১৯৬. বৃষদর্ভ-সেদুক-বৃত্তান্ত

১৯৬তম অধ্যায়

বৃষদর্ভ-সেদুক-বৃত্তান্ত

বৈশম্পয়ন কহিলেন, মহারাজ! রাজা যুধিষ্ঠির নিবেদন করিলেন, “ভগবান! পুনরায় রাজন্যমাহাত্ম্য কীর্ত্তন করুন।” মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “মহারাজ! বৃষদর্ভ ও সেদুকনামে দুইজন অস্ত্রশস্ত্ৰবিশারদ রাজা ছিলেন। বৃষদর্ভ বাল্যাবধি উপাংশুব্রতধারী ছিলেন, তন্নিমিত্ত তিনি ব্রাহ্মণকে কেবল রজত ও কাঞ্চন প্রদান করিতেন, সেদুক ইহা বিশেষরূপে অবগত ছিলেন।

“একদিবস বেদাধ্যয়নসম্পন্ন এক ব্রাহ্মণ সেদুকের নিকট উপনীত হইয়া যথাবিধি আশীর্ব্বাদপূর্ব্বক গুরুদক্ষিণার নিমিত্ত সহস্ৰ অশ্ব প্রার্থনা করিলেন। সেদুক কহিলেন, “ভগবন! আমার গুর্ব্বর্থ [গুরুর নিমিত্ত প্রদেয় অর্থ] প্রদান করিবার ক্ষমতা নাই; অতএব আমার বৃষদর্ভসকাশে গমন করুন। সেই রাজা পরমধার্ম্মিক, তাঁহার নিকট প্রার্থনা করিলে তিনি অবশ্যই আপনার অভিলষিত গুর্ব্বর্থ প্ৰদান করিবেন, সন্দেহ নাই। আমি উত্তমরূপে অবগত আছি, তিনি উপাংশু-ব্ৰতচরণ করিতেছেন।”

“অনন্তর ব্রাহ্মণ বৃষদর্ভসকাশে গমনপূর্ব্বক সহস্ৰ অশ্ব প্রার্থনা করিলে তিনি তাঁহাকে কশাঘাত করিলেন। ব্রাহ্মণ কহিলেন, মহারাজ! আমি নিরপরাধ, কি নিমিত্ত আমাকে তাড়না করিলেন?” ব্ৰাহ্মণ এই কথা বলিয়া শাপ প্রদানে উদ্যত হইলে রাজা কহিলেন, “হে বিপ্ৰ! যে ব্যক্তি তোমাকে স্বীয় ধন দান না করিবে, তাহাকে কি অভিসম্পাত করা উচিত অথবা অন্যায় শাপ প্ৰদান করা কি ব্ৰাহ্মণের কর্ম্ম?”

“ব্রাহ্মণ কহিলেন, “হে রাজাধিরাজ! আমি সেদুককর্ত্তৃক প্রেরিত হইয়া ভিক্ষার্থে আপনার নিকট আগমন করিয়াছি, শাপ প্ৰদান করা বা অন্য কোন অভিলাষ আমার নাই।’ রাজা কহিলেন, “হে ব্ৰহ্মন! অদ্য পূর্ব্বাহ্নে আমার যত অর্থগম হইবে, তৎসমুদয় আপনাকে প্রদান করিব; কিন্তু কশাঘাত আর কোনক্রমেই দূরীকৃত হইতে পারে না।” এই কথা বলিয়া রাজা বৃষদর্ভ একদিনের সমুদয় আয় ব্রাহ্মণকে প্রদান করিলেন। তাহা সহস্ৰাধিক অশ্বের মূল্য হইবে সন্দেহ নাই।

অগ্নি-ইন্দ্ৰকর্ত্তৃক শিবিরাজের ধর্ম্মপরীক্ষা

“একদা দেবতাদিগের এই প্ৰস্তাব হইয়াছিল যে, আমরা ভূতলে অবতীর্ণ হইয়া উশানরের পুত্ৰ শিবিরাজের স্বভাব পরীক্ষা করিতে অভিলাষ করি। পরে অগ্নি ও ইন্দ্র এই প্রস্তাবে অনুমোদন করিয়া ধরাতলে সমাগত হইলেন। অনন্তর অগ্নি কপোতরূপ ধারণপূর্ব্বক শিবিরাজের নিকট উপস্থিত হইবার নিমিত্ত ধাবমান হইলে ইন্দ্ৰও শোনরূপী হইয়া সেই কপোতের অনুসরণ করিলেন। কপোত দিব্যাসনাসীন রাজার উৎসঙ্গে নিপতিত হইলে পুরোহিত কহিলেন, “মহারাজ! এই কপোত শ্যেনভয়ে ভীত হইয়া প্রাণরক্ষার নিমিত্ত আপনার শরণাগত হইয়াছে। যাহা হউক, এইরূপ কিংবদন্তী আছে যে, অঙ্গে সহসা কপোতনিপতন হইলে অনিষ্ট ঘটিয়া থাকে, আপনি দিগদিগন্তের অধীশ্বর, অতএব ব্ৰাহ্মণকে ধনপ্রদানপূর্ব্বক এই দুনিমিত্তের প্রতিকার করুন।”

“তখন কপোত কহিল, “মহারাজ! আমাকে প্রকৃত কপোত বিবেচনা করিবেন না। আমি মুনি, স্বাধ্যায়সম্পন্ন ব্রহ্মচারী, তপোনিরত, দান্ত ও নিম্পাপ; আমি কদাচ আচাৰ্য্যের প্রতি প্রতিকূল বাক্য প্রয়োগ করি না; আমি তন্ন তন্ন করিয়া বেদাধ্যয়ন করিয়াছি; প্রতিদিন বেদপাঠ ও তাহার অনুশীলন করিয়া থাকি; এক্ষণে কেবল শ্যেনভয়ে ভীত হইয়া প্রাণরক্ষার্থ আপনার গাত্রে নিপতিত হইয়াছি। মহারাজ! শ্রোত্রিয়কে শ্যেনমুখে নিক্ষেপ করা অনুচিত; অতএব আমাকে শ্যেনহস্তে অৰ্পণ করিবেন না; আমি বাস্তবিক কপোত নাহি।”

“শ্যেন কহিল, “মহারাজ! এই সংসারে জন্মগ্রহণবিষয়ে অত্যাশ্চৰ্য্য পৰ্য্যায় লক্ষিত হইয়া থাকে। পূর্ব্বজন্মে যাঁহাদিগকে পিতা, মাত, ভার্য্যা পুত্র, কন্যা বলিয়া আসিয়াছেন, মপরজন্মে তাঁহারাই আমার পুত্ৰ, কন্যা, পিতা ও মাতা হইয়া জন্মগ্রহণ করেন; শত্রু মিত্র এবং মিত্ৰ শত্রু হইয়া থাকে; অতএব বোধ হইতেছে, আপনি পূর্ব্বে এই কপোত হইতে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন; এই নিমিত্ত জন্মান্তরীণ পিতা কপোতকে রক্ষা করিতেছেন। যাহা হউক, এক্ষণে আমার আহারে বিয়োৎপাদন করা আপনার অনুচিত।”

“রাজা কহিলেন, “পক্ষিজাতি ঈদৃশ উৎকৃষ্ট সংস্কৃত বাক্য উচ্চারণ করিতে পারে, ইহা কোন ব্যক্তি প্রত্যক্ষ করিয়াছে? কপোত এবং শ্যেন এই উভয়ের ঈদৃশ বাক্য শ্রবণ করিয়া কিরূপে সদস্যৎ নিশ্চয় করি? যিনি ভীত ও শরণাগত ব্যক্তিকে শত্রুহস্তে প্রদান করেন, তাঁহার রাজ্যে বর্ষাকালে বৃসি।ট হয় না, সময়ে বীজ বপন করিলে তাহা অঙ্কুরিত হয় না এবং তিনি বিপৎকালে শরণার্থী হইলে কেহ তাঁহাকে পরিত্ৰাণ করে না। তাঁহার প্রজাসকল হ্রস্বকলেবর হয়, পিতৃগণ তাঁহার নিকটে বাস করেন না এবং দেবতারা তাঁহার হব্য-প্রতিগ্রহে পরাঙ্মুখ হয়েন। সেই অল্পমতি ব্যক্তির জীবন-ধারণ করা বৃথা, তিনি কদাচ স্বৰ্গলোক লাভ করিতে পারেন না এবং ইন্দ্ৰাদি দেবগণ তাঁহার প্রতি বজ্রপ্রহার করেন। অতএব এই কপোতের পরিবর্তে ওদনের [অন্ন] সহিত বৃষভ পাক করিয়া তোমাকে প্রদান করিতেছি। হে শ্যেন! তুমি যে প্রদেশে অবস্থিতি করিয়া গ্ৰীত হও, তথায় গমন কর, শিবিরাজ তোমার নিমিত্ত সেই স্থানে মাংস বহন করিবে।”

শিবিরাজের আত্মদানে কপোতের প্রাণরক্ষা

“শ্যেন কহিল, “হে রাজন! আমি বৃষভ প্রার্থনা করি না এবং কপোত ভিন্ন অন্য মাংসেও আমার তাদৃশ অভিরুচি নাই, অদ্য দেবতারা আমাকে এই কপোত প্ৰদান করিয়াছেন, উহাই আমার ভক্ষ্য; অতএব আপনি উহা প্ৰদান করুন।” রাজা কহিলেন, “হে শ্যেন! আমি সকলের সমক্ষে তোমাকে সর্ব্বাঙ্গসম্পূর্ণ বলীবর্দ্দ প্রদান করিতেছি, তুমি এই কপোতের প্রাণীহিংসা করিও না। কপোত প্রাণভয়ে আমার শরণাপন্ন হইয়াছে, তন্নিমিত্ত আমি আপনার প্রাণ পৰ্য্যন্ত পরিত্যাগ করিতে পারি, কিন্তু কপোতকে প্ৰদান করিতে কদাচ সম্মত নহি, অতএব তোমার কপোতপ্রাপ্তিপ্রত্যাশায় ঈদৃশ ক্লেশস্বীকার করিবার আবশ্যক নাই। যদ্বারা শিবিগণ [ঔশীনরবংশীয় পূর্ব্বরাজগণ] প্রসন্ন হইয়া সাধুবাদ প্ৰদানপূর্ব্বক আমার প্রশংসা করেন এবং তোমার প্রিয়কাৰ্য্য সম্পাদিত হয়, তাহা আদেশ করা, আমি অবশ্যই সম্পন্ন করিব।”

“শ্যেন কহিল, “মহারাজ! আপনি স্বীয় দক্ষিণ উরু হইতে কপোত-পরিমিত মাংস কর্ত্তনপূর্ব্বক প্রদান করুন, তাহা হইলে আমার প্ৰিয়কাৰ্য্য-সংসাধন ও কপোতের প্রাণরক্ষা হইবে এবং শিবিগণও আপনার যথেষ্ট প্রশংসা করবেন।”

“অনন্তর রাজা স্বীয় দক্ষিণ উরু হইতে মাংসপেশী কর্ত্তনপূর্ব্বক তুলাদণ্ডে ধারণ করিয়া দেখিলেন যে, মাংস অপেক্ষা কপোত গুরুতর; তখন পুনরায় মাংস কর্ত্তন করিয়া পরিমাণ করিলেন, তথাপি কপোতের সমান হইল না, এইরূপে সর্ব্বশরীরে মাংস ছেদনপূর্ব্বক তুলাদণ্ডে পরিমাণ করিলেও কপোত গুরুতর হইল। পরিশেষে রাজা স্বয়ং তুলায় আরোহণ করিলেন। তখন শ্যেন এই লোকাতীত ব্যাপার অবলোকন করিয়া রাজার কিছুই অপ্রিয় নাই, কপোত অনায়াসে রক্ষা পাইল’, এই কথা বলিয়া অন্তর্হিত হইল।

“অনন্তর রাজা কপোতকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘হে পক্ষীন্দ্ৰ! শিবিগণ তোমাকে কপোত বলিয়া জানেন, সম্প্রতি জিজ্ঞাসা করি, এই শ্যেন কে? আমার বোধ হয়, ইনি কোন অসামান্যশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি হইবেন, নচেৎ সামান্য লোকে ঈদৃশ দুরূহ কাৰ্য্য করিতে কখনই সমর্থ হয়েন না। কপোত কহিল, ‘মহারাজ! আমি ধূমকেতু অগ্নি, আর এই শ্যেন শচীপতি ইন্দ্র। আমরা তোমার সাধু-ব্যবহার সবিশেষ পরিজ্ঞাত হইবার মানসে তোমার সকাশে আগমন করিয়াছি। তুমি আমার নিষ্ক্রয়ার্থ [ঋণপরিশোধ জন্য] যে মাংসপেশী অসিদ্ধারা কর্ত্তনপূর্ব্বক প্রদান করিয়াছ, আমি তাহা তোমাদের সুবর্ণবর্ণ, মনোহর, অতি-পবিত্র রাজচিহ্নস্বরূপ করিব। তোমার দক্ষিণপার্শ্ব হইতে প্ৰজাপালক, অতি-যশস্বী, দেবর্ষিগণের আদরণীয় এক পুত্র জন্মিবে, তাহার নাম কপোতারোমা; সে সৌরথেয়গণের প্রধান এবং অতি বীৰ্য্যশালী হইবে ’ ”