১৮৫. অত্রিকর্ত্তৃক ঋষিচরিত-বর্ণন

১৮৫তম অধ্যায়

অত্রিকর্ত্তৃক ঋষিচরিত-বর্ণন

মার্কণ্ডেয় কহিলেন, ‘হে রাজন! আমি পুনর্ব্বার ব্রাহ্মণগণের সৌভাগ্য কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। পূৰ্ব্বে বৈন্য নামে এক রাজা অশ্বমেধ-যজ্ঞে দীক্ষিত হইয়াছিলেন। শুনিয়াছি, মহর্ষি অত্রি বিত্তপ্রার্থনায় তৎসন্নিধানে গমন করিবার মানস করিলেন, কিন্তু ধৰ্ম্ম প্রকাশ হইলে অবশ্য ফলহানি হইবে, এই আশঙ্কায় সমধিক অর্থ আহরণে তাঁহার প্রত্যাশা ছিল না। পরিশেষে পর্য্যালোচনা করত বনগমনে কৃতসঙ্কল্প হইয়া স্বীয় সহধর্ম্মিনী ও পুত্রগণকে আহবানপূর্ব্বক কহিলেন, “চল, আমরা নিরুপদ্রব অরণ্যে প্রস্থান করি, তথায় বহুসংখ্যক অক্ষয় ফললাভ হইবে। বোধ হয়, তোমরা শীঘ্রই এ বিষয়ে সম্মতি প্রকাশ করিবে।” তখন তার ভাৰ্য্যা কহিলেন, “হে নাথ! আপনি বৈন্যসন্নিধানে গমন করিয়া ধন প্রার্থনা করুন। সেই যাজ্ঞিক রাজা আপনাকে অবশ্যই সমধিক অর্থদান করিবেন। আপনি তাঁহার নিকট ধনগ্রহণপূর্ব্বক পুত্র প্রভৃতি পোষ্যবর্গকে উহ বিভাগ করিয়া দিয়া যথেচ্ছ প্রদান করুন, তাহাতে কোন হানি নাই। ধৰ্ম্মশাস্ত্রকারেরা উহাকেই পরম ধৰ্ম্ম বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন।”

অত্রি কহিলেন, “হে মহাভাগে! মহর্ষি গৌতম কহিয়াছেন যে, বৈন্যরাজা ধর্ম্মপরায়ণ ও সত্যবাদী, কিন্তু তথায় আমার বিদ্বেষী কয়েকজন ব্রাহ্মণবাস করিয়া থাকেন, তাঁহাৱা ধৰ্ম্মকামার্থযুক্ত কল্যাণকর বাক্যও নিরর্থক বলিয়া কীর্ত্তন করিবেন, এই নিমিত্ত সেই স্থানে গমন করিতে আমার মন নিতান্ত অপ্রশস্ত হইতেছে, কিন্তু কেবল তোমার বাক্য রক্ষার নিমিত্ত আমি বৈন্যযজ্ঞে গমন করিব, তথায় উপস্থিত হইলে রাজা আমাকে প্রভূত অর্থ ও গোদান করিবেন, সন্দেহ নাই।” এই বলিয়া মহাতপাঃ অত্রি অনতিবিলম্বে বৈন্যযজ্ঞে উপনীত হইলেন এবং তাঁহাকে সমুচিত সৎকারপূর্ব্বক মাঙ্গলিক মধুর 
বাক্যে স্তব করিতে লাগিলেন
, “হে মহারাজ! আপনি ধন্য, প্রভু ও ভূমণ্ডলের প্রথমভূপতি, মুনিজনেরাও আপনার 
স্তুতিবাদ করিয়া থাকেন
, আপনা অপেক্ষা ধৰ্ম্মাত্মা আর কেহ নাই।”

মহর্ষি গৌতম এই কথা শ্রবণ করিবামাত্র রোষাবেশ প্রকাশপূর্ব্বক কহিলেন, “হে অত্রে! তুমি এরূপ কথা আর কখন কহিও না, তোমার বুদ্ধি অদ্যাপি পরিণত হয় নাই। আমাদিগের প্রথম প্রতিপালক প্রজাপতি মহেন্দ্র ভিন্ন আর কেহই নাই।” অত্রি কহিলেন, “হে গৌতম! প্রজাপতি ইন্দ্রের ন্যায় ইনিও সমস্ত বিধান করিয়া থাকেন। তুমিই এক্ষণে মোহে অভিভূত হইতেছ এবং তোমারই প্রজ্ঞা বলপরিহীন হইয়াছে।” গৌতম কহিলেন, “হে অত্রে! আমি সকলই জানি, আমি কখনও মোহে অভিভূত হই নাই, প্রত্যুত তুমি যখন মহারাজের সাক্ষাৎকারলাভ প্রত্যাশায় জনসমাজে এইরূপ স্তব করিতেছ, তখন লোকে তোমাকেই মোহপরবশ বিবেচনা করিবে। তুমি ধৰ্ম্মের প্রকৃত মর্ম্মজ্ঞ নও এবং সেই ধর্ম্মের প্রয়োজনও জান না। তুমি কোন কারণবশতঃ বন্ধ হইয়াছ, তোমার স্বভাব অদ্যাপি বালকের ন্যায় লক্ষিত হইতেছে।”

তাঁহারা পরস্পর এইরূপ বিবাদ করিতেছেন, দেখিয়া যজ্ঞদীক্ষিত মষিগণ পরস্পর জিজ্ঞাসা করিলেন, ইঁহারা কি প্রকার লোক? কোন ব্যক্তি বা ইঁহাদিগকে রাজসভাপ্রবেশে আদেশ প্রদান কবিয়াছে? ইহারা কি নিমিত্ত এ স্থানে আসিয়া উচ্চৈঃস্বরে কথোপকখন করিতেছেন?”

অনন্তর সর্ব্বধর্ম্মাবিৎ কাশ্যপ তাঁহাদিগের সন্মূখম হইয়া বিবাদের কারণ জিজ্ঞাসা করিলে, মহামুনি গৌতম সভাস্থ সমস্ত মহর্ষিগণকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে দ্বিজোত্তমগণ! আমরা আপনাদিগের নিকট একটি প্রশ্ন করিতেছি, শ্রবণ করুন। অত্রি বৈন্যনৃপতিকে বিধাতা বলিয়া নির্দেশ করিতেছেন, উহা সঙ্গত কি?”

“এই কথা শ্রবণ করিবামাত্র মহর্ষিগণ সত্বর হইয়া সংশয়-নিরাকরণার্থ ধৰ্ম্মজ্ঞ সনৎকুমারের নিকট গমন করিলেন। সনৎকুমার মুনিগণমুখে আদ্যোপান্ত সমস্ত বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “তেপোধনগণ! যেমন অনল অনিলের সহিত সংমিলিত হইলে সমস্ত বন দগ্ধ হইয়া যায়, সেইরূপ ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় পরস্পর একত্র মিলিত হইলে সমুদয় শত্রুই বিনষ্ট হইয়া থাকে। যিনি ধৰ্ম্মস্থাপক ও প্রজাপালক, তিনি ইন্দ্র, শুক্র, বিধাতা ও বৃহস্পতিতুল্য, যিনি প্রজাপতি, বিরাট, সম্রাট, ক্ষত্রিয়, ভূপতি, নৃপ এই সকল শব্দ দ্বারা সংম্ভূয়মান হয়েন, তাঁহাকে কে না অর্চ্চনা করিবে? সেই রাজা ধৰ্ম্মমার্গের প্রথম প্রবর্ত্তক, তিনি সতত নির্ভয়ে রক্ষা করেন, তিনি সকলের ঈশ্বর, স্বর্গের পথ-প্রদর্শক, জেতা, সত্যের আকর ও বিষ্ণুস্বরূপ। পূর্ব্বে মহর্ষিগণ অধৰ্ম্মভয়ে ভীত ও শঙ্কিত হইয়া ক্ষত্রিয়কে মহাবলপরাক্রান্ত করিয়াছেন। যেমন দিবাকর স্বীয় করজাল বিস্তারপূৰ্ব্বক দ্যুলোকে দেবগণের অন্ধকার নষ্ট করিয়া থাকেন, সেইরূপ ভূপতি পৃথিবীর সমস্ত লোকের অধর্ম্ম নিরাকরণ করেন। এইরূপ শাস্ত্র প্রমাণ দৃষ্টে রাজার প্রধানত্ত্ব স্পষ্টই প্রতিপন্ন হইতেছে, অতএব যিনি রাজাকে সর্ব্বপ্রধান বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন, তাঁহার সিদ্ধান্তই অভ্রান্ত হইল।”

অনন্তর বৈন্যরাজা সিদ্ধান্ত-পক্ষের যাথার্থ্যশ্রবণে প্রথম স্তুতিবাদক অত্রির প্রতি একান্ত প্রীত ও প্রসন্ন হইয়া কহিলেন, “হে দ্বিজোত্তত! আপনি সৰ্ব্বজ্ঞ এবং আমাকে নরোত্তম ও সর্ব্বদেবতুল্য বলিয়া কীর্ত্তন করিলেল, এই নিমিত্ত আমি আপনাকে বসনভূষণে বিভূষিত দাসীসহস্র, দশ কোটি সুবর্ণ ও দশ রজতভার সমর্পণ করিতেছি, গ্রহণ করুন।” তখন মহার্ষি অত্রি ন্যায়তঃ সমস্ত প্রতিগ্রাহ করিয়া স্বগৃহে প্রত্যাগমনপূর্ব্বক প্রীতমনে পুত্রগণকে ধন বিভাগ করিয়া দিয়া তপোনুষ্ঠান মানসে বনপ্রবেশ করিলেন।