১৯০. সঙ্কুলযুদ্ধ

১৯০তম অধ্যায়

সঙ্কুলযুদ্ধ

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! এইরূপে ঐ সময়ে অসংখ্য নর, অশ্ব ও গজ নিহত হইতে আরম্ভ হইলে মহাবীর দুঃশাসন ধৃষ্টদ্যুম্নের সহিত সমরে প্রবৃত্ত হইলেন। তখন সুবর্ণরথারূঢ় ধৃষ্টদ্যুম্ন দুঃশাসনের শরনিকরে নিপীড়িত হইয়া ক্রোধভরে তাঁহার অশ্বগণের উপর শরনিকর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। তখন ক্ষণকালমধ্যে দুঃশাসনের কি রথ, কি ধ্বজ, কি সারথি সকলই অদৃশ্য হইল। মহাবীর দুঃশাসন মহাত্মা পাঞ্চালনন্দনের শরনিকরে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া আর তাহার সম্মুখে অবস্থান করিতে সমর্থ হইলেন না।

“এইরূপে মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন দুঃশাসনকে পরাঙ্মুখ করিয়া অসংখ্য শর নিক্ষেপপূর্ব্বক দ্রোণাচার্য্যের অভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন। কৃতবর্ম্মা ও তাঁহার তিন সহোদর তদ্দর্শনে পাঞ্চালতনয়ের নিবারণে প্রবৃত্ত হইলেন। তখন পুরুষপ্রধান নকুল ও সহদেব সেই প্রজ্বলিত পাবকসদৃশ ধৃষ্টদ্যুম্নকে দ্রোণাভিমুখে গমন করিতে দেখিয়া তাঁহাকে রক্ষা করিবার মানসে তাঁহার অনুগমন করিলেন। হে মহারাজ! তখন আপনার পক্ষীয় কৃতবর্ম্মা ও তাঁহার তিন সহোদর এই চারিজন বীরের সহিত পাণ্ডবপক্ষীয় ধৃষ্টদ্যুম্ন, নকুল ও সহদেব এই তিন মহাবীরের ঘোরতর সংগ্রাম আরম্ভ হইল। ঐ বিশুদ্ধাত্মা, বিশুদ্ধচরিত্র, বিশুদ্ধবংশসম্ভূত, অমর্ষপরায়ণ বীরগণ স্বর্গলাভার্থে জীবিতনিরপেক্ষ হইয়া ধর্ম্মযুদ্ধ অবলম্বনপূর্ব্বক পরস্পরকে পরাজিত করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। ঐ যুদ্ধে কর্ণী, নালীক এবং বিষলিপ্ত শৃঙ্গঘটিত বহু শল্য, তপ্ত গজাস্থি বা গবাস্থিযুক্ত জীর্ণ ও কুটিলগতি সকল ব্যবহৃত হয় নাই। সকলেই ধর্ম্মযুদ্ধদ্বারা স্বর্গ ও কীৰ্ত্তি বাসনা করিয়া অতি সরল বিশুদ্ধ অস্ত্র ধারণ করিয়াছিলেন। হে মহারাজ! এইরূপে তিনজন পাণ্ডবের সহিত কৌরবপক্ষীয় চারিজনের দোষবিহীন তুমুল যুদ্ধ উপস্থিত হইল। ঐ সময়ে মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন, নকুল ও সহদেবকে সেই কৌরবপক্ষীয় চারি বীরকে নিবারণ করিতে দেখিয়া স্বয়ং দ্রোণাভিমুখে ধাবমান হইলেন। তখন কৌরবপক্ষীয় বীরচতুষ্টয় মাদ্ৰীতনদ্বয়কর্ত্তৃক নিবারিত হইয়া তাঁহাদিগকে আক্রমণ করিতে লাগিলেন। এইরূপে মাদ্রীনন্দনদ্বয়ের প্রত্যেকের সহিত কৌরবপক্ষীয় দুই দুই বীরের ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হইলে মহাবীর দ্রুপদতনয় নির্ভয়ে দ্রোণের উপর শরজাল বর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন রাজা দুর্য্যোধন যুদ্ধদুর্ম্মদ পাঞ্চালনন্দনকে দ্রোণের সহিত ও মাদ্রীপুত্রদ্বয়কে আপনাদিগের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত দেখিয়া মর্ম্মভেদী শরবর্ষণপূর্ব্বক ধৃষ্টদ্যুম্নের অভিমুখে ধাবমান হইলেন। মহাবীর সাত্যকি তদ্দর্শনে দুৰ্য্যোধনের অভিমুখে আগমন করিলেন। এইরূপে নরশার্দুল মহাবীর দুর্য্যোধন ও সাত্যকি পরস্পর মিলিত হইয়া বাল্যবৃত্তান্ত স্মরণ ও ঈক্ষণাবেক্ষণ [সসম্ভ্রমে ইতস্ততঃ দৃষ্টি-সম্পাত] করিতে করিতে বারংবার হাস্য করিতে লাগিলেন।

সাত্যকিকে দুর্য্যোধনের স্ববশে আনয়নকৌশল

“অনন্তর রাজা দুর্য্যোধন প্রিয়সখা সাত্যকিকে সম্বোধনপূর্ব্বক আপনার চরিত্রের নিন্দা করিয়া কহিলেন, “হে সখে! ক্ষত্রিয়গণের ক্রোধ, লোভ, মোহ, পরাক্রম ও আচারে ধিক্‌! আমরা পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণ করিতেছি। তুমি আমার প্রাণাপেক্ষা প্রিয়তর ছিলে; আমিও তোমার তদ্রূপ ছিলাম; এক্ষণে আমাদিগের সে সকল বাল্যবৃত্তান্ত আমার স্মরণ হইতেছে। কি আশ্চর্য্য! সমরভূমিতে অবতীর্ণ হইয়া আমাদের সে সকলই একেবারে তিরোহিত হইয়া গেল। ক্রোধ ও লোভপ্রভাবে অদ্য আমাকে তোমার সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইতে হইল।

“হে মহারাজ। তখন অস্ত্রবিদ্যাবিশারদ সাত্যকি হাসিতে হাসিতে তীক্ষ্ণ বিশিখ সমুদ্যত করিয়া দুৰ্য্যোধনকে কহিলেন, ‘হে রাজপুত্র! আমরা যে স্থানে সমাগত হইয়া ক্রীড়া করিতাম, এ সে সভা বা আচার্য্যনিকেতন নহে।’ তখন দুৰ্য্যোধন কহিলেন, ‘হে শিনিপুঙ্গব! কালের কি আশ্চর্য্য মহিমা। আমাদিগের সেই বাল্যক্রীড়া অন্তর্হিত হইয়া এক্ষণে যুদ্ধ উপস্থিত হইয়াছে, আমরা ধনতৃষ্ণানিবন্ধন সকলে সমাগত হইয়া সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইয়াছি।’

সাত্যকির শ্লেষোক্তি—পরস্পর যুদ্ধ

“অনন্তর মহাবীর সাত্যকি দুৰ্য্যোধনকে কহিলেন, ‘হে দুৰ্য্যোধন! ক্ষত্রিয়গণের এই ধর্ম্ম যে, ইঁহারা আচার্য্যের সহিতও যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া থাকেন। হে রাজন্! যদি আমি তোমার প্রিয়পাত্র হই, তবে আর কেন বিলম্ব করিতেছ, শীঘ্র আমাকে বিনাশ কর, তাহা হইলে আমি তোমার কৃপায় স্বর্গলোকে গমন করিতে সমর্থ হইব। অতএব তোমার যতদূর পরাক্রম থাকে, তাহা প্রদর্শন কর, আর আমি আত্মীয়গণের ব্যসন নিরীক্ষণ করিতে অভিলাষ করি না।’ মহাবীর সাত্যকি এই বলিয়া নির্ভীকচিত্তে নিরপেক্ষ হইয়া অগ্রসর হইলেন। মহারাজ দুৰ্য্যোধন সাত্যকিকে সমাগত সন্দর্শন করিয়া তাঁহার উপর শরনিকর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। তখন সিংহ ও মাতঙ্গের যেরূপ যুদ্ধ হয়, তদ্রূপ সেই বীরদ্বয়ের ঘোরতর সংগ্রাম উপস্থিত হইল। মহাবীর দুর্য্যোধন আকর্ণ আকৃষ্ট শরনিকরে যুদ্ধদুর্ম্মদ সাত্যকিকে বিদ্ধ করিলে সাত্যকিও সত্বর তাঁহাকে প্রথমতঃ পঞ্চাশৎ, তৎপরে বিংশতি ও দশশরে বিদ্ধ করিলেন। তখন আপনার পুত্র হাসিতে হাসিতে শরাসন আকর্ণ আকর্ষণপূর্ব্বক সাত্যকির উপর ত্রিংশৎ শর নিক্ষেপ করিয়া ক্ষুরপ্রদ্বারা তাঁহার শরাশন দুই খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। অনন্তর যাদবপুঙ্গব অন্য এক সুদৃঢ় শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক দুর্য্যোধনের সংহারার্থ শরনিকর নিক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিলে কুরুরাজ তৎসমুদয় খণ্ড খণ্ড করিলেন। সৈন্যগণ তদ্দর্শনে চীৎকার করিতে লাগিল। অনন্তর দুৰ্য্যোধন মহাবেগে শরাসন আকর্ণ আকর্ষণপূর্ব্বক সুবর্ণপুঙ্খ নিশিত ত্রিসপ্ততি শরে সাত্যকিকে বিদ্ধ করিলেন। তখন মহাবীর সাত্যকি দুৰ্য্যোধনের সশর শরাসন ছেদন করিয়া তাঁহাকে শরনিকরে সমাচ্ছন্ন করিতে লাগিলেন। কুরুরাজ যুযুধানের শরনিকরে গাঢ় বিদ্ধ ও নিতান্ত ব্যথিত হইয়া সত্বর অন্য রথে পলায়ন করিলেন এবং সত্বরেই পরিমাপনোদনপূর্ব্বক সাত্যকির সম্মুখীন হইয়া তাঁহার রথের উপর শরজাল বর্ষণ করিতে লাগিলেন। তখন সাত্যকিও কুরুরাজের রথোপরি বাণবর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলেন। সায়কসমুদয় সমন্তাৎ বিনিক্ষিপ্ত হওয়াতে সংগ্রামক্ষেত্রে কক্ষদহনপ্রবৃত্ত হুতাশনের শব্দের ন্যায় তুমুল শব্দ সমুখিত হইল। ঐ বীরদ্বয়ের শনিকরে বসুধাতল সমাচ্ছন্ন ও আকাশমার্গ দুর্গম হইয়া উঠিল।

‘তখন মহাবীর কর্ণ সাত্যকিকে দুৰ্য্যোধন অপেক্ষা সমধিক বলশালী অবলোকন করিয়া কুরুরাজের হিতার্থ সেই মহারথকে লক্ষ্য করিয়া ধাবমান হইলেন। ভীমপরাক্রম ভীমসেন উহা সহ্য করিতে না পারিয়া সত্বর কর্ণের সম্মুখীন হইয়া তাহার উপর শরনিকর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। মহাবীর কর্ণ অবলীলাক্রমে ভীমসেনের শরসমুদয় নিবারণপূর্ব্বক শরনিকরে তাহার শর ও শাসন ছেদন এবং সারথিকে শমনসদনে প্রেরণ করিলেন। ভীমসেন তদ্দর্শনে ক্রুদ্ধ হইয়া গদাগ্রহণপূর্ব্বক সূতপুত্রের শরাসন, রথের একখানা চক্র এবং ধ্বজ ও সারথিকে চূর্ণ করিয়া ফেলিলেন। মহাবীর কর্ণ সেই একচক্ররথে অবস্থিত হইয়াও হিমালয়ের ন্যায় অবিচলিত রহিলেন। সাত অশ্ব যেরূপ সূর্যের একচক্ররথ বহন করিয়া থাকে, তদ্রূপ কর্ণের অশ্বগণ তাঁহার সেই রুচির একচক্র রথ বহন করিতে লাগিল। তখন তিনি কিছুমাত্র চিন্তা না করিয়া বিবিধ শর ও শস্ত্র নিক্ষেপপুর্ব্বক ভীমসেনের সহিত যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। বৃকোদরও ক্রুদ্ধ হইয়া তাঁহার সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলেন।

“হে মহারাজ! এইরূপে সঙ্কুলযুদ্ধ উপস্থিত হইলে ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির মহারথ পাঞ্চাল ও মৎস্যগণকে কহিলেন, ‘হে বীরগণ! যাঁহারা আমাদিগের প্রাণ ও মস্তকস্বরূপ, যে যোধগণ সর্ব্বাপেক্ষা পরাক্রান্ত, সেই সকল পুরুষপ্রধান বীরগণ দুর্য্যোধনাদির সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। অতএব এক্ষণে তোমরা কি নিমিত্ত বিচেতনের ন্যায় নিশ্চেষ্ট হইয়া রহিয়াছ? যে স্থানে-সোমকগণ যুদ্ধ করিতেছে, অবিলম্বে সেই স্থানে গমন কর। ক্ষাত্ৰধর্ম্ম অবলম্বনপূর্ব্বক যুদ্ধ করিলে জয়লাভই হউক বা প্রাণনাশ হউক, উভয়পক্ষেই সঙ্গতি লাভ হইবে, সন্দেহ নাই। দেখ, জয়লাভ করিলে ভূরিদক্ষিণ বিবিধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিতে পারিবে এবং নিহত হইলে দেবস্বরূপ হইয়া শ্রেষ্ঠলোক প্রাপ্ত হইবে।’ হে মহারাজ! মহারথ বীরপুরুষেরা যুধিষ্ঠিরকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া ক্ষাত্রধর্ম্ম অবলম্বনপূর্ব্বক দ্রুতপদে দ্রোণাভিমুখে ধাবমান হইলেন। তখন পাঞ্চালগণ একদিক্‌ হইতে শরনিকরে দ্রোণকে আহত করিতে লাগিলেন এবং ভীমসেনপ্রমুখ বীরগণ অন্য দিক হইতে তাঁহাকে আক্রমণ করিলেন। তখন পাণ্ডবপক্ষীয় তিন মহারথ ভীমসেন, নকুল ও সহদেব উচ্চস্বরে ধনঞ্জয়কে কহিলেন, ‘হে অর্জ্জুন! তুমি শীঘ্র ধাবমান হইয়া দ্রোণরক্ষণে নিযুক্ত কৌরবগণকে নিপাতিত কর। আচাৰ্য্য সহায়বিহীন হইলে পাঞ্চালগণ উঁহাকে অনায়াসে বিনষ্ট করিবেন। মহাবীর ধনঞ্জয় তাহাদের বাক্যশ্রবণে সহসা কৌরবগণের সম্মুখীন হইলেন; দ্রোণাচার্য্যও সেই পঞ্চম দিবসে ধৃষ্টদ্যুম্নপ্রমুখ পাঞ্চালগণকে মর্দ্দিত করিতে লাগিলেন।”