরূপ কথা শ্রবণ করিয়াছি। এক্ষণে তুমি প্রতিজ্ঞানুরূপ কর্ম্মানুষ্ঠান করিয়া কৰ্ণাদির সহিত সত্যবাদী হও। ঐ দেখ, নিতান্ত দুর্বিসহ শত্রু মহাবীর অর্জ্জুন তোমার সম্মুখে অবস্থান করিতেছে। এক্ষণে তুমি ক্ষত্রিয়ধর্ম্ম রক্ষা করিয়া উহার অভিমুখীন হও। অর্জ্জুনের হস্তে মৃত্যুও তোমার শ্লাঘনীয়। হে বৎস! তুমি অভিলষিত ঐশ্বৰ্য্যলাভ, দান ও ভোজন করিয়াছ এবং কৃতকাৰ্য্য ও ঋণশূন্য হইয়াছ। অতএব এক্ষণে নিঃশঙ্কমনে অর্জ্জুনের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও।

“হে মহারাজ! মহাবীর দ্রোণ রাজা দুৰ্য্যোধনকে এই বলিয়া সমরে প্রবৃত্ত হইলেন। অনন্তর কৌরবসৈন্যসকল দুইভাগে বিভক্ত হইয়া একভাগ দ্রোণকে ও অপর ভাগ দুৰ্য্যোধনাদিকে আশ্রয়পুর্ব্বক ঘোরতর সংগ্রাম আরম্ভ করিল।”