৫৯তম অধ্যায়
কৃষ্ণকৌশলে অর্জ্জুনের যুদ্ধক্ষেত্র প্রদর্শন
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! ঐ সময় মহাবীর অর্জ্জুন, কর্ণ ও ভীমসেন রোষান্বিত হইলে মহীপালগণের এইরূপ মহাসংগ্রাম উপস্থিত হইল। মহাবলপরাক্রান্ত ধনঞ্জয় দ্রোণপুত্রকে পরিত্যাগপূর্ব্বক অন্যান্য মহারথগণকে পরাজয় করিয়া বাসুদেবকে কহিলেন, ‘হে কৃষ্ণ! ঐ দেখ, পাণ্ডবসেনা পলায়নে প্রবৃত্ত হইয়াছে; মহাবীর কর্ণও আমাদের পক্ষীয় মহারথগণকে নিপীড়িত করিতেছেন। ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির বা তাঁহার ধ্বজদণ্ড আমার নেত্রগোচর হইতেছে না। দিবসের দুই ভাগ গত হইয়াছে, এক ভাগ মাত্র অবশিষ্ট আছে। বিশেষতঃ, এক্ষণে কৌরবপক্ষীয় বীরগণের মধ্যে কেহই আমার সহিত সমরে প্রবৃত্ত হইতেছে না। অতএব তুমি এই সময়ে আমার প্রিয়সাধনের নিমিত্ত যুধিষ্ঠিরের অভিমুখে যাত্রা কর। আমি ধর্ম্মরাজকে কুশলী দেখিয়া পুনরায় শত্রুগণের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইব। বাসুদেব ধনঞ্জয়ের বাক্যশ্রবণে তৎক্ষণাৎ ধর্ম্মরাজ সমীপে রথচালন করিলেন।
“ঐ সময় মহারাজ যুধিষ্ঠির ও মহারথ সৃঞ্জয়গণ প্রাণপণে কৌরবগণের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। মহাত্মা বাসুদেব সেই সংগ্রামভূমিতে অসংখ্য বীরকে নিহত অবলোকন করিয়া ধনঞ্জয়কে কহিলেন, ‘হে অর্জ্জুন! ঐ দেখ, দুৰ্য্যোধনের দুর্নীতিনিবন্ধন পৃথিবীস্থ অসংখ্য ভূপতি নিহত হইয়াছেন; হতজীবিত বীরগণের সুবর্ণপৃষ্ঠ শরাসন, মহামূল্য তূণীর, সুবৰ্ণপুঙ্খ আনতপর্ব্ব শর, নির্মোকনির্ম্মুক্ত [খোলস] পন্নগসদৃশ তৈলধৌত নারাচ, হস্তিদন্তনির্ম্মিত মুষ্টিযুক্ত হেমখচিত খড়্গ, হেমভূষিত চর্ম্ম, সুবর্ণনির্ম্মিত প্রাস, কনকভূষণ শক্তি, স্বর্ণপট্টে বদ্ধ বিপুল গদা, কাঞ্চনময়ী যষ্টি, হেমভূষিত পট্টিশ, কনকদণ্ডযুক্ত পরশু, লৌহময় কুন্ত, ভীষণ মুষল, বিচিত্র শতঘ্নী, বিপুল পরিঘ এবং চক্র ও তোমর ইতস্ততঃ বিকীর্ণ রহিয়াছে। বিজয়াকাঙক্ষী বীরগণ নানাবিধ অস্ত্রশস্ত্র ধারণপূর্ব্বক নিহত হইয়াও জীবিতের ন্যায় দৃষ্ট হইতেছেন। ঐ দেখ, সহস্র সহস্র যোধ গদাপ্রহারে চূর্ণ কলেবর, মুষলাঘাতে ছিন্নমস্তক এবং হস্তী, অশ্ব ও রথদ্বারা মথিত হইয়াছেন। রণভূমি বিবিধ শর, শক্তি, ঋষ্টি, পটিশ, লৌহনিৰ্ম্মিত পরিঘ, কুন্ত, পরশু ও অশ্বগণের খুরের আঘাতে ছিন্নভিন্ন শোণিতাক্ত মনুষ্য, অশ্ব ও অশ্বগণের শরীর এবং বীরগণের হেমভূষিত কেয়ুরান্বিত সতলত্ৰ[দস্তানা সমেত]চন্দনচর্চিত ছিন্নবাহু, অঙ্গুলিসম্বলিত অলঙ্কৃত ভুজাগ্র, করিশুণ্ডোপম ঊরু ও চূড়ামণিবিভূষিত কুণ্ডলান্বিত মস্তকসমূহে সমাচ্ছন্ন হইয়াছে। ক্ষতবিক্ষতাঙ্গ শোণিতদিগ্ধ কবন্ধগণ চতুর্দ্দিকে সমুত্থিত হওয়াতে সমরভূমি শান্তজ্বাল [নিস্তেজ] হুতাশনে পরিবৃত বলিয়া বোধ হইতেছে। ঐ দেখ, কিঙ্কিণীজাল[ঘণ্টাসমূহ]জড়িত বহুধাভগ্ন অসংখ্য রথ, শরাহত বিনির্গতন্ত্র [বহির্গতনাড়ী] অশ্ব, অনুকর্ষ, তূণীর, পতাকা, বিবিধ ধ্বজ, রথীগণের মহাশঙ্খ, পাণ্ডুবর্ণ চামর, পৰ্বতাকার নিষ্কাশিতজিহ্ব মাতঙ্গ, বিচিত্র পতাকাশোভিত নিহত অশ্ব, গজবাজিগণের পৃষ্ঠস্থ বিচিত্র চিত্রকম্বল, সুবর্ণমণ্ডিত গজাঙ্কুশ, পতিত মাতঙ্গগণের শরীরাঘাতে বহুধাভগ্ন ঘণ্টা, বৈদূৰ্য্যদণ্ড, অঙ্কুশ, অশ্বারোহিগণের ভূজাগ্রবন্ধ [দস্তানা] সুবর্ণবিকৃত কশা, বিচিত্র মণিখুচিত সুবর্ণসমলঙ্কৃত রঙ্কু[মেষলোম]চর্ম্মনির্ম্মিত আশ্বাস্তরণ, নরেন্দ্রগণের চুড়ামণি, বিচিত্ৰকাঞ্চনমালা, ছাত্র ও ব্যজনসকল চতুর্দ্দিকে সমাকীর্ণ রহিয়াছে। বীরগণের চন্দ্রনক্ষত্রের ন্যায় সমুজ্জ্বল চারু কুণ্ডলমণ্ডিত শ্মশ্রযুক্ত বদনমণ্ডলদ্বারা বসুধা সমাচ্ছন্ন হইয়াছে। ঐ দেখ, অনেকে দৃঢ়তর সমাহত ও নিপতিত হইয়া আর্ত্তনাদ পরিত্যাগ করিতেছে এবং উহাদের জ্ঞাতিবর্গ অস্ত্রশস্ত্র পরিত্যাগপূর্ব্বক রোদন করিয়া উহাদের শুশ্রুষায় প্রবৃত্ত হইয়াছে। ক্রোধপরতন্ত্র বিজয়াকাঙ্ক্ষী বীরগণ জীবিতহীন যোধগণকে শরও সমাচ্ছন্ন করিয়া অন্যান্য বীরগণের সহিত সংগ্রামার্থ গমন করিতেছে। সমরসমাহত শয়ান জ্ঞাতিগণ জলপ্রার্থনা করাতে অনেকে সলিলানয়নার্থে সত্বর গমন করিতেছে। অনেকে বান্ধবদিগের নিমিত্ত জল আনয়ন করিয়া তাহাদিগকে বিচেতন দেখিয়া জল পরিত্যাগপূর্ব্বক চীৎকার করিয়া ধাবমান হইতেছে। কেহ কেহ জলপান করিয়া ও কেহ কেহ জলপান করিতে করিতেই প্রাণত্যাগ করিতেছে। বান্ধবপ্রিয় বীরগণ সেই প্রিয়বান্ধবগণকে পরিত্যাগপূর্ব্বক সংগ্রামার্থ ধাবমান হইতেছে এবং অন্যান্য যোধগণ অধরোষ্ঠ দংশন ও ভ্রুকুটি বন্ধনপূর্ব্বক চতুর্দ্দিক দর্শন করিতেছে।’
“হে মহারাজ! বাসুদেব অর্জ্জুনকে এইরূপ কহিতে কহিতে যুধিষ্ঠিরাভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন; ধনঞ্জয়ও ধর্ম্মরাজের দর্শনার্থ সমুৎসুক হইয়া কৃষ্ণকে বারংবার ত্বরান্বিত করিতে লাগিলেন। তখন বাসুদেব অর্জ্জুনকে কহিলেন, ‘হে পাণ্ডব! ঐ দেখ, কৌরবপক্ষীয় পার্থিবগণ মহারাজ যুধিষ্ঠিরের প্রতি ধাবমান হইতেছেন। রণস্থলে কর্ণ প্রজ্বলিত পাবকের ন্যায় অবস্থান করিতেছে। মহাধনুর্দ্ধর ভীমসেন ধাবমান হইতেছেন। পাঞ্চাল, সৃঞ্জয় ও পাণ্ডবগণের অগ্রসর যোদ্ধা ধৃষ্টদ্যুম্নপ্রমুখ বীরগণ তাঁহার অনুগমন করিতেছে। পাণ্ডবসৈন্যগণ সমরে প্রবৃত্ত হইয়া কৌরব সৈন্যগণকে নিপীড়িত করাতে তাহারা পলায়নে প্রবৃত্ত হইতেছে। মহাবীর কর্ণ পলায়নপরায়ণ কৌরবসৈন্যগণকে অবরোধ করিতেছে। ঐ দেখ, ইন্দ্রতুল্যপরাক্রম শস্ত্রধরাগ্রগণ্য দ্রোণনন্দন অশ্বত্থামা কালান্তক যমের ন্যায় সংগ্রামে গমন করিতেছেন। মহারথ ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁহার প্রতি ধাবমান হইয়াছে এবং সৃঞ্জয়গণ সংগ্রামে নিহত হইতেছে।
“হে মহারাজ! মহাত্মা বাসুদেব এইরূপে অর্জ্জুনকে সমুদয় সংগ্রাম বিবরণ কহিলেন। অনন্তর ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হইল। উভয়পক্ষীয় সৈনিকগণ প্রাণপণে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া সিংহনাদ করিতে লাগিল। হে রাজন! কেবল আপনার কুমন্ত্রণাতেই তৎকালে উভয়পক্ষের এইরূপ ক্ষয় উপস্থিত হইল।”