১৮৬. ধেনু প্রভৃতির দানফল-বর্ণন

১৮৬তম অধ্যায়

ধেনু প্রভৃতির দানফল-বর্ণন

মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “মহারাজ! এইস্থলে দেবী সরস্বতী মহর্ষি তার্ক্ষ্যকর্ত্তৃক জিজ্ঞাসিত হইয়া যেরূপে উপদেশ প্রদান করিয়াছিলেন, শ্রবণ করুন। একদা তার্ক্ষ্য সরস্বতী দেবীকে কহিলেন, ‘হে ভদ্রে! ইহলোকে মনুষ্যের শ্রেয়ঃ কি, কিরূপ আচারব্যবহারে তাহারা ধর্ম্মভ্রষ্ট হয় না, কিরূপে হুতাশনে আহুতি প্রদান করিতে হয়, কোন্ কালেই বা দেবপূজা করিতে হইবে, আর কি কারণেই বা ধর্ম্মরক্ষা হয়? আপনি এই সকল বিষয় কীর্ত্তন করুন; আমি তদনুসারে কাৰ্য্য করিব ও আপনার উপদেশশ্রবণে নিষ্পাপ হইয়া পরিণামে স্বর্গলোকলাভ করিব।’

“শুশ্রুষাপরবশ মহর্ষি তার্ক্ষ্য এইরূপ জিজ্ঞাসা করিলে পর সরস্বতী দেবী ধর্ম্মসঙ্গত কথা কহিতে লাগিলেন, ‘হে তপোধন! যিনি ব্রহ্মকে জানেন, তিনি স্বাধ্যায়সম্পন্ন, শুচি ও অপ্রমত্ত; তিনি ব্রহ্মলোকে গমনপূর্ব্বক দেবগণের সহিত প্রীতিলাভ করিয়া থাকেন। তথায় কনককমলালঙ্কৃত, বিপুল, বিশোক, তীর্থপরম্পরা-পরিশোভিত, মৎস্যসার্থসঙ্কুল, অপঙ্কিল ও রমণীয় পুষ্করিণী-সকল বিদ্যমান রহিয়াছে, ব্রহ্মজ্ঞ পুণ্যবান্ লোকেরা হিরণ্যবর্ণ বহুবিধ দিব্য-অলঙ্কারে অলঙ্কৃত ও অতি-পবিত্র অপ্সরাগণকর্ত্তৃক সংম্ভূয়মান হইয়া প্রফুল্লমনে তাহার তীরে বিহার করিয়া থাকেন। গো-প্রদান করিলে উৎকৃষ্ট লোক, বলীবর্দ্দদানে সূৰ্য্যলোক, বসনপ্রদানে চান্দ্রমস[চন্দ্রলোক]লোক ও হিরণ্যদানে অমরত্বলাভ হয়। সুপ্রভা, সুপ্রদোহা, সুবৎসা ও অপলায়িনী ধেনু-দান করিলে মানবগণ সেই ধেনুর রোমের সমসংখ্যক সংবৎসর দেবলোকে বাস করিয়া থাকে। যিনি অনন্তবীৰ্য্য, হলবাহী, ধুরন্ধর ও যুবা বলীবর্দ্দ দান করেন, তিনি দশ-ধেনু-দান-জন্য লোকসমুদয় প্রাপ্ত হয়েন। দ্রবিণ [ধন] ও অন্যান্য দক্ষিণাদ্রব্য-সহকারে কাংস্যোপদোহসম্পন্ন [কাঁসার দোহনপাত্র] সচেলা কপিলা প্রদান করিলে সেই কপিলা স্বীয় প্রসিদ্ধ গুণদ্বারা কামদুহা হইয়া প্রদাতাকে প্রাপ্ত হইয়া থাকে। ধেনুর গাত্রে যাবৎসংখ্যক রোম বিদ্যমান থাকে, ধেনু দানে তৎসমসংখ্যক ফললাভ হয় এবং পরলোকে প্রদাতার পুত্র পৌত্র প্রভৃতি সপ্তপুরুষ পৰ্য্যন্ত উদ্ধার হইয়া থাকে।

‘যিনি দ্রবিণ ও অন্যান্য দক্ষিণাদ্রব্যসহকারে কাংস্যোপদোহযুক্ত কাঞ্চননির্ম্মিত-শৃঙ্গসম্পন্ন তিলধেনু ব্রাহ্মণকে সম্প্রদান করেন, তিনি অনায়াসে বসুলোক লাভ করিয়া থাকেন। যে ব্যক্তি স্বকর্ম্মদোষে কাম-ক্রোধ প্রভৃতি দানববৰ্গকর্ত্তৃক নিরন্তর নিরুদ্ধ গাঢ়ান্ধকারসমাচ্ছন্ন, ঘোরতর নরকে নিপতিত হয়, ধেনুদানই মহাসমুদ্রে সমীরণপ্রেরিত নৌকার ন্যায় পরলোকে তাহার উদ্ধারের কারণ হইয়া উঠে। যিনি ব্রাহ্মবিধানানুসারে কন্যাদান ও বিধিপূর্ব্বক অন্যান্য প্রচুর দ্রব্য ব্রাহ্মণকে দান করিয়া থাকেন, তিনি ইন্দ্রলোকপ্রাপ্ত হয়েন। যিনি নিয়মাবলম্বী ও সুশীল হইয়া ক্রমাগত সপ্তবর্ষ হুতাশনে আহুতি প্রদান করেন, তিনি স্বকর্ম্মবলে আপনাকে ও সপ্তপূর্ব্ব এবং সপ্তপর পুরুষকে পবিত্র করিয়া থাকেন।’

“তার্ক্ষ্য জিজ্ঞাসা করিলেন, হে দেবি! বেদোদিত অগ্নিহোত্রব্রত কিরূপ, আপনি তাহা কীর্ত্তন করুন। আমি অদ্য আপনাকর্ত্তৃক উপদিষ্ট হইয়া তদ্বিষয়ে সম্পূর্ণ জ্ঞান লাভ করিব। সরস্বতী কহিলেন, ‘হে তার্ক্ষ্য! অপ্রক্ষালিতপাণি, অশুচি, বেদানভিজ্ঞ, অবিদ্বান্ ব্যক্তি কদাচ হোম করে না, কারণ, পরচিত্তানুসন্ধানপর শৌচপ্রিয় অমরগণ শ্রদ্ধাহীন লোক হইতে কদাচ হবনীয় দ্রব্যজাত গ্রহণ করেন না। অজ্ঞানকুলশীল ব্যক্তিকেই অশ্রোত্রিয় বলিয়া নির্দেশ করে, তাহাদিগকে দেবহব্যে নিয়োগ করিলে সমুদয় বিফল হয়; অতএব তাদৃশ লোককে তদ্বিষয়ে কদাচ নিয়োগ করিবে না। যাঁহারা হুতশেষভোজী, সত্যব্রত, শ্রদ্ধাবান্ ও নিরহঙ্কার হইয়া হোম করেন, তাঁহারা অতিপবিত্র গোলোকলাভ এবং পরম সত্যস্বরূপ দেবকে নিরীক্ষণ করিয়া থাকেন।

“তার্ক্ষ্য কহিলেন, “হে দেবি! আপনি পরমাত্মারূপা প্রজ্ঞা, আপনি ব্রহ্মতত্ত্ব ও কর্ম্মকাণ্ড এই উভয়বিধ বিষয়েই নিবিষ্ট আছেন, আর ঐ সকল বিষয় আপনাকর্ত্তৃক দ্যোতমান হইতেছে জানিয়া জিজ্ঞাসা করিতেছি, আপনি কে?’

“সরস্বতী কহিলেন, ‘আমি পরাপরবিদ্যারূপ দেবী, বিপ্রর্ষিগণের সংশয়নিবারণাৰ্থ অগ্নিহোত্রাদি সৎকর্ম্ম হইতে আবির্ভূত হইয়া তোমার সন্নিধানে আগমনপূর্ব্বক শ্রদ্ধাসহকারে যথার্থ অর্থ-সমুদয় প্রকাশ করিলাম। তার্ক্ষ্য কহিলেন, ‘হে দেবি! আপনার তুল্য আর কেহই নাই, আপনি সাক্ষাৎ লক্ষ্মীর ন্যায় নিরন্তর বিরাজমান হইতেছেন। আপনার রূপ দিব্য ও কান্তি অনন্ত; আপনি বুদ্ধিদেবীকে সতত ধারণ করিতেছেন।’ সরস্বতী কহিলেন, ‘হে তপোধন! বানস্পত্য, ধাতুময়, পার্থিব ও অন্যান্য যে সমস্ত উৎকৃষ্ট দ্রব্যজাত যজ্ঞে উপপাদিত হইয়া থাকে, আমি তাহার উপযোগদ্বারা বর্দ্ধিত, পরিতৃপ্ত ও রূপবতী হইয়া থাকি, তুমি আমার সেই দিব্যরূপ-দর্শন ও আমাকে যজ্ঞস্বরূপ বোধ করিলে মুক্তিলাভ করিবে।’

“তার্ক্ষ্য কহিলেন, ‘হে দেবি! শাস্ত্রবিশারদ ব্যক্তিরা বিশ্বস্তমনে যাহাকে শ্রেয়ঃ জ্ঞান করিয়া ইন্দ্রিয়সংযম প্রভৃতি অতিকঠোর ব্রতানুষ্ঠান করেন, সেই শোক-দুঃখশূন্য মোক্ষ কি প্রকার এবং সাংখ্যশাস্ত্রে যাহাকে চিরন্তন ও শ্রেষ্ঠ বলিয়া নির্দেশ করে, সেই পরমাত্মা কে, আমি জানি না, অতএব আপনি তদ্বিষয়ে উপদেশ প্রদান করুন।’ সরস্বতী কহিলেন, ‘হে তার্ক্ষ্য! স্বাধ্যায়সম্পন্ন বেদবেদান্ত-পারদর্শী মহর্ষিগণ বীতশোক ও বিষয়বাসনাবিহীন হইয়া ব্রত ও পুণ্যকর্ম্মের অনুষ্ঠান এবং যোগসাধনদ্বারা যে পুরাতন পুরুষকে প্রাপ্ত হইয়া থাকেন, তিনি পরমব্রহ্ম। যে অবস্থাতে তাঁহাকে প্রাপ্ত হওয়া যায়, তাহাকেই মোক্ষ বলে। সেই পুরুষমধ্যে ব্রহ্মাণ্ডরূপ সহস্রশাখাসম্পন্ন পুণ্যগন্ধশালী বিশাল এক বেতসলতা বৃদ্ধি পাইতেছে; তাহার মূলদেশ হইতে মধূদক-প্রস্রবণ অতিপবিত্র স্রোতস্বতীসকল প্রবাহিত হইতেছে। তাহার শাখায় পুত্রাদি বিষয়সম্পন্না, ভৃষ্টয়বাপূপবিশিষ্টা [ভাজা যবের পিষ্টকযুক্তা], মাংসশাকযুক্তা পায়সকর্দ্দমশালিনী মহানদীসকল সঞ্চরণ করিতেছে; সে স্থানে অগ্নিমুখ ইন্দ্রাদি দেবগণ নানাবিধ যজ্ঞ করিয়া থাকেন। হে তার্ক্ষ্য! সেই আমার পরম স্থান।’