১৮৩. অর্জ্জুনসাক্ষাৎকারে কৃষ্ণের আগমন

১৮৩তম অধ্যায়

অর্জ্জুনসাক্ষাৎকারে কৃষ্ণের আগমন

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! পাণ্ডবগণ কাম্যাকবনে উপনীত হইয়া মহর্ষিদত্ত অতিথিসৎকার গ্রহণপূর্ব্বক দ্ৰৌপদীর সহিত উপবেশন করিলেন। তথায় বহুসংখ্যক ব্ৰাহ্মণগণ তাঁহাদিগকে বেষ্টন করিয়া উপবিষ্ট হইলে এক ব্রাহ্মণ তাঁহাদিগকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে পাণ্ডবগণ! অর্জ্জুনের প্রিয় সখা মহাত্মা কৃষ্ণ সততই আপনাদিগের দর্শন-বাসনা ও শুভ-প্রত্যাশা করিয়া থাকেন, এক্ষণে আপনাদিগের আগমনসংবাদ অবগত হইয়াছেন, অতএব তিনি অতি সত্বরই এস্থানে সমুপস্থিত হইবেন; আর তপঃস্বাধ্যায়সম্পন্ন চিরজীবী মহর্ষি মার্কণ্ডেয় অবিলম্বে আপনাদিগের সাক্ষাৎকারলাভপ্রত্যাশায় এই কাম্যক বনে উপস্থিত হইবেন।” এই বলিয়া ব্ৰাহ্মণ বিরত হইলেন।

এই অবসরে বাসুদেব সুলক্ষণসম্পন্ন-অশ্বযোজিত রথারোহণ করিয়া শচীসনাথ সুরনাথের ন্যায় প্রিয়তমা সত্যভামার সহিত কাম্যকবনে সমুপস্থিত হইলেন। অনন্তর তিনি সত্বর রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া হৃষ্টান্তঃকরণে ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির, ভীমসেন ও ধৌম্যকে যথাবিধি অভিবাদন করিলেন; পরিশেষে নকুল ও সহদেবকর্ত্তৃক নমস্কৃত হইয়া দ্রৌপদীকে সান্ত্বনাবাদ প্ৰদানপূর্ব্বক বীরবর প্রিয়তম অর্জ্জুনকে আগত অবলোকন করিয়া মুহুর্মুহুঃ আলিঙ্গন করিতে লাগিলেন। এদিকে কৃষ্ণপ্ৰিয়া সত্যভামা পাণ্ডব মহিষী দ্রৌপদীকে বারংবার আলিঙ্গন করিলেন।

অনন্তর পাণ্ডবগণ দ্রৌপদী ও পুরোহিত ধৌম্যের সহিত কৃষ্ণের সমুচিত সৎকারপূর্ব্বক চতুর্দ্দিক বেষ্টন করিয়া উপবিষ্ট হইলেন। তখন নন্দনন্দন কৃষ্ণ অসুর-সংহারসমর্থ পার্থের সহিত সমাগত হইয়া কার্ত্তিকেয়সহ সমাসীন ভগবান ভূপতির ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। পরে অর্জ্জুন কৃষ্ণকে আদ্যোপান্ত সমস্ত বনবৃত্তান্ত নিবেদন করিয়া সুভদ্রা ও অভিমন্যুর কুশলী-সংবাদ জিজ্ঞাসা করিলেন। তিনি অশেষ প্রশংসাপূর্ব্বক ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে কহিলেন, “রাজন! রাজ্যলাভ অপেক্ষা ধর্ম্ম উৎকৃষ্ট, ধর্ম্মবুদ্ধির নিমিত্ত তপানুষ্ঠান করা সর্ব্বতোভাবে বিধেয়, আপনি সেই ধর্ম্মকে সত্য ও সারল্যদ্বারা প্ৰতিপালন করিয়া ইহলোক ও পরলোক জয় করিয়াছেন। আপনি ব্ৰতানুষ্ঠানপূর্ব্বক সাঙ্গোপাঙ্গ ধনুৰ্বেদ অধ্যয়ন করিয়া ক্ষত্রি-ধর্ম্মানুসারে ধনোপার্জ্জনপূর্ব্বক চিরপ্রথিত যাগযজ্ঞ-সকল সংসাধন করিয়াছেন। গ্রাম্য-ধর্ম্মে আপনার অণুমাত্রও অনুরাগ নাই, আপনি কামপরতন্ত্র হইয়া কদচি কোন কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করেন না। অর্থলাভলোভেও কখন ধর্ম্মপথপরিভ্রষ্ট হয়েন নাই, এই নিমিত্তই আপনি ধরণীতলে ধর্ম্মরাজ বলিয়া বিখ্যাত হইয়াছেন। রাজ্য ধন ও বহুবিধ ভোগলাভ করিলেও, দান, সত্য, তপ, শ্রদ্ধা, বুদ্ধি, ক্ষমা ও ধৃতি এই সকল বিষয়ে আপনার সবিশেষ অনুরাগ আছে। যখন শক্ৰগণ সভামধ্যে সর্ব্বজনসমক্ষে দ্রৌপদীকে বিবসনা করিয়াছিল, তৎকালে কাহার সাধ্য উহা সহ্য করে, কেবল আপনিই ধৈৰ্য্যাবলম্বনপূর্ব্বক তাদৃশ দুর্ব্বিষহ নৃশংসাচার সহ্য করিয়াছেন। যদি আপনার প্রতিজ্ঞা সম্পূর্ণ হইয়া থাকে, তাহা হইলে আমরা সকলে এইক্ষণেই কৌরবকুল সমূলে নির্মূল করিব আর আপনি পুনরায় রাজ্যলাভ করিয়া পরমসুখে প্রজাপালন করিবেন।” ভগবান্‌ বাসুদেব এই বলিয়া মহারাজ যুধিষ্ঠির ও ধৌমপ্রভৃতি সকলকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, মহাবীর অর্জ্জুন আপনাদিগেরই সৌভাগ্যবলে দিব্য অস্ত্রসকল লাভ করিয়া প্রফুল্ল মনে অক্ষত শরীরে প্রত্যাগমন করিয়াছেন।

অনন্তর তিনি সুহৃদ্গণ-সমভিব্যাহারে দ্রৌপদীকে কহিলেন, হে কৃষ্ণ! এক্ষণে ধনুর্ব্বেদে একান্ত অনুরক্ত তোমার আত্মজ প্রতিবিন্ধ্যপ্রভৃতি সুশীল শিশু সুহৃদ্গণানুমোদিত সাধুজনাচরিত পথে সতত সঞ্চরণ করিয়া থাকে। তাহারা তোমার পিতা ও ভ্রাতৃগণকর্ত্তৃক রাজ্য বা ধন দ্বারা প্রলোভিত হইয়াও তাঁহাদের আবাসে বাস করিয়া কোন ক্রমেই চিত্তপরিতোষ বা প্রসন্নতা প্রাপ্ত হয় না। তাহাদিগের একান্ত অভিলাস যে, দ্বারকা নগরীতে যাদবদিগের সহিত সুখস্বচ্ছন্দে কালাতিপাত করে। অর্য্যা কুন্তী ও তুমি তাহাদিগকে যাদৃশ পরম যত্ন ও স্নেহসহকারে প্রতিপালন করিতে, তদ্রূপ সুভদ্রাও এক্ষণে তাহাদিগকে প্রমাদে প্রতিপালন করিয়া থাকে। প্রদ্যুম্ন যেমন অনিরুদ্ধ, অভিমন্যু, সুনীথ ও ভানুর বিনেতা ও একমাত্র গতি, তদ্রূপ তোমার সন্তানগণের ও বিনেতা এবং একমাত্র গতি। কুমার অভিমন্যু, তোমার নিরালস্য সন্তানদিগকে গদা ও অসিচৰ্ম্মগ্রহণ, অস্ত্র, শিক্ষাশাস্ত্র ও রথাশ্বযান বিষয়ে সতত সম্যকরূপে শিক্ষা প্রদান করিয়া থাকে। এক্ষণে প্রদ্যুম্ন, তোমার আত্মজগণ ও অভিমন্যুকে সমুদায় অস্ত্র শস্ত্র প্রদানপূর্ব্বক সুশিক্ষিত করিয়া তাহাদিগের বল বিক্রম দর্শনে সাতিশয় সন্তুষ্ট হইতেছে। তোমার অনুজের যেস্থানে বিহার করিবার অভিলাষে গমন করে, সেই স্থানেই হস্তী, অশ্ব ও রথসকল তাহাদের প্রত্যেকের অনুগমন করিয়া থাকে।

অনন্তর তিনি যুধিষ্ঠিরকে কহিলেন, হে ধৰ্ম্মরাজ! আপনি যে স্থানে ইচ্ছা করিবেন, যাদব, কুকুর ও অন্ধকেরা আপনার নিদেশবর্ত্তী হইয়া সেই স্থানেই অবস্থান করিবে। মাথুরী সেনাসকল শর-শরাসন প্রভৃতি অস্ত্রশস্ত্র গ্রহণপূর্ব্বক হস্তী, অশ্ব, রথ ও হস্তিপকের সহিত আপনার সাহায্য করিবে। আপনি পাপাত্মা দুর্য্যোধনকে অনুচর ও বান্ধবগণের সহিত ভৌম ও সৌভাধিপতির পথে প্রেরণ করুন। আপনি সভামধ্যে যেরূপ প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন, তাহার যেন অন্যথা না হয়। এক্ষণে হস্তিনা নগর যাদবগণকর্ত্তৃক আপনার শত্রুকুল বিনাশ প্রার্থনা করুক। আপনি বিগতক্রোধ, বীতশোক ও নিষ্পাপ হইয়া যথেচ্ছ-বিহারপূর্ব্বক সর্ব্বাগ্রে প্রসিদ্ধ নাগপুরে প্রবেশ করিলেন।

অনন্তর ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের অভিপ্রায় জানিতে পারিয়া তদুক্ত বাক্যের ভূয়সী প্রশংসা করিয়া সবিশেষ পৰ্যালোচনা পূর্ব্বক কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলেন, হে কেশব! তুমি পাণ্ডবগণের অদ্বিতীয় গতি; পাণ্ডবেরা তোমারই শরণাপন্ন; কি বিপদ কি সম্পদ সকলকালেই তুমি তাহাদিগের কর্ত্তা ও উপদেষ্টা। প্রতিজ্ঞানুসারে দ্বাদশ বৎসর নির্জ্জনে অতিবাহিত হইয়াছে ; পরে পাণ্ডবেরা যথাবিধি অজ্ঞাতচৰ্য্যা সমাপন করিয়া তোমার সহিত মিলিত হইবে; হে কেশব! তোমার যেন সর্ব্বদাই এই রূপ সদ্ভাব থাকে ও সত্যপরায়ণ দানধৰ্ম্মানুর সদর সবান্ধব পাণ্ডবেরাও যেন তোমার শরণাগত হইয়া জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ করে।

ভগবান কৃষ্ণ ও ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির এই রূপ কহিলে পর, ধর্ম্মাত্মা, রূপগুণ সম্পন্ন, অজর, অমর, মহাতপাঃ মার্কণ্ডেয় তথায় সমুপস্থিত হইলেন। তিনি বহুসহস্র বর্ষবয়স্ক; কিন্তু দেখিলে পঞ্চবিংশতি বর্যদেশীয়ের ন্যায় বোধ হয়। মহর্ষি সমাগত হইবামাত্র সমুদায়ব্রাহ্মণ ও কৃষ্ণসমবেত পাণ্ডুতনয়গণ ভক্তিসহকারে তাহাকে অর্চনা করিলেন ।

মহাভাগ মার্কণ্ডেয় বিধিমত অর্চিত হইয়া মুখে উপবেশন পূর্ব্বক পরিশ্রম অপনয়ন করিলে পর, বৃঞ্চিবংশাবতংস কৃষ্ণ ব্রাহ্মণগণ ও পাণ্ডবদিগের মত-গ্রহণপূর্ব্বক মহর্ষিকে কহিতে লাগিলেন, হে মার্কণ্ডেয়! সমুদায় সমাগত ব্রাহ্মণ, পাণ্ডবগণ, দ্রৌপদী, সত্যভামা ও আমি আমরা সকলেই আপনার অতুৎকৃষ্ট বাক্য শ্রবণ করিতে অভিলাসী হইয়াছি; অতএব আপনি অনুগ্রহ পূর্ব্বক ভূপতি, স্ত্রী ও ঋসিগণের সদাচার ব্যবহার প্রভৃতি পুরাবৃত কীর্ত্তন করুন।

মহর্ষিকে এই রূপ জিজ্ঞাসানন্তর সকলে সুখে উপবিষ্ট আছে, এমন সময় বিশুদ্ধাত্মা দেবর্ষি নারদ পাণ্ডবকে অবলোকন করিবার নিমিত্ত তথায় সমুপস্থিত হইলেন। পুরুশ্রেষ্ঠ পাণ্ডবগণ পদ্য অর্ঘ্য দ্বারা সেই সমাগত দেবর্ষিকে যথা বিধি পূজা করিলেন। দেবর্ষি নারদ তত্রস্থ জনগণকে মার্কণ্ডেয়ের কথা শ্রবণে কৃতনিশ্চয় বুঝিতে পরিয়া তাহাতেই অনুমোদন করিলেন। তখন কালজ্ঞ সনাতন পুরুষ বাসুদেব মার্কণ্ডেয়কে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, হে ব্রহ্মর্ষে ! আপনি পাণ্ডবগণ সমক্ষে যাহা কীর্ত্তন করিতে অভিলাষ করিয়াছেন, তাহা কীর্ত্তন করুন।

মহাতপাঃ মার্কণ্ডেয় এই রূপ অভিহিত হইয়া কহিলেন, দেখ, অনেক উপাখ্যান কহিতে হইবে; অতএব একটা সময় নির্ধারিত করা আবশ্যক। পাণ্ডবগণ মার্কণ্ডেয়ের বাক্য শ্রেবণে দ্বিজগণ-সমভিব্যাহারে মধ্যাকালে পুরাবৃত্ত শ্রবণ করিবার নিয়ম নির্ধারিত করিলেন।

অনন্তর ধর্ম্মাত্মা ধৰ্ম্মনন্দন যুধিষ্ঠির মার্কণ্ডেয়কে বিবক্ষু দেখিয়া কহিলেন, হে ভগবন! আপনি আমাদের সেব্য, উপাস্য, অভিমত ও চিরকাঙ্ক্ষিত। আপনি সমুদায় দেব, দানব, মহাত্মা মহর্ষি ও রাজর্ষিগণের চরিত অবগত আছেন ; অতএব আপনা হইতেই আমার সংশয়াপনোদ হইবে; সন্দেহ নাই। আর এই দেবকীনন্দন আমাদিগকে সন্দর্শন করিবার নিমিত্ত এস্থানে আসিয়াছেন, ইনিও একজন বিজ্ঞ ও সমুৎসুক শ্রোতা। হে মহাত্মন্‌! আমি এক্ষণে আপনাকে সুখবিহীন ও ধৃতরাষ্ট্র-তনয়গণকে সমৃদ্ধিশালী দেখিয়া মনে করিতেছি যে, শুভ বা অশুভ কর্ম্মের অনুষ্ঠাতা কই তাহার ফল ভোগ করে? আর কি প্রকারেই বা ঈশ্বরকে কর্ত্তা বলিয়া স্বীকার করি? কি নিমিত্ত মনুষ্যের সুখ দুঃখ সমুৎপন্ন হয়? মনুষ্য ইহলোকে, কি পরলোকে আপনার কর্ম্মফল প্রাপ্ত হয়? দেহী দেহ ত্যাগ করিয়া কিরূপে পরলোকে শুভাশুভ-ফল ভোগ করে ও ইহ কালেই বা কিরূপে উহা লাভ করে? মৃত ব্যক্তির কর্ম্মকলাপ কোথায় থাকে?

মার্কণ্ডেয় কহিলেন, হে রাজন! আপনি উপযুক্ত প্রশ্ন করিয়াছেন; কিন্তু নিখিল জ্ঞাতব্য বিষয় আপনার জ্ঞানগোচর আছে; তথাপি কেবল লোকস্থিতির নিমিত্ত জিজ্ঞাসা করিতেছেন। অতএব যেরূপে মনুষ্য ইহ লোক ও পরলোকে সুখ দুঃখ ভোগ করে, আমি তাহা কীর্ত্তন করিতেছি, অবহিত হইয়া শ্রবণ করুন।

ভগবান পূর্ব্বপ্রজাপতি শরীরীর শরীর নির্ম্মল, অতি পবিত্র ও ধৰ্ম্মতন্ত্র করিয়া 
সৃষ্টি করিয়াছেন। হে কুরুসত্তম! স
র্ব্বদা সফলমনোরথ, সত্যবাদী, ব্রহ্মস্বরূপ, পুরাতন পুণ্যাত্মা নরগণ স্বচ্ছন্দে নভস্তলে দেবগণের সহিত সমাগত হইয়া পুনর্ব্বার সকলে যদৃচ্ছাক্রমে প্রত্যাগমন করিতেন। সেই স্বচ্ছন্দচারী নরগণ স্বেচ্ছামরণ ছিলেন। তাঁহাদিগের কাৰ্যে কোন ক্রমেই বাধা ঘটিত না ; তাঁহারা নিরাতঙ্ক, নিরুপদ্রব, দেববৃন্দ ও মহাত্মা ঋষিগণের পরিদর্শক, দান্ত, বিগতমৎসর, সহস্র বর্ষজীবী ও সকলে সাক্ষাৎ ধর্ম্মস্বরূপ ছিলেন। তাঁহার সহস্র পুত্র লাভ করিতেন।

অনন্তর কালক্রমে তাঁহারা পাতলচারী ও কামক্রোধাভিভূত হইয়া সর্ব্বদা কপট ব্যবহার দ্বারা জীবিকা নির্ব্বাহ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। তাঁহারা নূতন কলেবর পরিগ্রহ করিয়া লোভ ও মোহের একান্ত বশংবদ হইয়া উঠিলেন। তখন তাঁহারা নানাবিধ অশুভ কৰ্ম্মদ্বারা পাপগ্রস্ত, তির্য্যগ্যোনিগত ও নিয়য়গামী হইয়া বিচিত্র সংসারে পুনঃ পুনঃ পচ্যমান হইতে লাগিলেন। তাঁহাদিগের অভীষ্ট সঙ্কল্প ও জ্ঞান সকলই বিফল হইয়া গেল; তাঁহাদিগের মধ্যে প্রায় সকলেই শুভ কর্ম্ম করিতে লাগিলেন। তাঁহারা বিবেকনিধুর, সকল বিষয়েই শঙ্কিতচিত্ত, লোকসমাজের ক্লেশকর, দুষ্কুলজাত, ব্যাধিবহুল, দুরাত্মা, প্রতাপবিহীন, পাপিষ্ঠ, অল্পায়ু, সর্ব্বকামের অভিলসী, বিভিন্নহৃদয় এবং নাস্তিক হইয়া উঠিলেন। হে কৌন্তেয়! এই রূপে মৃত প্রাণী ইহকালে স্ব স্ব কর্ম্মানুসায়িনী গতি লাভ করে।

প্রাজ্ঞ অথবা হীনবুদ্ধি ব্যক্তির কর্ম্মসকল কোথায় থাকে এবং তাদৃশ ব্যক্তি কোথায় থাকিয়া সুকৃত ও দুষ্কৃতের ফল ভোগ করে; এক্ষণে ইহার বিশেষ সিদ্ধান্ত শ্রবণ করুন।

মনুষ্য দেবসৃষ্ট আদি শরীর দ্বারা অনেক প্রকার শুভাশুভ কর্ম্মের সঞ্চয় করে। পরিশেষে আয়ুঃশেষ হইলে এককালেই এই ক্ষীণপ্রায় কলেবর পরিত্যাগ করিয়া অন্তযোনিতে সম্ভূত হয়; ক্ষণমাত্রও সে দেহশূন্য হইয়া থাকে না ; সেই দেহান্তর পরিগ্রহকালে স্বকৃত কর্ম্মসকল ছায়ার ন্যায় তাহার অনুগত হয় এবং উহাই তাহার সুখদুঃখের কারণ হইয়া উঠে। জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিরা স্থির করিয়াছেন যে, কৃতান্তবিধিবশংবদ জন্তু প্রাপ্ত সুখ দুঃখ কদাচ দূরীকৃত করিতে সমর্থ হয় না। হে রাজন! হীনবুদ্ধি ব্যক্তির গতি নিরূপিত হইল; এক্ষণে জ্ঞানবানের পরমাগতি কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন।

যাহারা তপোনুষ্ঠান করিয়াছেন ; যাঁহারা সার্ব্বাগম-পরায়ণ, স্থিরব্রত, সত্যপর, গুরুশুশ্রূষু, সুশীল, বিশুদ্ধস্বভাব, দান্ত, পবিত্র যোনিসম্ভূত, সর্ব্বপ্রকার শুভ লক্ষণসম্পন্ন, জিতেন্দ্রিয় ও রোগরহিত; সেই মহাত্মারাই ঋষি। তাঁহারা সর্ব্বদা নিরুপদ্রবে কাল যাপন করেন; কি জায়মান, কি ভ্রাম্যমান, কি গর্ভস্থ, কি আত্মা, কি পর, সকলকেই জ্ঞানচক্ষুঃ দ্বারা বোধ করিতে পারেন। তাঁহারা এই কর্ম্মভূমিতে আগম করিয়া পুনরায় সুরলোকে গমন করেন। হে রাজন্! মনুষ্য কিছু বা দৈবাৎ, কিছু বা হঠাৎ ও কিছু বা স্বীয় কর্ম্মফল দ্বারা লাভ করে। ইহা স্থিরতর আছে ; আপনি এ বিষয়ে অন্য কোন বিচার করিবেন না।

হে যুধিষ্ঠির। এ বিষয়ে এক উদাহরণ প্রদান করিতেছি ; শ্রবণ করুন। মনুষ্য লোকে যাহা পরম শ্রেয়ঃ বলিয়া বিবেচিত হয়, কেহ তাহা ইহলোকে, কেহ পরলোকে, কেহ বা উভয়লোকেই প্রাপ্ত হয়। কেহ কেহ বা ইহলোক ও পরলোক কুত্রাপি প্রাপ্ত হয় না। যাহাদিগের বিপুল ধন আছে, যাহারা প্রতিদিন বিভূষিতাঙ্গ ও নিরন্তর কায়িক সুখে সংসক্ত হইয়া ক্রীড়াকৌতুকে কাল যাপন করে, ইহলোকই তাহাদিগের সুখকর; পর কালে, সুখ সম্ভাবনা থাকে না। যাহারা যোগী, তপস্যানুরক্ত, স্বাধ্যায়শীল, জিতেন্দ্রিয় ও প্রাণিবধে নিতান্ত পরাঙ্মুখ হইয়া দেহ জর্জ্জরিত করেন ; তাঁহাদিগেরই পরকালে সুখসম্ভোগ হয় ; ইহলোকে হয় না। যাঁহারা প্রথমে ধর্ম্মাচরণ ও ধৰ্ম্মতঃ ধনলাভ করিয়া যথাকালে দারপরিগ্রহ করিয়া যজ্ঞানুষ্ঠানে তৎপর হন, তাঁহাদিগের ইহ লোক ও পরলোক উভয় স্থানেই সুখ লাভ হয়। যে মূঢ়েরা বিদ্যা, তপস্যা, দান ও অপত্যোৎপাদন-বিষয়ে যত্ন করে না, তাহারা ইহলোক ও পরলোক উভয়ই সুখ-সম্ভোগে বঞ্চিত হয়।

হে কৌরবেন্দ্র! আপনারা সকলেই মহাবল পরাক্রান্ত, মহাসত্ত্ব, তেজস্বী ও কৃতবিদ্য, দেবকার্য্যের নিমিত্ত সুরলোক হইতে অবনীতলে অবতীর্ণ হইয়াছেন; আপনার সুমহৎ সুরকার্য্য সম্পাদনানন্তর দেবগণ, ঋষিগণ ও সমুদায় পিতৃলোকের যথাবিধি তৰ্পণ করিয়া পরিশেষে স্বীয় কৰ্ম্মফলে পুনরায় পুণ্যধাম সুরলোক প্রাপ্ত হইবেন; সন্দেহ নাই। অতএব হে রাজন্! এক্ষণে এই ক্লেশ সন্দর্শন করিয়া কিছুমাত্র বিশঙ্কিত হইবেন না।