১৫৯. রাজর্ষি আর্ষ্টিষেণাশ্রমে পাণ্ডবগমন

১৫৯তম অধ্যায়

রাজর্ষি আর্ষ্টিষেণাশ্রমে পাণ্ডবগমন

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ!! ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির সেই তপঃপ্রভাবসম্পন্ন রাজর্ষি আষ্টিষেণের সমীপে সমুপস্থিত হইয়া আপনার নামকীর্ত্তনপূর্ব্বক তাহাকে অভিবাদন করিলেন। তৎপরে দ্ৰৌপদী, ভীমসেন, নকুল ও সহদেব সেই রাজর্ষিকে অভিবাদনপূর্ব্বক তাহার চতুর্দ্দিকে দণ্ডায়মান রহিলেন; পাণ্ডবাপুরোহিত ধর্ম্মজ্ঞ ধৌম্যও সেই সংশিতব্রত রাজৰ্ষিকে যথাযোগ্য সম্মান করিলেন। ধর্ম্মাত্মা রাজর্ষি আষ্টিষেণ স্বীয় দিব্যচক্ষুপ্রভাবে পাণ্ডুনন্দনবোধে তাঁহাদিগকে উপবেশন করিতে অনুমতি প্ৰদান করিলেন।

মহারাজ যুধিষ্ঠির রাজর্ষির আদেশানুসারে ভ্রাতৃগণসমভিব্যাহারে উপবেশন করিলে ধর্ম্মাত্মা আষ্টিষেণ তাঁহাদিগকে যথাযোগ্য সমাদরপূর্ব্বক অনাময় প্রশ্ন করিয়া যুধিষ্ঠিরকে সম্বোধন করিয়া কহিতে লাগিলেন, “হে ধর্ম্মানন্দন! আপনার ত’ অধর্ম্মে মতি নাই? সর্ব্বদাই ত’ ধর্ম্মে প্রবৃত্তি আছে? মাতাপিতার আজ্ঞাপালন ও শ্রাদ্ধাদি-সম্পাদনে ত’ পরাঙ্মুখ হয়েন না? আপনি ত’ বিদ্বান, বৃদ্ধ, গুরুজন ও বেদপারগদিগকে পূজা করিয়া থাকেন? পাপকর্ম্মে ত’ মতি নাই? আপনি ত’ পুণ্যকর্ম্মের সমাদর ও পাপকর্ম্মের পরিহার করিয়া থাকেন? আত্মশ্লাঘা ত’ কখন করেন না? সাধুগণকে ত’ যথাযোগ্য সম্মান করিয়া আনন্দিত করেন? বনে বাস করিয়াও ত’। ধর্ম্মপথাবলম্বী রহিয়াছেন? মহাত্মা ধৌম্য ত” আপনার আচার-সন্দর্শনে পরিতৃপ্ত হয়েন? আপনি স্বীয় পূর্ব্বপুরুষাচরিত দান, ধর্ম্ম, তপ, শৌচ, আর্জ্জব ও তিতিক্ষায় ত’ নিয়ত রত রহিয়াছেন। রাজর্ষিগণ-প্রস্থিত মার্গে ত’ গমন করিয়া থাকেন? হে ধর্ম্মানন্দন! পিতৃগণ স্ব স্ব কুলসম্ভূত পুত্রপৌত্ৰাদির অসৎ ও সৎকর্ম্ম সন্দর্শনে ইহাদিগের অধর্ম্মে আমাদিগকে সাতিশয় দুঃখভোগ করিতে হইবে ও ইহাদিগের ধর্ম্মবলে আমরা অমল সুখসম্পত্তি সম্ভোগ করিব, এই মনে করিয়া শোক ও আহ্লাদ প্রকাশ করিয়া থাকেন। যে ব্যক্তি পিতা, মাতা, অগ্নি, গুরু ও আত্মা এই পাঁচজনকে পরিতুষ্ট করিতে পারে, তাহার উভয় লোক জয় করা হয়।”

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে ভগবন! আপনি আমাকে যেরূপ ধর্ম্ম কহিলেন, আমি স্বীয় সাধ্যানুসারে বিধিবৎ তাহার অনুষ্ঠান করিয়া থাকি।”

আষ্টির্ষেণ কহিলেন, “হে যুধিষ্ঠির! জলপায়ী, বায়ুভক্ষ ও গগনচারী মহর্ষিগণ প্রতি পর্ব্বসন্ধিতে এই পর্ব্বতে আগমন করিয়া থাকেন। পরস্পরানুরক্ত নায়ক নায়িকাগণ এই পর্ব্বতশৃঙ্গে কিম্পপুরুষগণের ন্যায় পরমসুখে বাস করে; বহুসংখ্যক অপ্সরা ও গন্ধর্ব্বগণ নানাবিধ পরিষ্কৃত বসনাভরণভূষিত হইয়া বিচরণ করে; মাল্যধারী প্রিয়দর্শন বিদ্যাধরগণ, মহোরাগ-সকল ও সুপর্ণ [সুন্দরপক্ষবিশিষ্ট পক্ষী]-সমুদয় এই স্থানে সতত অবস্থান করে। এই পর্ব্বতের উপরিভাগে প্রতি পর্ব্বসন্ধিতে ভেরী, পণব, শঙ্খ ও মৃদঙ্গের ধ্বনি হইয়া থাকে; উহা এই স্থানে অবস্থিতি করিয়াই শ্রবণ করুন; তথায় যাইবার বাসনা করিবেন না; কারণ, সে স্থান অতি দুৰ্গম। ইহার পর দেববৃন্দের বিহারস্থান; তথায় মনুষ্যগণের গমন করিবার শক্তি নাই। ঈষৎ অব্যবস্থিতচিত্ত ব্যক্তিও ঐস্থানে গমন করিলে অত্ৰত্য প্রাণীগণ তাহাদিগকে দ্বেষ করে ও রাক্ষসগণ তাড়না করে। হে যুধিষ্ঠির! এই কৈলাসপর্ব্বতের শিখর অতিক্রম করিলে পরসিদ্ধ— দেবর্ষিগণের স্থান দৃষ্ট হয়। যদি কোন মনুষ্য চপলতাপ্রযুক্ত ঐ স্থানে গমন করে, তাহা হইলে রাক্ষসগণ শূল প্রভৃতি অস্ত্রশস্ত্রদ্বারা তাহাকে তাড়না করে। ধনাধিপতি কুবের প্রতি পর্ব্বসন্ধিতে অপ্সরাগণ-পরিবৃত হইয়া এই স্থানে সমুপস্থিত হইলে সমুদয় প্রাণীগণ তাঁহাকে সমুদিত সূৰ্য্যের ন্যায় নিরীক্ষণ করে। সেই সময় গুহ্যকেশ্বরের উপাসনাৰ্থ সমাগত গায়কশ্রেষ্ঠ, তুম্বুরুর গীত ও সামধ্বনি শ্রুত হইয়া থাকে। হে যুধিষ্ঠির! এই স্থানে সমুদয় প্রাণীগণ প্ৰতি পর্ব্বসন্ধিতে এইরূপ নানাবিধ বিচিত্ৰ বস্তু দর্শন করে।

“হে পাণ্ডবগণ! যতদিন আপনারা অর্জ্জুনের দর্শনপ্রাপ্ত না হইবেন, তাবৎকাল এই সমস্ত মুনিভোজ্য সুরসি ফল ভক্ষণ করিয়া এই স্থানে বাস করুন। এই স্থানে আগমন করিয়া চঞ্চল হওয়া অতি অকর্ত্তব্য। হে বৎসগণ! আপনারা এক্ষণে এই স্থানে কিয়দ্দিন স্বেচ্ছানুসারে বাস ও বিহার করিয়া পরিশেষে স্বীয় শস্ত্রবলে পৃথিবী জয় করিয়া পালন করিবেন।”