১৮৮. মার্কণ্ডেয়কর্ত্তৃক সৃষ্টিবর্ণন

১৮৮তম অধ্যায়

মার্কণ্ডেয়কর্ত্তৃক সৃষ্টিবর্ণন

বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে রাজন্ ! অনন্তর ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির বিনীতভাবে পুনরায় যশস্বী মার্কণ্ডেয়কে কহিলেন, “হে তপোধন! আপনি অনেক সহস্র যুগান্ত অবলোকন করিয়াছেন। মহাত্মা পরমেষ্ঠী ব্রহ্মা ব্যতিরেকে অন্য কেহই আপনার সদৃশ আয়ুষ্মন্ নহেন। প্রলয়কালে এই ভূলোক দেবদানববর্জ্জিত ও অন্তরীক্ষবিহীন হইলে পর আপনিই ব্রহ্মার উপাসনা করিয়া থাকেন। প্রলয় নিবৃত্ত হইলে যৎকালে সর্ব্বলোকপিতামহ ব্রহ্মা প্রবুদ্ধ হইয়া দিক্‌সমুদয় বায়ুভূত করিয়া সেই সেই উপায়দ্বারা জলবিক্ষেপপূর্ব্বক চতুর্ব্বিধ ভূতের সৃষ্টি করেন, তখন সেই সমুদয় ভূতনির্ম্মাণ আপনিই স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করিয়া থাকেন। আপনিই সমাধিতৎপর হইয়া লোকগুরু সর্ব্বলোকপিতামহ সাক্ষাৎ বিধাতার আরাধনা করিয়াছেন। হে বিপ্রসত্তম! আপনি অনেক উপায়ে এই সমস্ত বস্তু আত্মসম্মিত করিয়া তপানুষ্ঠানদ্বারা মরীচি প্রভৃতি বেধাদিগকে পরাজয় করিয়াছেন। আপনি নারায়ণের প্রধান ভক্ত; পরলোকে স্তূয়মান হইয়া থাকেন। আপনি অনেকবার যোগকলাদ্বারা হৃদয়কমল উদ্ঘাটিত করিয়া বৈরাগ্য ও যোগরূপ নেত্রদ্বয়ে কামরূপী ব্রহ্মাকে নিরীক্ষণ করিয়াছেন। এই নিমিত্ত ব্রহ্মার প্রসাদে সর্ব্বান্তক মৃত্যু ও দেহনাশিনী জরা আপনার শরীরে প্রবেশ করিতে সমর্থ হয় না। যৎকালে সূৰ্য্য, অগ্নি, বায়ু, চন্দ্রমা, অন্তরীক্ষ, পৃথিবী, দেব, অসুর ও মহোরগ প্রভৃতি সমুদয় স্থাবরজঙ্গম একবারে বিনষ্ট হইয়া যায়, সেই সময় একাকী আপনি একাৰ্ণবে পদ্মপত্ৰশায়ী অমিতাত্মা সর্ব্বভূতেশ্বর ব্রহ্মার উপাসনা করেন। আপনি সমুদয় পূর্ব্ববৃত্ত অনেকবার স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করিয়াছেন; সকল লোকমধ্যে আপনার অবিদিত কিছুই নাই। অতএব আমি আপনার নিকট তৎসমুদয় শ্রবণ করিতে ইচ্ছা করি।”

মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “হে রাজন্! আমি শাশ্বত, অব্যয়, অব্যক্ত, অতিসূক্ষ্ম, গুণস্বরূপ, নির্গুণাত্মা পুরাণপুরুষ স্বয়ম্ভূকে নমস্কার করিয়া তোমার সমীপে সমুদয় বৃত্তান্ত কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। এই সেই পীতবাসা জনার্দ্দন; ইনি কর্ত্তা, বিবিধরূপের বিধাতা, সর্ব্বভূতাত্মা, ভূতনির্ম্মাতা, অচিন্ত্য, মহৎ, আশ্চৰ্য্য ও পরম পবিত্র। ইনি অনাদিনিধন, বিশ্বাত্মক, অব্যয় ও অক্ষয়। ইনি স্বয়ং কর্ত্তা, কাহারও কাৰ্য্য নহেন; ইনি পুরুষত্বের কারণ। ইনিই বেদের অবিদিত সেই সর্ব্বজ্ঞেশ্বর পরমপুরুষ।।

সৃষ্টিপ্রসঙ্গে যুগবর্ণন

“হে মনুজসত্তম! প্রলয়কালে সমুদয় বিনষ্ট হইলে অবাঙ্মনসগোচর পরমাত্মা হইতেই এই আশ্চর্য্যপরিপূর্ণ সমস্ত মহ জগৎ পুনরায় সৃষ্ট হয়। তাহার প্রথম সত্যযুগ; সেই সত্যযুগের পরিমাণ চতুঃসহস্র বৎসর। ঐ যুগের সন্ধ্যা চতুঃশত বৎসর এবং সন্ধ্যাংশও সেইরূপ। ত্রেতাযুগ ত্রিসহস্রবর্ষ-পরিমিত; উহার সন্ধ্যা ত্রিশত বৎসর এবং সন্ধ্যাংশও তাদৃশ। দ্বাপরযুগের পরিমাণ দ্বিসহস্র বৎসর; উহার সন্ধ্যা ও সন্ধ্যাংশ প্রত্যেকে দ্বিশত বৎসর। কলিযুগ একসহস্ৰ বৰ্ষমাত্রাত্মক; উহার সন্ধ্যা ও সন্ধ্যাংশ একশত বৎসর। হে মহারাজ! কলিযুগ ক্ষয় হইলে পুনরায় সত্যযুগ সমুপস্থিত হয়; এইরূপ দ্বাদশ-সহস্র-বার্ষিক যুগাখ্যা পরিকীর্ত্তিত হইল। সহস্র মানুষী যুগাখ্যা এক ব্রাহ্মী যুগাখ্যার সমান। এই বিশ্ব ব্রহ্মভবনে সর্ব্বদা পরিবর্ত্তিত হইতেছে। পণ্ডিতগণ সেই। বিশ্বপরিবর্ত্তনকেই প্রলয় বলিয়া নির্দেশ করিয়া থাকেন।

কলিযুগের বিভীষিকা

“হে নরনাথ! কলিযুগ অল্পমাত্রাবশিষ্ট হইলে মনুষ্যগণ প্রায় মিথ্যাবাদী হইবে। তৎকালে যজ্ঞপ্রতিনিধি, দান-প্রতিনিধি ও ব্রত প্রতিনিধি প্রতিষ্ঠিত হইবে। ব্রাহ্মণগণ শূদ্রের ন্যায় আচরণ করিবে এবং শূদ্রগণ ধনোপার্জ্জনপরায়ণ ও ক্ষাত্রধর্ম্মানুবর্ত্তী হইবে। ব্রাহ্মণগণ যজ্ঞ ও স্বাধ্যায়ে জলাঞ্জলি প্রদান এবং দণ্ড ও অজিন বিসর্জ্জনপূর্ব্বক সবর্ভক্ষ হইবে এবং জপ পরিত্যাগ করিবে। শূদ্রগণ জপপরায়ণ হইবে। এইরূপে লোকমৰ্য্যাদা বিপরীত হওয়াই প্রলয়ের পূর্ব্বলক্ষণ।

“হে রাজন! ঐ সময় আন্ধ্র, শক, পুলিন্দ, যবন, কাম্বোজ, বাহ্লীক, শূর ও আভীর প্রভৃতি বহুবিধ স্লেচ্ছজাতীয় ভূপতিগণ মিথ্যাবাদপরায়ণ ও পাপাসক্ত হইয়া মিথ্যা শাসন করিবে। তৎকালে কোন ব্রাহ্মণই স্বধর্ম্মোপজীবী হইবে না। যাবতীয় ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য বিরুদ্ধকর্ম্মানুষ্ঠান করিবে; মনুষ্যগণ অল্পায়ু, অল্পবল, অল্পপরাক্রমক, অল্পসার, অল্পদেহ ও অল্পসত্যভাষী হইবে। জনপদসমুদয় শূন্যপ্ৰায় ও দিক্‌সকল মৃগ ও হিংস্ৰজন্তু-সমূহে পরিপূর্ণ হইবে। মনুষ্যগণ কপট ব্রহ্মবাদী হইবে। শূদ্রগণ ব্রাহ্মণগণকে ‘ভো’ বলিয়া সম্বোধন করিবে, ব্রাহ্মণগণ শূদ্রদিগকে আর্য্য বলিয়া সম্বোধন করিবে, জন্তুসংখ্যার বৃদ্ধি হইবে, গন্ধদ্রব্যের তাদৃশ গন্ধ থাকিবে না। রসসমুদয় তদ্রূপ সুস্বাদু হইবে এবং মনুষ্যগণ অনেকাপত্য, হ্রস্বদেহ ও আচারভ্রষ্ট হইয়া যাইবে। কামিনীগণ আপন মুখে ভগকাৰ্য্য সমাধা করিবে। জনপদস্থ মনুষ্য-সমুদয় সতত ক্ষুধাদিগ্রস্ত হইবে, চতুস্পথ-সমুদয় লম্পট ও বেশ্যাগণে পরিপূর্ণ হইবে এবং পত্নীগণ স্বামীদিগের দ্বেষ করিবে। ধেনু-সকল অল্পদুগ্ধ প্রদান করিবে এবং বৃক্ষগণ অল্প-পুষ্পফুলযুক্ত ও বায়সকুলাকীর্ণ হইবে। লোভমোহপরতন্ত্র ব্রাহ্মণগণ কপট ধর্ম্মচিহ্ন পরিবৃত হইয়া ব্রহ্মহত্যানুলিপ্ত মিথ্যাবাদী রাজগণের নিকট প্রতিগ্ৰহ করিবে। গৃহস্থগণ সমধিক করপ্রদানভয়ে ভীত হইয়া চৌর্য্যবৃত্তি অবলম্বন করিবে। ব্রাহ্মণগণ বাণিজ্যোপজীবী হইবে এবং অনর্থক মুনিগণের ন্যায় নখরোম ধারণপূর্ব্বক ছদ্মবেশে অবস্থান করিবে। ব্রহ্মচারিগণ অর্থলোভে বৃথাচার, মদ্যপায়ী ও গুরুতল্পগামী হইবে। মনুষ্যগণ ইহলোকে কেবল মাংস ও শোণিত-বর্জ্জনের চেষ্টা করিবে। আশ্রম-সকল পরান্নভোজী পাষণ্ডসমুদয়ে সংকীর্ণ হইয়া উঠিবে। ভগবান ইন্দ্র যথাকালে বারিবর্ষণ করিবেন না। সমুদয় বীজ হইতে অঙ্কুর সম্যকরূপে উদ্ভিন্ন হইবে না। লোকসকল হিংসাপরায়ণ ও অশুচি হইয়া উঠিবে; অধর্ম্মফল প্রবল হইবে।

“হে মহারাজ! ঐ সময় ধর্ম্মপরায়ণ হইলে মানব অল্পায়ু হইবে। ফলতঃ তৎকালে কোন ধর্ম্মই থাকিবে না। মানবগণ কৃট[ওজনে কম দেওয়া]পরিমাণে দ্রব্য বিক্রয় করিবে। বণিকগণ বহুবিধ কপট ব্যবহার করিবে। ধর্ম্মের বলহানি ও অধর্ম্ম বলীয়ান হইয়া উঠিবে। ধর্ম্মিষ্ঠ মানবগণ অতিহীন, অল্পায়ু ও দরিদ্র হইবে, পাপাত্মারা পরিবর্দ্ধিত, দীর্ঘায়ু ও সুসমৃদ্ধ হইয়া উঠিবে। ধর্ম্মভ্রষ্ট প্রজাগণ নাগরিকদিগের ক্রীড়ার সময়ে ধর্ম্মবিরুদ্ধ উপায় ব্যবহার করিবে, লোকসকল অল্পমাত্র ধনে ঐশ্বৰ্য্যশালীর ন্যায় গর্ব্বিত হইবে। বিশ্বাসপূর্ব্বক নির্জ্জনে ন্যাস্ত ধন-সকল অপহরণ করিবার নিমিত্ত লজ্জাপরিহারপূর্ব্বক ‘আমার নিকট তোমার ধন নাই’ বলিয়া ন্যাসকারীকে প্রত্যাখ্যান করিবে। নরমাংসলোলুপ জন্তু, পক্ষী ও মৃগ সমুদয় নগরের ক্রীড়াস্থান ও চৈত্য-সমুদয়ে শয়ান থাকিবে। কামিনীগণ সপ্তম বা অষ্টমবর্ষ বয়ঃক্রমকালে গর্ভবতী হইবে, পুরুষগণ দশ বা দ্বাদশবর্ষ বয়ঃক্রমসময়ে পুত্রোৎপাদন করিবে এবং মনুষ্যগণ ষোড়শবর্ষেই জরাগ্রস্ত হইয়া অতি অল্পকালের মধ্যেই করাল কালকবলে নিপতিত হইবে। বালকগণ বৃদ্ধদিগের ন্যায় ও বৃদ্ধেরা বালকগণের ন্যায় ব্যবহার করিবে। বিপরীতচারিণী রমণীগণ উপযুক্ত পতিদিগকে বঞ্চনা করিয়া দাস ও পশুদিগকে লইয়া আপনাদিগের নিকৃষ্ট প্রবৃত্তি চরিতার্থ করিবে। কি বীরপত্নীগণ, কি সামান্য মহিলাগণ সকলেই পতি বর্ত্তমানেও পুরুষান্তর-সংসর্গ করিবে।

শেষ কলির অবস্থা

“হে মহারাজ! কলিযুগের শেষে সমুদয় প্রাণীগণের আয়ুক্ষয় হইবে, বহুবার্ষিক অনাবৃষ্টি হইবে। তন্নিবন্ধন অনেকানেক ক্ষুধিত অল্পসার প্রাণীগণ শমনসদনে গমন করিবে। তৎপরে এককালে সপ্ত সূৰ্য্য সমুদিত হইয়া সমুদ্র ও নদী-সকলের জল শোষণ করিবে। শুষ্কই হউক বা আর্দ্রই হউক, কিছু তৃণকাষ্ঠ পৃথিবীতে থাকিবে, তৎসমুদয় ভস্মসাৎ হইয়া যাইবে। অনন্তর সংবর্ত্তকনামে বহ্নি বায়ু-সহায় হইয়া আদিত্যোপশোষিত ভূমণ্ডল আক্রমণ করিবে এবং পৃথিবী ভেদ করিয়া পাতালতলে প্রবেশপূর্ব্বক দেব, দানব ও যক্ষগণের ভয়েৎপাদন করিবে।

প্রলয়কালীন অগ্নিজলবায়ু-প্রাদুর্ভাববর্ণন

“হে রাজন! এইরূপে সেই অগ্নি পৃথিবীস্থ ও পাতালতলস্থ সমুদয় পদার্থ দগ্ধ করিবে। ফলতঃ সেই অমঙ্গলবিধায়ক বায়ু ও সংবর্ত্তক অনলদ্বারা দেব, অসুর, গন্ধর্ব্ব, যক্ষ, উরগ ও রাক্ষসগণে সমাকীর্ণ সমুদয় জগৎ এককালে ভস্মীভূত হইয়া যাইবে। তৎপরে গজকুলসদৃশ, তড়িম্মালা-বিভূষিত অদ্ভুতদর্শন মেঘসকল নভোমণ্ডলে সমুত্থিত হইবে। এই সমস্ত মেঘের মধ্যে কতকগুলি নীলোৎপলসন্নিভ, কতকগুলি কুমুদের ন্যায়, কতকগুলি কিঞ্জল্কসদৃশ, কতকগুলি পীতবর্ণ, কতকগুলি হরিদ্রাকার, কতকগুলি কাকডিম্বতুল্য, কতকগুলি পদ্মপত্রবর্ণ, কতকগুলি হিঙ্গুলবর্ণ, কতকগুলি শ্রেষ্ঠ নগরাকার, কতকগুলি গজযূথসন্নিভ, কতকগুলি অঞ্জনবর্ণ ও কতকগুলি মকরসদৃশ, ঐ সমস্ত বিদ্যুন্মালা-বিভূষিত ঘোররূপ গম্ভীরনিঃস্বন পরমেষ্ঠিপ্রেরিত জলধরপুঞ্জ নভোমণ্ডলে ব্যাপ্ত হইয়া মুষলধারে বারিবর্ষণপূর্ব্বক পর্ব্বত ও কাননসমেত সমুদয় মেদিনীমণ্ডল প্লাবিত ও সেই ঘোরতর অশিব সংবর্ত্তক হুতাশন নির্ব্বাপিত করিবে।

“হে পাণ্ডবনাথ! এইরূপে ক্রমাগত দ্বাদশ বৎসর অবিচ্ছেদে বৃষ্টিধারা পতিত হইলে পর সমুদ্রজল বেলাভূমি অতিক্রম করিয়া উঠিবে। ঐ সময় পর্ব্বত-সকল বিদীর্ণ ও পৃথিবী জলনিমগ্ন হইয়া যাইবে। পরে সেই সমুদয় বারিধর প্রবল বায়ুবেগে আহত হইয়া চতুর্দ্দিকে ভ্রমণপূর্ব্বক সহসা বিনষ্ট হইয়া যাইবে। তখন কমলালয় আদিদেব স্বয়ম্ভু আকাশসঙ্কোচ করিয়া সেই সকল প্রবল পবন পান করিয়া নিদ্রাগত হইবেন।

প্রলয়জলে ভাসমান শিশুরূপী মহাপুরুষ কথা

“হে মহীপাল! সেই প্রলয়কালে সমুদয় দেব, অসুর, যক্ষ, রাক্ষস, মনুষ্য, শ্বাপদ, মহীরুহ, অন্তরীক্ষ প্রভৃতি যাবতীয় স্থাবরজঙ্গম বিনষ্ট হইয়া কেবল একার্ণবমাত্র অবশিষ্ট হইলে আমি একাকী সেই অসীম সলিলে সঞ্চরণপূর্ব্বক সমুদয় বিনষ্ট দেখিয়া নিতান্ত বিষণ্ন হইব। এইরূপে সুদীর্ঘকাল নিরবলম্ব হইয়া জলে প্লবমন হইতে হইতে নিতান্ত পরিশ্রান্ত হইয়া উঠিব। কিয়ৎকালান্তর সেই একার্ণবমধ্যে এক বিশাল ন্যাগ্রোধপাদপ নয়নগগাচর হইবে। হে রাজন! ঐ পাদপের সুবিস্তীর্ণ শাখায়, দিব্যাস্তরণসংস্তীর্ণ পর্য্যঙ্কোপরি সমুপবিষ্ট পূর্ণচন্দ্রনিভানন কমললোচন এক বালক আমার নেত্রপথে পতিত হইবেন। আমি তাঁহাকে অবলোকন করিবামাত্র অতিমাত্র বিস্ময়ান্বিত হইয়া মনে মনে চিন্তা করিব, কি আশ্চর্য্য! সমুদয় লোক বিনষ্ট হইয়াছে; কিন্তু এই শিশু এ স্থানে কিরূপে অবস্থিতি করিতেছেন? হে মহারাজ! আমি ত্রিকালজ্ঞ হইয়াও তৎকালে ধ্যানদ্বারা ঐ শিশুকে নিরূপণ করিতে সমর্থ হইব না। ঐ বালক অতস কুসুমসন্নিভ, তাঁহার শ্রীবৎসভূষণ লক্ষ্মীর আবাস।

“তখন সেই কমলনয়ন বালক সুমধুর-বাক্যে আমাকে কহিবেন, ‘হে মার্কণ্ডেয়! আমি তোমাকে জানি; তুমি নিতান্ত পরিশ্রান্ত হইয়া বিশ্রাম বাসনা করিতেছ, অতএব আমার শরীরমধ্যে প্রবেশপূর্ব্বক যত কাল ইচ্ছা হয়, বাস কর। আমি তোমার প্রতি প্রসন্ন হইয়াছি। হে রাজন! বালকের ঐ বাক্য শ্রবণে আমার স্বীয় দীর্ঘজীবিত ও মনুষ্যত্বে নিতান্ত নির্ব্বেদ সমুপস্থিত হইবে। অনন্তর সেই বালক সহসা মুখব্যাদান করিবেন; আমিও দৈবযোগে তাঁহার মুখমধ্যে প্রবেশ করিব।

“হে মহারাজ! তদনন্তর আমি সহসা তাঁহার জঠরমধ্যে প্রবেশ করিয়া বিবিধ রাজ্য ও নগরসমাকীর্ণ সমুদয় মেদিনী মণ্ডল অবলোকনপূর্ব্বক ভ্রমণ করিব। তথায় গঙ্গা, শতদ্রু, সীতা, যমুনা, কৌশিকী, চমতী, বেত্রবতী, চন্দ্রভাগা, সরস্বতী, সিন্ধু, বিপাশা, গোদাবরী, বস্কোকসারা, নলিষী, নর্ম্মদা, তাম্ৰা, বেণ্বা, পুণ্যতোয়া, শুভাবহা, সুবেণা, কৃষ্ণবেণা, ঈরামা, বিতস্তা, কাবেরী, শোণ, বিশল্যা ও কিম্পুনা প্রভৃতি নদী-সকল; যাদের গণনিষেবিত, নানারত্ন-সংযুক্ত পয়োনিধি; চন্দ্রসূৰ্য্যবিরাজিত জাজ্বল্যমান গগনমণ্ডল এবং নানাবিধ বনরাজি বিরাজিত হইতেছে; ব্রাহ্মণগণ নানাবিধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিতেছেন। ক্ষত্রিয়গণ সকল বর্ণের অনুরঞ্জন করিতেছেন, বৈশ্যগণ যথাবিধি কৃষিকার্য্যনির্ব্বাহ করিতেছে ও শূদ্রেরা ব্রাহ্মণগণের শুশ্রুষায় নিরন্তর নিরত রহিয়াছে। হিমাচল, হেমকূট, নিষধ, রজতসঙ্কীর্ণ, শ্বেতগিরি, গন্ধমাদন, মন্দর, মহাগিরি নীল, কনকময় মেরু, মহেন্দ্র, বিন্ধ্য, মলয়, পারিপাত্র প্রভৃতি রত্নবিভূষিত পর্ব্বতসমুদয় শোভা পাইতেছে। সিংহ, ব্যাঘ্র, বরাহ প্রভৃতি জন্তুগণ ইতস্ততঃ বিচরণ করিতেছে। শুক্রাদি-সমুদয় অমর, সাধ্য, রুদ্র, রাহু, আদিত্য, গুহ্যক, পিতৃলোক, সর্প, নাগ, সুপর্ণ, বসু, অশ্বিনীকুমার, গন্ধর্ব্ব, অপ্সরা, যক্ষ ও ঋষিগণ এবং কালেয় প্রভৃতি দৈত্য-দানবগণ স্বচ্ছন্দে রহিয়াছে। পূর্ব্বে লোকমধ্যে যাহা যাহা আমার দৃষ্টিগোচর হইয়া থাকে তৎসমুদয়ই সেই মহাত্মার কুক্ষিদেশে দেখিতে পাইব।

প্রলয়কালীন বিষ্ণুর উদরস্থিত মার্কণ্ডেয়ের অবস্থা

“হে রাজন্! আমি এইরূপে তাঁহার উদরমধ্যে সমুদয় জগৎ নিরীক্ষণপূর্ব্বক বহু বৎসর ভ্রমণ করিয়া পরিশেষে তাঁহার শরীরের অন্ত পাইবার নিমিত্ত সতত ধাবমান হইব, কিন্তু কোনমতেই কৃতকাৰ্য্য হইতে পারিব না। তখন আমি উপায়ান্তর না পাইয়া কায়মনোবাক্যে সেই বরদাতা রমণীয় দেবের শরণাগত হইব। তৎপরে অকস্মাৎ তাঁহার বিবৃত মুখবিবর হইতে বায়ুবেগে বিনির্গত হইয়া নিরীক্ষণ করিব যে, সেই বালবেশধারা শ্রীবৎসাঙ্কিতকলেবর অমিততেজাঃ পুরুষ সেই বটবৃক্ষের শাখাতেই রহিয়াছেন। তিনি তৎকালে আমাকে সন্দর্শন করিয়া প্রীতচিত্তে সহাস্যবদনে কহিবেন, ‘হে মুনিসত্তম মার্কণ্ডেয়! তুমি বহুকাল জলে প্লবমান হইয়া নিতান্ত ক্লান্ত হইয়াছিলে, কেমন, এখন ত’ আমার শরীরমধ্যে বাস করিয়া উত্তমরূপে পরিমাপনোদন করিলে?’

“অনন্তর আমার নূতন দৃষ্টি পুনরায় প্রাদুর্ভূত হইলে তদ্বারা লন্ধচেতাঃ আত্মাকে বিনির্ম্মুক্ত দেখিব। তখন সেই অমিততেজাঃ বালকের অপরিমিত প্রভাব অবলোকন করিয়া তাঁহার রক্ততল সুপ্রতিষ্ঠিত চরণযুগল মস্তকে ধারণ ও বন্দনপূর্ব্বক কৃতাঞ্জলিপুটে বিনয়-বচনে কহিব, ‘আমার কি শুভদৃষ্ট! অদ্য সর্ব্বভূতাত্মা ভগবান্ কমললোচনকে দেখিলাম। হে দেব! তোমার এই অদ্ভুত মায়া ও তোমাকে জানিতে আমার নিতান্ত ঔৎসুক্য জন্মিয়াছে। আমি তোমার আস্যদ্বারা তোমার শরীরের অভ্যন্তরে প্রবেশপূর্ব্বক জঠরমধ্যে দেব, দানব, রাক্ষস, যক্ষ, গন্ধর্ব্ব, নাগ, নর, পর্ব্বত, কানন প্রভৃতি স্থাবরজঙ্গমাত্মক সমুদয় জগৎ অবলোকন করিলাম। হে দেব! তোমার প্রসাদে আমার স্মৃতি তিরোহিত হয় নাই। আমি তোমার শরীরমধ্যে সতত দ্রুতবেগে ভ্রমণ করিয়া পরিশেষে তোমারই ইচ্ছানুসারে বহির্গত হইলাম। হে পুণ্ডরীকাক্ষ! আমি তোমাকে জানিতে নিতান্ত অভিলাষী হইয়াছি। তুমি কি নিমিত্ত সমুদয় জগৎ ভক্ষণ করিয়া বালকবেশে এই প্রদেশে অবস্থান করিতেছ? কি নিমিত্ত এই সমুদয় জগৎ তোমার শরীরস্থ হইয়া রহিয়াছে? আর কত কালই বা তুমি এই স্থানে থাকিবে? হে দেবেশ! তোমার নিকট এই সমস্ত বৃত্তান্ত সবিস্তারে শ্রবণ করিতে বাসনা করি। কেন না, আমি যাহা জিজ্ঞাসা করিলাম, ইহা নিতান্ত মহৎ ও অচিন্ত্য।’

“সেই মহাদ্যুতি দেবদেব আমার বাক্য-শ্রবণানন্তর আমাকে সান্ত্বনা করিয়া সমুদয় বৃত্তান্ত কহিতে আরম্ভ করিবেন।”