১৭২. নিঃশেষে নিবাতকবচাদি নিপাত

১৭২তম অধ্যায়

নিঃশেষে নিবাতকবচাদি নিপাত

অর্জ্জুন কহিলেন, “মহারাজ! দৈত্যগণ মায়াপ্রভাবে অলক্ষিত হইয়া যুদ্ধ করিতে লাগিল; আমিও অদৃশ্যমান অস্ত্রসহকারে সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলাম। আমার গাণ্ডীবোম্মুক্ত শর-সমূহে ভূরি ভূরি দানবের মস্তকচ্ছেদন হইলে তাহারা ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়িল। এইরূপে নিবাতকবচগণের প্রাণসংহার করিলে তাহারা প্রকটিত মায়া উপসংহার করিয়া আত্মপুরীমধ্যে প্রবেশ করিল। তাহাদিগের অপসারণে দৃষ্টিপথ প্রকাশিত হইলে দেখিলাম, শতসহস্ৰ দানব নিহত হইয়া রণভূমিতে পতিত রহিয়াছে; তাহাদিগের অস্ত্ৰ, আভরণ, গাত্র ও কবচ-সকল চূৰ্ণ হইয়া গিয়াছে; তাহাদের মধ্যে এরূপ স্থান নাই যে তুরঙ্গগণ একপদ গমন করে।

“আমি এই সকল অবলোকন করিতেছি, এমন সময়ে নিবাতকবচগণ সহসা অলক্ষিত রূপে নভোমণ্ডল আচ্ছাদিত করিয়া শিলোচ্চয়-সমূহ বর্ষণ করিতে আরম্ভ করিল। কতকগুলি ভয়ানক দানব মৃত্তিকার অভ্যন্তরে বিলীন হইয়া অশ্বের চরণ ও রথের চক্ৰ ধারণ করিয়া রহিল। এইরূপে তাহারা সময়ে সময়ে অশ্ব ও রথ আকর্ষণপূর্ব্বক অচলসমূহে দিকসকল অবরুদ্ধ করিলে সেই স্থান পর্ব্বতগুহার ন্যায় প্রতীয়মান হইতে লাগিল।

“অনন্তর আমরা দানবকর্ত্তৃক নিতান্ত আক্রান্ত এবং পর্ব্বতাচ্ছন্ন হইয়া সাতিশয় কাতর ও ভীত হইয়াছি নিরীক্ষণপূর্ব্বক মহাত্মা মাতলি কহিলেন, “অর্জ্জুন! তুমি ভীত হইও না, বীজ গ্রহণ কর।” আমি মাতলির বাক্য শ্রবণপূর্ব্বক দৃঢ়তররূপে দণ্ডায়মান হইয়া গাণ্ডীবকে আমন্ত্রণপূর্ব্বক সুররাজের প্রিয়তম অতিভীষণ বজ্র উদ্যত করিলাম। পরে সেই বজ্র হইতে বজ্রস্বরূপ লৌহনির্ম্মিত বাণ-সমূহ বহির্গত হইয়া সেই সমস্ত মায়াময় পদার্থ ও নিবাতকবচগণের মধ্যে প্রবেশ করিলে তাহারা নিহত ও পরস্পর সংশ্লিষ্ট হইয়া ধরাতলে নিপতিত হইল। যে সকল দানব পৃথিবীর অভ্যন্তরে প্রবিষ্ট হইয়া অশ্ব ও রথ আকর্ষণ করিয়াছিল, আমার শর সকল তথায় প্রবেশ করিয়া তাহাদিগকেও শমনসদনে প্রেরণ করিল।

এইরূপে পর্ব্বতোপম নিবাতকবচগণ নিহত ও ধরাশায়ী হইলে সেই স্থান গিরিবরাকীর্ণ বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। কিন্তু কি আশ্চৰ্য্য! অশ্বগণ, রথ, মাতলি অথবা আমার কিছুমাত্র ক্ষতি বা অপকার হইল না। অনন্তর মাতলি সহাস্য-বদনে কহিলেন, ‘অর্জ্জুন! তোমার যেরূপ বলবীৰ্য্য অবলোকন করিলাম, বোধ হয় দেববৃন্দেরও তদ্রূপ বলবীৰ্য্য নাই।”

“এদিকে দানবগণ জীবনযাত্ৰা সংবরণ করিলে নগরমধ্যে দানবগোষাসকল শারদীয় সারসকুলের ন্যায় উচ্চস্বরে বোদন করিতে লাগিল। আমি তখন রথশব্দে তাহাদিগের ভয়োৎপাদনপূর্ব্বক মাতলি সমভিব্যাহারে পুরমধ্যে প্রবেশ করিলাম।

“দানবগণ ময়ূরসদৃশ দশসহস্ৰ অশ্ব ও সূৰ্য্যসদৃশ রথ অবলোকন করিয়া দলবদ্ধ হইয়া পলায়নপূর্ব্বক আপনি আপন রত্নমণ্ডিত স্বর্ণময় গৃহে প্রবেশ করিল। তৎকালে ভয়ব্যাকুল কুলবধুকুলের অলঙ্কার-ঝঙ্কার শৈলোপরি নিপতিত শিলার ন্যায় মধুর ধ্বনি উৎপাদন করিতে লাগিল।

“অনন্তর আমি সেই বিচিত্ৰ দানবনগরী অমরপুরী অপেক্ষাও উৎকৃষ্টতর নিরীক্ষণ করিয়া মাতলিকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘মহাশয়! এই অসুরনগর দেবনগর অপেক্ষাও সমধিক সৌন্দৰ্য্যশালী দেখিতেছি; অতএব কি নিমিত্ত দেবগণ এবংবিধ মনোহর নগরে অধিবাস করেন না?”

মাতলি কহিলেন, “হে পাৰ্থ! প্ৰথমে আমাদিগের দেবরাজেরই এই নগর ছিল; পরে নিবাতকবচগণ তীব্রতর তপানুষ্ঠানপূর্ব্বক পিতামহকে প্রসন্ন করিয়া এই স্থানে অধিবাস ও যুদ্ধে দেবগণ হইতে অভয় প্রার্থনা করে; তাহাতে কৃতকাৰ্য্য হইয়া নগর হইতে দেবগণকে অপসারিত করিয়া দেয়। অনন্তর দেবরাজ ইন্দ্ৰ আত্মাহিতার্থ তাহাদিগকে সংহার করিবার নিমিত্ত ভগবান কমলযোনিকে অনুরোধ করেন; তাহাতে তিনি কহিলেন, হে শত্ৰুহন্‌! তুমি দেহান্তরে অবতীর্ণ হইয়া উহাদিগকে সংহার করিবে।

‘দেবরাজ ব্ৰহ্মার নিকট সবিশেষ শ্রবণ করিয়া তোমাকে সমুদয় অস্ত্ৰ প্ৰদান করিয়াছেন। তুমি যে সমস্ত দানবগণকে বিনষ্ট করিয়াছ, দেবগণ কখনই তাহাদিগকে সংহার করিতে সমর্থ হইতেন না। পরে কমলযোনির বাক্যানুসারে কালক্রমে তুমিই তাহাদিগের কালস্বরূপ হইয়া এ স্থানে আগমন করিয়াছ। হে পুরুষেন্দ্ৰ! ভগবান মহেন্দ্ৰ দানবগণের বিনাশার্থ তোমাকে অত্যুত্তম অস্ত্ৰবল প্ৰদান করিয়াছেন।’

‘অনন্তর আমি নগরে শান্তিস্থাপন করিয়া মহাত্মা মাতলিসমভিব্যাহারে পুনরায় দেবপুরে গমন করিলাম।”