১৭১. অর্জ্জুনকর্ত্তৃক অসুরগণের মায়াযুদ্ধজালচ্ছেদন

১৭১তম অধ্যায়

অর্জ্জুনকর্ত্তৃক অসুরগণের মায়াযুদ্ধজালচ্ছেদন

অর্জ্জুন কহিলেন, “মহারাজ! অনন্তর চারিদিক্‌ হইতে শিলাবৃষ্টি আরম্ভ হইল। আমি পর্ব্বতপ্রমাণ শিলাস্তম্ভদ্বারা একান্ত নিপীড়িত হইয়া মাহেন্দ্রাস্ত্র প্রেরিত বজ্রসঙ্কাশ শরনিকরদ্বারা শিলা-সকল চূৰ্ণ করিতে লাগিলাম। তাহাতে তৎক্ষণাৎ অগ্নি উত্থিত হইল এবং অনলকণার ন্যায় সেই অশ্ম [প্রস্তর] চূৰ্ণ-সকল নিপতিত হইতে লাগিল। এইরূপে শিলাবৃষ্টি নিবৃত্ত হইলে জলধারা-সকল মুষলধারে দশদিক আচ্ছন্ন করিয়া নভোমণ্ডল হইতে নিপতিত হইতে লাগিল। অবিরল ধারাপাত, প্রখর ঝঞ্ঝাবাত ও দৈত্যগণের ভয়ঙ্কর গভীর গর্জ্জনে এককালে সকল দিক আচ্ছন্ন হইয়া উঠিল, আর কিছুই অনুভব হইল না। ভূলোক হইতে দ্যুলোক পর্য্যন্ত সম্বদ্ধ বিশাল জলধারা-সকল নিরন্তর নিপতিত হইয়া আমাদিগকে বিমোহিত করিল। তখন আমি ইন্দ্ৰোপবিষ্ট ঘোরতর অতিপ্ৰদীপ্ত বিশোষণ-নামক এক দিব্য অস্ত্ৰ প্রয়োগ করিলাম, তাহাতেই সেই সকল জল তৎক্ষণাৎ বিশোষিত হইয়া গেল।

“অনন্তর দানবেরা আমার প্রতি মায়াময় আগ্নেয় ও বায়ব্য অস্ত্র প্রয়োগ করিলে আমি তৎক্ষণাৎ সলিলাস্ত্রদ্বারা অগ্নিনির্ব্বাণ ও শৈলাস্ত্রদ্বারা বায়ুবেগ নিবারণ করিলাম। এইরূপে আগ্নেয় ও বায়ব্য অস্ত্ৰ বিনষ্ট হইলে পর যুদ্ধদুর্ম্মদ দানবগণ এককালে বহুবিধ মায়া প্রকাশ করিয়া ঘোররূপ লোমহর্ষণ অস্ত্ৰ, অগ্নি ও শিলাবৃষ্টি আরম্ভ করিল এবং প্রবলবেগে বায়ু বহিতে লাগিল, সেই মায়াময়ী বৃষ্টি আমাকে নিতান্ত নিপীড়িত করিল। পরে চারদিক্‌ হইতে ঘোরতর নিবিড় অন্ধকার প্রাদুর্ভূত হইলে অশ্বেরা বিমুখ ও মাতলি স্থলিত হইলেন। তাঁহার হস্ত হইতে হিরন্ময় প্রতোদ [চাবুক] ভূতলে নিপতিত হইল, তিনি তখন নিতান্ত ভীত হইয়া ‘অর্জ্জুন কোথায়’ ইহা বারংবার বলিতে লাগিলেন। তাহাকে বিচেতন্যপ্ৰায় অবলোকন করিয়া আমারও হৃদয়ে সাতিশয় ভয়সঞ্চার হইল।

“অনন্তর তিনি একান্ত শঙ্কিত-মনে আমাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘হে অর্জ্জুন! পূর্ব্বে অমৃতের নিমিত্ত সুরাসুরের ঘোরতর সংগ্রাম হইয়াছিল, আমি তাহা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করিয়াছি; শম্বরবধে ভয়ানক যুদ্ধঘটনা হইয়াছিল, আমি সে স্থানেও দেবরাজের সারর্থ্যকর্ম্ম সম্পন্ন করিয়াছি; বৃত্ৰাসুর-সংহারে আমিই অশ্বচালনা করিয়াছি; বৈরোচনি বলির অতি বিষম সমরও নয়নগোচর করিয়াছি। এই সকল মহাঘোর সংগ্রাম প্রত্যক্ষ করিয়াও কদাচ সংজ্ঞাশূন্য হই নাই। আজি বোধ হয় সর্ব্বলোকপিতামহ ব্ৰহ্মা নিশ্চয়ই প্রকৃতিবর্গের বিনাশ-কল্পনা করিয়াছেন, অন্যথা এইরূপ সংসারনাশকারী অভূতপূর্ব্ব সমরঘটনা নিতান্ত অসম্ভব।”

“আমি এই কথা শ্রবণপূর্ব্বক শঙ্কাশূন্য হইয়া দানবগণের মায়াবল নির্য্যাকরণ করিবার নিমিত্ত নিতান্ত ভীত মাতলিকে কহিলাম, “হে ইন্দ্ৰ-সারথে! অদ্য আপনি আমার ভুজবল, অস্ত্র ও গাণ্ডীবাশরাসনের প্রভাব প্রত্যক্ষ করুন। আজি আমি অস্ত্রমায়াদ্বারা দানবগণের নিদারুণ মায়া ও গাঢ়তর অন্ধকার নির্য্যাকরণ করিব; আপনি অণুমাত্র ভীত বা ব্যস্ত হইবেন না।” এই বলিয়া আমি দেবগণের হিতসাধনার্থ সর্ব্বভূতবিমোহিনী অস্ত্রমায়া সৃষ্টি করিলাম। তখন অসুরেরা আপনাদিগের মায়াজাল উচ্ছিন্ন হইল। দেখিয়া পুনরায় বহুবিধ মায়া প্রকাশ করিতে লাগিল। কখন প্রচুর আলোক, কখন ঘোরতর অন্ধকার, কখন লোক-সকল দৃষ্টিগোচর হইয়া উঠিল; কখন বা সমস্ত সংসার অগাধ জলে নিমগ্ন হইয়া গেল। পরে ইন্দ্রসারথি মাতলি আলোকলাভ করিয়া রণস্থলে অশ্ব-চালনা করিতে লাগিলেন। এই অবসরে নিবাতকবচগণ পুনরায় আমাকে আক্রমণ করিলে আমিও সুকৌশলে তাহাদিগকে শমনসদনে প্রেরণ করিলাম। পরে সেই নিবাতকবচান্তকারী সংগ্রামে মায়াপরিবৃত দানবগণকে আর অবলোকন করিতে পাইলাম না।”